[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব...]
পীরজাদার প্রশ্নে ইয়াহিয়া বেশ অপ্রস্তুত হলেন। তিনি বললেন, নির্বাচনের দাবি, গণতন্ত্রের দাবি, নতুন সংবিধান আর গণপরিষদের দাবি দীর্ঘদিনের। এটা শুধু পূর্ব-পাকিস্তানিদের দাবি না, এটা পশ্চিম-পাকিস্তানেরও দাবি। এটি পাশ কাটানোর কোনো উপায় ছিল না। ভুলে যাবেন না আইয়ুব খানের দুঃশাসন দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল, সেটিকে ঠিক করার জন্যে আমরা টেকওভার করেছি।
কিন্তু তার পরও পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে নি।
জেনারেলস, ২৬ মার্চ ১৯৬৯ আমি আমার প্রথম বেতার ভাষণেই বলেছি: শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া আমার অন্য কোনো উচ্চাশা নেই।
সে তো আপনি কথার কথা বলেছেন।
হ্যাঁ বলেছি এবং সে জন্যেই আমি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে লিগ্যাল ফেম ওয়ার্কের চারটি শর্ত দিয়েছি। তার মধ্যে একটি হলো- পরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত করবে, অন্যথায় পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষিত হবে। এখন দেখা যাক ওরা কী করে।
লেকিন আপ মিঃ ভুট্টোক ক্যায়সে সামহাল লেঙ্গে?
নির্বাচনের আগে পরে মিঃ ভুট্টোর সাথে আমার অনেকবার কথা হয়েছে, আমার সঙ্গে আপনারাও ছিলেন। ভুট্টো সাহেবকে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, ক্ষমতায় যে-ই আসুক আমাদের আর্মিদের স্বার্থ রক্ষা না হলে, সামরিক বাজেট কাটছাঁট হলে আমরা যে-কোনো সময় গণপরিষদ ভেঙে দেব। কিংবা ১২০ দিনের মধ্যে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তাদের কাজ ফুলফিল না করলে আমরা সব স্থগিত করে দিব। ভুট্টো ওয়াদা করেছেন পাকিস্তান আর্মিকে উপেক্ষা করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।
এটা তো খুবই ভালো খবর।
ইনফ্যাক্ট লারকানায় শিকারে গিয়ে আমরা গত মাসে পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে একমত হয়েছি। সৈন্য পাঠানো শুরু হয়ে গেছে। এখন কেবল অপেক্ষার পালা। বাট আমরা ওদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাব, আমরা ভান করব গণপরিষদ গঠনের ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। পার্ট অফ দ্যা প্ল্যান, ২৭ জানুয়ারি ভুট্টো সাহেব শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে ঢাকা গিয়েছিল।
জেনারেল পীরজাদা বললেন, সব ঠিক আছে মি. প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমার একটা বিষয় জানার আছে।
বলুন, কী বিষয়?
পূর্ব-পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের স্ট্র্যাজেডি কী ছিল, আমাদের গোয়েন্দারা সেখানে কী করেছে? আমি যতটুকু জানি বাঙালিদের সহজেই কেনা যায়। সেখানে আমাদের ইসলামপছন্দ মিত্ররা ছিল, জামায়েতে ইসলামী, মুসলিম লীগ... ওরা ছিল। সেখানে শেখ মুজিবের দল কী করে ১৬৭ আসন পায়? আর ওরা মাত্র দুইটা! আমাদের গোয়েন্দারা সেখানে কোনো কাজই করে নি, কিন্তু টাকা নিয়েছে দেদার।
স্পষ্টই জেনারেল পীরজাদা গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল আকবরের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে দিলেন।
জেনারেল আকবর আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। তিনি জানতেন পীরজাদা এ প্রসঙ্গটি তুলবে। গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে নির্বাচন বিষয়ে নজরদারি তার এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে। মানুষ কি আর চিরকাল বোকা থাকে? মেধা-মননে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। অথচ সিভিল সার্ভিস, প্রতিরক্ষা, শিল্প, ব্যাংকিং সবক্ষেত্রেই বাঙালিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। পাকিস্তানে উচ্চপদস্থ ৭৪১ জন কর্মচারীর মধ্যে সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারি পূর্ব-পাকিস্তানের মাত্র ৫১। বিমান বাহিনীর ৭০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি মাত্র ৬০ জন। আর নৌবাহিনীর ৬০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি মাত্র ৬ জন।
