নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (দশম পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (দশম পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন দশম পর্ব।]

আমার দেখাদেখি অন্য একটি ট্যাক্সিও টার্ন করেছিল, সেও ধরা খেলো। দুটো ক্যাব রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ আমাদের লাইসেন্স রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তার গাড়িতে ফিরে গেছে। আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে সিগারেট ধরিয়েছি, যদিও এটা আইন বহির্ভূত। নিয়ম হচ্ছে গাড়িতে বসে থাকা। নিউইয়র্ক শহরের ক্যাব ড্রাইভাররা এসব পাত্তা দেয় না। পুলিশও দেয় না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে উদাস মনে সিগারেট টানছি, মনটা খারাপ হয়ে গেছে। এটাই আমার জীবনের প্রথম টিকেট। টিকেট খেলে কী করতে হয়, কোন উকিলের কাছে যেতে হয় সেটাও আমার জানা নেই। অন্য যে ট্যাক্সিটি আমার সাথে টিকেট খেয়েছিল, সে আমার দিকে এগিয়ে এসে হিন্দিতে হেসে বলল, সালেনে দেখ লিয়া (পুলিশ শালায় দেখে ফেলেছে)।

লোকটি ইন্ডিয়ান শিখ। বয়স অনেক। তাকে বললাম, এটাই আমার জীবনের প্রথম টিকেট।

সে বলল, টেনশন কিউ লেতা হে ইয়ার? ল ইয়ার ড্যাবরা ম্যাগি কো টিকেট দে দো, উও সাব ঠিক কর দেগা। 

ড্যাবরা ম্যাগি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের প্রিয় উকিল, এমনকি আমারও। সে আমার টিকেটের মামলা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল। মামলা হয়েছিল ডিসমিস।  

আরেকটা গল্পও বলি। হঠাৎ মনে পড়ল। এক ভোরবেলা কাজে গিয়েছি। তখন আমি দিনের শিফটে কাজ করি। ঠিক ভোর ছ’টায় সিটিতে (ম্যানহাটানকে আমরা সিটি বলে ডাকি) ঢুকেছি, প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, অথচ কোনো প্যাসেঞ্জার পাচ্ছি না। সব ট্যাক্সিতে প্যাসেঞ্জার আছে অথচ আমার ট্যাক্সিটি খালি। হঠাৎ এক প্যাসেঞ্জারকে চোখে পড়ল। সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার বাঁ দিকে আমি আছি ডান দিকে। আমি অন্তত পাঁচটি গাড়িকে কাট করে ওই প্যাসেঞ্জারকে গাড়িতে ওঠালাম। যে পাঁচটি গাড়িকে কাট করেছিলাম তার মধ্যে একটি ছিল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আন্ডারকাবার গাড়ি। সে সাথে সাথে বাতি জ্বালিয়ে আমার পিছু নিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দিলাম। কালো পুলিশ অফিসারটি আমার কাছে এসে বলল, তুমি যে কী ভয়ংকরভাবে লেন চেঞ্জ করেছো সেটা জানো?

আমি কিছু বললাম না।

সে বলল, ট্রিপশিট, হ্যাক লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং রেটকার্ড দাও।

আমি সবকিছু তাঁর হাতে দিয়ে চুপচাপ গাড়িতে বসে রইলাম। আজকের দিনটা খারাপভাবে শুরু হয়েছে। কী আর করা!

কিছুক্ষণ পর পুলিশ অফিসার ফিরে এল। আমার হাতে সবকিছু ফিরিয়ে দিল। লক্ষ করলাম সেখানে কোনো টিকেট নাই! ঘটনা কী?

পুলিশ অফিসারকে বললাম, টিকেট কোথায়?

পুলিশ অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, ভোর  ছ’টায় কাজে এসেছ, এখন বাজে সকাল আটটা এখনো একটা প্যাসেঞ্জারও পাও নি তাই তোমাকে টিকেট দিলাম না শুধু ভার্বাল ওয়ার্নিং দিয়ে তোমাকে এবার ছেড়ে দিচ্ছি আর কখনো এভাবে গাড়ি চালাবে না।

অপরিচিত সেই কালো পুলিশ অফিসারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মনটা সেদিন ভরে উঠেছিল।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.