সুবর্ণ জয়ন্তীতে ‘লাঠিয়াল’

সুবর্ণ জয়ন্তীতে ‘লাঠিয়াল’

‘১৯৭৫ সালে মুক্তিলাভ করেছিল নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রটি। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম আসরে ছয়টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার লাভ করে। এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উল্লেখযোগ্য এই চলচ্চিত্রটির মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী ২২ আগস্ট। এ উপলক্ষে চলচ্চিত্রটির ওপর আলো ফেলা হলো।

‘লাঠিয়াল’ নানা কারণেই উল্লেখযোগ্য একটি চলচ্চিত্র। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম আসরেই এটি বাজিমাত করে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ও দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। সমালোচকদেরও। প্রধান দুই অভিনেতা আনোয়ার হোসেন এবং ফারুক যথাক্রমে কাদের লাঠিয়াল এবং দুখু মিয়ার চরিত্রে ছিলেন সাবলীল। এই চলচ্চিত্রে তাদের বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় দেখার পরে সেই সময়ের দর্শকেরা তাঁদের ‘লাঠিয়াল’ উপাধি দেন।

আরেকটি কথা, নদীমার্তৃক বাংলাদেশে সেই সময় নদী ভাঙ্গা এবং নতুন চর জাগা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। আর সেই চর দখল নিয়ে একাধিক দলের মধ্যে ঝগড়া ও মারপিটও ছিল নিয়মিত ঘটনা। বিভিন্ন গ্রামে তখন লাঠিয়াল বাহিনীও ছিল। লাঠিয়াল সদস্যদের তেমন গল্প নিয়েই নারায়ণ ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন এই চমৎকার চলচ্চিত্রটি।

‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের কাহিনি, সংলাপ, ও চিত্রনাট্য লিখেছেন শেখ ফজলুল রহমান ও জহিরুল হক। কাহিনিধারায় দেখা যায়—কাদের লাঠিয়াল গ্রামের মাতবরের হয়ে কাজ করে। তার ভাই দুখু মিয়া গান করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে। কাদের তার ভাইকে খুব ভালোবাসে। কাদেরের স্ত্রীও দুখুকে অনেক স্নেহ করে। দুখু তার গ্রামেরই বানুকে পছন্দ করে। মাতবরের ছেলে মকবুল বানুকে উত্ত্যক্ত করলে দুখু তাকে মারধর করে। মাতবর কাদেরের কাছে তার ছেলের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ করে তাকে ও তার ভাইকে শাসায়। কাদের রাগান্বিত হয়ে বাড়িতে এসে দুখুকে মারধর করে। এতে দুখু রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। নদী তীরে এক মোড়লের সাথে তার পরিচয় হয়। মোড়ল তার গানের গলায় অভিভূত হয়ে তাকে তাদের দলের একজন করে নেয়। দুখুর নতুন কর্মজীবন শুরু হয়। অন্যদিকে বানু তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এক রাতে দুখু বানুর সাথে দেখা করে যায়। ইতিমধ্যে মাতবর বানুকে তার ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বানুর পিতার কাছে প্রস্তাব পাঠায়। বানু ও মকবুলের বিয়ে ঠিক হয়। দুখুর ভাবি দুখুকে এই খবর পাঠায়, কিন্তু দুখু একটি চর দখল করতে চলে যায়। মাতবরও তার ছেলের বিয়ের দিন সেই নতুন চরের খবর পায়। সে কাদেরকে তার লাঠিয়ালসহ সেই চর দখল করতে পাঠায়। বানু ও কাদেরের স্ত্রীও এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ করার জন্য নতুন চরের উদ্দেশে যাত্রা করে।

