জন-ক্রিস্টিনা এবং হিমু !

জন-ক্রিস্টিনা এবং হিমু !

মধ্যরাতে একটু আগেই বেরিয়ে পড়লাম লাসভেগাসের রাস্তায়! চারপাশে নিয়নের ছড়াছড়ি। রাস্তায় লোকজনের কমতি নেই। হাঁটতে হাঁটতেই এসে দাঁড়ালাম ব্যালাজিও রিসোর্ট ও ক্যাসি্নোর সামনে। এই সেই ব্যালাজিও ক্যাসিনো! দু'হাজার এক সালে এই ক্যাসিনোর ভল্টেই ডাকাতি করেছিলেন হলিউডের তিন নায়ক– জর্জ কুনি, ব্র্যাড পিট ও ম্যাট ডেমন। না বাস্তবে নয়, ডাকাতি করেছিলেন হলিউডের বিখ্যাত এক ছবিতে। ছবির নাম ওশ্যান ইলেভেন! এই মধ্যরাতে ব্যালাজিওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় হাজার খানেক নর-নারী। ঘটনা দেখতে এগুলাম সামনে। দেখলাম হোটেলের সামনেই বিশাল লেক। ওই লেকে সারি সারি করে দাঁড়ানো প্রায় শ’ তিনেক ফোয়ারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ওয়াটার ফাউন্টেন শো। সবাই তারই প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। আমিও যোগ দিলাম ওই প্রতীক্ষায়। ওখানেই পরিচয় হলো জন ও ক্রিস্টিনার সঙ্গে। আমেরিকান যুগল। ওরা। এসেছে ইউটাহ থেকে।

জন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোন স্টেট থেকে এসেছ?

আমি বললাম, নিউইয়র্ক।

নিউইয়র্ক শুনতেই উচ্ছ্বাসে কাছে এগিয়ে এল ক্রিস্টিনা।

ও বলল, ওহ মাই গড। কতবার যেতে চেয়েছি নিউইয়র্কে! এখনো যাওয়া হয় নি। নিউ ইয়ার’স ইভ- এ টাইমস স্কয়ার- এর অনুষ্ঠানে যাওয়ার খুব ইচ্ছে আমাদের। ভাবছি সামনের বছরই যাব।

আমি বললাম, তোমাদের অসুবিধা না থাকলে নিউইয়র্কে আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারো। ওরা বললো, অবশ্যই গ্রহণ করবো।

দুই
ঠিক বারোটা এক মিনিটে শুরু হলো শো। প্রথমেই ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে উঠল গান। সেলিন ডিওন গাইছেন টাইটানিক ছবির সেই বিখ্যাত গান:

এভরি নাইট
ইন মাই ড্রিম
আই সি ইউ, আই ফিল ইউ
আ্যান্ড দ্যাট ইজ হাউ আই লাভ ইউ…

গানের সঙ্গে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ফোয়ারাগুলো তালে তালে উপরে দুলে দুলে উঠে যাচ্ছে। মাটি থেকে প্রায় দু শ ফিট উপরের উপরে উঠে গেল ফোয়ারাগুলো। ফোয়ারাগুলো হেলেদুলে কখনো ঝুঁকে পড়ছে ডানে, কখনো বা বাঁয়ে আবার কখনো বা ঘুরছে চক্রাকারে। জল দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন অবয়ব। আমার মনে হলো এ যেন্ন শতশস্র রমণীর ব্যালে নৃত্য। আবার কখনো বা অনে হচ্ছে এ যেনো একদল সুন্দরী রমণীর ভরতনাট্যম। অদ্ভুত আর অপরূপ সেই দৃশ্য! সবার চোখ স্থির হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এ যেন স্বররগপুরীর মহোৎসব। স্বর্গের দেবতাদের তুষ্ট করছেন স্বর্গীয় নৃত্যপতীয়সীরা। নানা রঙের, নানা ঢঙে! সেই স্বর্গীয় নৃত্যগীতের মহান মেলায় আমরা যেন ঢুকে পড়েছি অনাহূত বা রবাহূত হয়ে।

একসময় থাকল সেলিন ডিওনের গান। গানের সঙ্গে সঙ্গে ফোয়ারাগুলো নেমে এল পঞ্চাশ-ষাট ফিট উচ্চতায়। ওখানেই ওরা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপ কয়েক মুহুর্ত। ব্যাকগ্রাউন্ডে আবারও বেজে উঠল গান। এবারে ফ্রাংক সিনাত্রা গাইছেনঃ

ফ্লাই মি টু দ্যা মুন
লেট মি প্লে আ্যমাং দ্যা স্টারস!
লেট মি সি হোয়াট স্প্রিং ইজ লাইক
অন এ জুপিটার অর মারস!

ভিন্নতর ভঙ্গিতে আবারও শুরু হলো আলো, জল আর গানের খেলা! কী যে সুন্দর সেই খেলা তা বলে বোঝানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই। পুরো শো’টি ছিল বারো মিটারের। আমার কাছে মনে হয়েছে অনন্তকাল! আওমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। আমরা সবাই যেন থমকে গেছি।

তিন
শো’র শেষে যে যার গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছে। হালকা হয়ে এন ভিড়। আমার পাশেই দাঁড়ানো জন আর ক্রিস্টিনা। জন আমাকে বলল, জানো, প্রতি বছর এই তারিখে এই সময়ে ব্যালাজিও হোটেলের এই ফাউন্টেন শো দেখতে আমরা ভেগাসে আসি। গত চার বছর ধরে আমরা এটা করে আসছি।

আমি বললাম, বিশেষ কোনো কারন আছে নিশ্চয়ই।

আমার কথায় জনের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ও বলল, চার বছর আগে এই রাতে, এই সময়ে, এই জায়গায়, ঠিক এই ফোয়ারাগুলোর সামনেই আমি ক্রিস্টিনাকে বলেছিলাম ক্রিস্টিনা, উইল ইউ মেরি মি?