শুধু উচ্চপদেই বৈষম্য নয়, বৈষম্য সব সবখানে। ১৯৬৯-৭০ অর্থ বছরে পশ্চিম-পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয় ৬২ বিলিয়ন টাকা আর পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যয় হয় ৩০ বিলিয়ন টাকা। অথচ বৈদেশিক আয়ের ৬১ ভাগ এসেছে পূর্ব-পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৩১ টাকা আর পাকিস্তানের ৫৫৩ টাকা। এই বৈষম্যগুলো মানুষ এখন বুঝতে পারছে। এত বড় একটা ঘূর্ণিঝড় গেল, তিন লক্ষ লোক মারা গেল, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো বড় নেতা তাদের সহানুভূতি জানায় নি, কোনো ত্রাণ পাঠায় নি। এমনকি খোদ প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত উপদ্রুত এলাকায় যান নি।
আমেরিকা থেকে ফেরার পথে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় নামেন। মাত্র দুই ঘণ্টা যাত্রাবিরতি নিয়েছিলেন লোক দেখানোর জন্যে। কিন্তু মানুষ তো আর বোকা নয়, তারা উপেক্ষাটা ঠিকই বুঝতে পারে। আকবর জানেন প্রেসিডেন্ট সাহেব কেন সেদিন ঢাকা থেকে ফিরে এসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট তার বান্ধবী নুরজাহানকে কথা দিয়েছিলেন, করাচী এয়ারপোর্টে নেমে তিনি নুরজাহানকে দেখতে চান এবং হয়েছেও তাই।
বিপদে যে পাশে দাঁড়ায় সে হয় প্রকৃত বন্ধু। আওয়ামী লীগের কর্মীরা সেই দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটের সময় মানুষ সেটি মনে রেখেছে, ভোটের সময় তারা একচেটিয়া আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যে স্লোগান দিয়েছে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন, জবাব চাই জবাব চাই’- একটুও মিছে বলে নি ওরা। কিন্তু আজকের এ সভায় এসব অর্থহীন। পাকিস্তান আর্মিতে আত্মসমালোচনার কোনো স্থান নেই।
এসব নানা চিন্তা মাথায় থাকলেও জেনারেল আকবর সেসবের ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। তিনি নিজের সাফাই দিতে লাগলেন, জেনারেলস, পূর্ব-পাকিস্তানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থী দিয়েছিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন)। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ৯৩জন। এ ছাড়া পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি ৭৯টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ দিয়েছিল ১৬২টি আসনে। আওয়ামী লীগ যাদের মনোনয়ন দিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ ছিল আইনজীবী। এছাড়া ব্যবসায়ী ছিল ১৯ শতাংশ এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল ৬ শতাংশ। ওরা প্রত্যেকেই সুবক্তা এবং সব সময় জনগণের পাশে থেকেছে।
আর আমাদের মিত্রদেরও তো আইনজীবী ছিল, অধ্যাপক গোলাম আজম ছিল। তারা কী করেছে?
সরি টু সে দ্যাট, এরা কেউ আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার সামনে দাঁড়াতে পারে নি। যা হয়েছে সেটা অকল্পনীয়, ছয় দফা আর শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার জোয়ারে সব ভেসে গেছে।
এতক্ষণ পর টিক্কা খান একটি কথাও বলে নি, এবার সে আর চুপ করে থাকতে পারল না, রাগে গর্জে উঠল, শেখ মুজিবের ছয় দফা ভুলিয়ে দিতে হবে। নিমকহারাম বেইমান বাঙালিদের কচুকাটা করতে হবে। আওয়ামী লীগের একেকটা পাণ্ডাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে। শালারা হিন্দুর জাত। ওদের মেয়েদের রেপ করে ঘরে ঘরে বুনে দিতে হবে পাকিস্তানের বীজ। আনেওয়ালে বেবিরা হবে সাচ্চা মুসলমান, সাচ্চা পাকিস্তানি। এহি মেরা জুজুন, এহি মেরা মকসদ।
সবাই করতালিতে টিক্কা খানের এই কথাকে স্বাগত জানাল। আসলে এ রকমই একটা হুঙ্কারের জন্যে সবাই অপেক্ষা করছিল। ভুলত্রুটি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সেসব নিয়ে গবেষণা করে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এখন আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এখনই প্ল্যান করে কাজে নেমে পড়তে হবে।
ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী তোমার প্ল্যান, কী করতে চাচ্ছ তুমি?
আই নিড থার্টি থাউজেন্ড সোলজার, আই নিড ফোরটি এইট আওয়ারস। ব্যস।
তারপর?