দুখু ও কাদেরের মধ্যে চরের দখল নিয়ে মারপিট শুরু হয়। দুজনেই চরের দখল ছাড়তে নারাজ। তাদের মাঝে কাদেরের স্ত্রী চলে এলে কাদেরের লাঠির আঘাত তার মাথায় লাগে। কাদের ও দুখু, দুই ভাই, মারপিট বন্ধ করে। কিন্তু মাতবর সেখানে এসে কাদেরকে শাসায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কাদের তার লাঠির আঘাতে মাতবরকে খুন করে। ফলে সাধারণ জনগণ এই চরের মালিকানা লাভ করে।

কাদের ও দুখু, দুই ভাই দুই ধরনের। কাদের পেশাগতভাবে লাঠিয়াল। মাতবরের অনুগত। তার আদেশে অন্যায় কাজ করতেও দ্বিধা করে না। অন্যদিকে দুখুর মন  মন-গরিব দুখীর জন্য কাঁদে। তাই যে নাকি বড় ভাইয়ের কথায় কখনো লাঠি ধরে নি, লাঠিয়াল হয় নি, সে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লাঠিয়ালে পরিণত হয়, চর দখলে প্রয়াসী হয়। অথচ সে শিল্পী মানুষ। বাঁশি বাজায়। গান গায়। বলা যায় যে বাঁশ দিয়ে বাঁশি হয়, সেই বাঁশ দিয়েই হয় লাঠি। কাদের ও দুখু, দুই ভাই, প্রকৃত অর্থে দুই রূপক চরিত্র।

এই চলচ্চিত্রটি সত্তর দশকের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নান্দনিক উপহার। সেখানে সেলুলয়েডে মূর্ত হয়ে উঠেছে নদী, চর, প্রান্তিক মানুষদের যাপিত জীবন, গ্রাম্য রাজনীতি, ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা এবং সম্পর্কের টানাপড়েন।

আরেকটি কথা, কাদেরের স্ত্রী স্নেহ করে দুখুকে। অথচ কাদের সন্দেহ করে যে, তাদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। শেষে অবশ্য তার ঘুম ভাঙে। এই পর্যায়ে চলচ্চিত্র মনস্ক দর্শকদের চেতনায় উঁকি দিতে পারে উত্তমকুমার অভিনীত ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ চলচ্চিত্রটি অথবা একই নামে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটিা কথা। তবে এটিও সত্যি যে, একটি দৃশ্য ছাড়া চলচ্চিত্রটির অন্য কোথাও ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’-এর ছায়া নেই।

চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রসমূহে অভিনয় করেছেন—আনোয়ার হোসেন (কাদের লাঠিয়াল), ফারুক (দুখু মিয়া, কাদেরের ছোট ভাই), ববিতা (বানু), রোজী আফসারী (কাদেরের স্ত্রী), নারায়ণ চক্রবর্তী (মোড়ল), ওবায়দুর রহমান (মাতবর) এবং এটিএম শামসুজ্জামান (মকবুল, মাতবরের পুত্র)। অন্যান্য চরিত্রের অভিনয়শিল্পীরা হলেনÑরিনা আক্রাম, আবদুল মতিন, রহিমা খাতুন, আবদুস সোবহান, কাজী শফিক, জিল্লুর রহমান, দিলীপ চক্রবর্তী, সাইফুদ্দিন।

‘লাঠিয়াল’-এর সংগীত পরিচালনা করেছেন সত্য সাহা। গীত রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চলচ্চিত্রটিতে সাতটি গান রয়েছেÑসেই তো আমার মা, সুখের আশায় সুখের নেশায়, ঐ আগুনে পুড়বি, আমি খোকন রাজা, দেখো দেখো গ্রামবাসী, ঘাটের কোকিল ঘাটে যা রে, ঢোলক বাজে কাসী বাজে। এর মধ্যে সেই তো ‘আমার মা’ এবং ‘ঘাটের কোকিল ঘাটে যা রে’ গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। নেপথ্যে কণ্ঠদান করেছিলেন যথাক্রমে আব্দুল আলীম এবং সাবিনা ইয়াসমিন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.