ছোট্ট একটি মাত্র প্রশ্ন করেছিলাম, অথচ ক্রিস্টিনা এর উত্তর দিয়েছিল তিনবার ইয়েস, ইয়েস এবং ইয়েস বলে। এরপর গত চার বছরে ক্রিস্টিনাকে আমি এটা-সেটা কত প্রশ্ন করেছি। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তরেই ও তিনবার  ইয়েস, ইয়েস এবং ইয়েস বলে নি! কী অদ্ভুত তাই না!

এবারে মুখ খুলল ক্রিস্টিনা। ও বলল, আমরা দুজনে মিলে ঠিক করেছি প্রতি বছর এই সময়ে এই জায়গায় আসব, আসতেই থাকব, আমৃত্যু! একসময়ে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে আসবো!

নিয়নের আলোয় আমি জন ও ক্রিস্টিনার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলাম। ওদের চোখে যা লেখা ছিল, মানুষ তার নাম দিয়েছে- ভালোবাসা। অমল-ধবল ভালোবাসা!

জন ও ক্রিস্টিনাকে বললাম, তোমাদের গল্পটা খুবই রোমান্টিক, আমার মন ছুঁয়ে গেছে! সৃষ্টিকর্তা তোমাদের মনোবাসনা পুর্ণ করুক, এই আমার শুভকামনা। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি নেমে এলাম রাস্তায়।

চার
রাস্তার এপাশটায় আলো একটু কম। দূর থেকে দেখি লাইটপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। কাছে এগোলাম। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছে হিমু! চমকালাম!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, হিমু আপনি, এখানে?

কেন আসতে নেই! লাস ভেগাসের রাস্তায় শুধু আপনি একাই হাঁটবেন, নির্লিপ্ত জবাব হিমুর।

আমি বললাম, না, তা কেন। আপনিও হাঁটবেন, অবশ্যই হাঁটবেন!

কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হিমু, কেমন লাগছে ভেগাসের রাস্তা?

হিমু বলল, আমার কাছে সব রাস্তাই এক। তা সে ঢাকার রাস্তা হোক বা ভেগাসের রাস্তা হোক। ভেগাসের রাস্তায় আলো একটু বেশি, এই যা!

এই দুই রাস্তা বা দুই জনপদের কোন মিল পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করি আমি।

হিমু বলল, এই দুই রাস্তা আর দুই জনপদে পরাজিত মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। ঢাকার রাস্তায় মানুষ পরাজিত দারিদ্র্যের কাছে, আর ভেগাসের রাস্তার মানুষ প্রাচুর্যের কাছে। এই রাস্তায় যে-কোনো লোককে জিজ্ঞেস করুন, ওই একই উত্তর পাবেন।

আমি হিমুকে জন ও ক্রিস্টার গল্পটা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে এও বললাম, জন ও ক্রিস্তিনার সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করছে একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটা আপনাকে করব?

হিমু বলল, উত্তর দিতে পারব কি না জানি না তবে প্রশ্নটা করতে পারেন।

লাইটপোস্টের আল-আঁধারির নিচে দাঁড়িয়ে আমি তাকালাম হিমুর চোখের দিকে।

ওই চোখে চোখ রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হিমু, ভালোবাসা জিনিস্টা আসলে কী?

স্মিতহাস্যে কাঁধ  ঝোলাল হিমু, তারপর নিচুস্বরে বলল, ভালোবাসা মায়া ও কায়া দুই-ই! সৃষ্টির মূলে এই ভালোবাসা। বিগ ব্যাংয়ের কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই। সে এক মহা আলোড়ন। সেই মহা আলোড়ন থেকেই ক্রমশ সম্প্রসারণশোল এই মহাবিশ্বের উদ্ভব। আধুনিক বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন।কিন্তু কেন এই অহা আলোড়ন অথবা এই মহা আলোড়নের আগে কী ছিলো তা বলতে পারছেন না। আসলে এই বিগ ব্যাং বা মহা আলোড়নের আগেও ভালবাসা ছিল। এই ভালোবাসা স্রষ্টার! ভালবেসেই তিনি সৃষ্টি ক্রেছিলেন এই মহা আলোড়ন, মহা বিশ্ব আর অনন্ত লক্ষত্রবীথি! আরও অনেক পরে মানূষ এল। মানুষের মধ্যে তিনিই দিলেন ভালোবাসা নামের অদ্ভুত এক অনুভূতি। যার কণামাত্র ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় পুরোটাই। ভালোবাসা ধ্বংসের, ভালোবাসা সৃষ্টির। ভালোবাসা ধ্বংস করেছে ট্রয় নগরী, আবার এই ভালোবাসা তৈরি করেছে আগ্রার তাজমহল।

কাছেই কোথাও আতশবাজি ফুটছে। তাকালাম! রাতের আকাশে কিছুটা উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিয়ে নিমিষেই আতশবাজিগুলো হারিয়ে গেল অন্ধকারে! আমি চোখ ফেরালাম লাইটপোস্টের নিচে। যেখানে কিছুক্ষ্ণ আগে হিমু দাঁড়িয়ে ছিল, এখন নেই। তাকালাম ডানে, বাঁয়ে, সামনে ও পেছনে১ কোথাও কেউ নেই! বুঝলাম, এ আমারই ভ্রান্তি!

রাত্রির এখন দ্বিপ্রহর! কিন্তু নিয়নের আলোয় প্লাবিত এই শহর এই জনপদ দেখে মনে হয় এই তো সন্ধে হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। দ্বিতীয় ভ্রান্তিতে পড়ার আগেই আমি হাঁটতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.