এই ৪৮ ঘণ্টায় আওয়ামী লীগের সব নেতা, ইউনিভার্সিটির সব ছাত্র আর সব বেইমানকে আমি মেরে সাফ করে দেব। ৪৮ ঘণ্টা পর আমি আপনাকে যে ঢাকা উপহার দেব সেটি হবে বেইমানমুক্ত এক ঢাকা নগরী। এই ৪৮ ঘণ্টায় যে শিক্ষা আমি তাদের দেব, তাতে আমরা হেসেখেলে আরও ৫০ বছর ঢাকাকে পায়ের নিচে দাবায়া রাখতে পারব।
কিন্তু এত সোলজার গোলাবারুদ কী করে যাবে?
সোলজার যাবে প্লেনে করে আর গোলাবারুদ যাবে জাহাজে।
ইন্ডিয়ার ওপর দিয়ে তো কোনো প্লেন যেতে পারবে না। শ্রীলঙ্কা ঘুরে যেতে হবে।
লজিস্টিক আপনারা সামাল দেবেন। আমার কাজ হলো ঢাকাকে শত্রুমুক্ত করা, আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন করা। ৪৮ ঘণ্টায় আমি পঞ্চাশ হাজার বাঙালি মেরে সাফ করে ফেলব।
গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আকবর ভ্রু-কুঁচকে বলেন, কিন্তু এ রকম একটা মাস কিলিং বহির্বিশ্বের কাছে আমরা কী করে সামাল দেব?
ইয়াহিয়া মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বললেন, ওসব মিডিয়া আমি সামাল দেব। পাকিস্তানের বিরোধিতাকারী সব সংবাদপত্রের অফিস জ্বালিয়ে দেব, তামাম ফরেন জার্নালিস্ট আমরা দেশ থেকে বের করে দেব। কাউকে শহরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আমেরিকা এটা কি সহজভাবে নেবে?
আমি তো বলেছি মিডিয়া আর ফরেন অ্যাফেয়ার আমি সামাল দেব। আমাদের ইন্টারনাল পলিটিক্সে আমেরিকা নাক গলাবে না। ভিয়েতনাম নিয়ে নিক্সন সাহেব খুব চাপের মধ্যে আছে। তিনি চাইছেন চীনের সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে। বন্ধু দেশ হিসেবে আমরা আমেরিকা এবং চীনের সঙ্গেই আছি। আমাদের তরফে আমরা দুদেশকেই সাহায্য করে যাচ্ছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন কিসিঞ্জার খুব শীঘ্রই পাকিস্তানে আসবেন এবং চীন সফরে যাবেন।
জেনারেল আকবর বললেন, আমার একটি প্রশ্ন, যদি কোনো কারণে আমাদের এই অভিযান দীর্ঘায়িত হয় তাহলে অস্ত্রের জোগান কীভাবে হবে?
এক বছর ফুল ফ্ল্যাজে যুদ্ধ করার মতো গোলাবারুদ আমাদের আছে। তারপরও আমরা আমেরিকা ও চীনের কাছে অস্ত্র চাইব। আমাদের প্রপাগান্ডা হবে-ইন্ডিয়া পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার ইন্ধন দিচ্ছে, তাই আমাদের পূর্ব সীমান্ত সিকিউর করার জন্যে গোলাবারুদ চাই।
টিক্কা খান সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন, এই অভিযান নিয়ে আমার আরও কিছু কথা আছে।
কী প্রশ্ন?
রিয়াল এডমিরাল আহসান এখন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি কি আমাদের এই অভিযানে সায় দেবেন? যদি না দেন, তাহলে আমার আইনগত রুল কী হবে?
টিক্কা শোনো, পাকিস্তান আমাদের। আমরা যে-কোনো মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করব। শেখ মুজিব এবং তার অনুসারীরা পাকিস্তানের দুশমন। এই দুশমনদের শাস্তি দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আমরা জেনারেলরা সেই কর্তব্য পালন করব। আহসান আর ইয়াকুব খান যদি এই অভিযান পরিচালনায় সায় না দেয়, আমি তোমাকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করব। তোমাদের সাথে মিটিং শেষ করে আমি গভর্নরদের সাথে মিটিংয়ে বসব। বিষয়টি আমি উত্থাপন করব। এস ইউ নো আমি কালই বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছি। টিক্কা তুমি প্রস্তুত হও।
নাফরমানদের শাস্তি দিতে টিক্কা আর টিক্কার তলোয়ার সবসময় প্রস্তুত মিঃ প্রেসিডেন্ট। প্রথম অভিযানের রাতেই ত্রিশ হাজার বাঙালিকে আমি হত্যা করব।
ইয়াহিয়া টিক্কাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, ত্রিশ হাজার না, প্রয়োজন হলে ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করবে কিন্তু কিছুতেই ওদের হাতে শাসন ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।
ইনশাল্লাহ মিঃ প্রেসিডেন্ট, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘ইনশাল্লাহ, ইনশাল্লাহ’।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.