হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার অসংখ্য পিঠা

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার অসংখ্য পিঠা

আমরা বাঙালিরা বরাবরই উৎসবপ্রিয় ও ভোজনরসিক জাতি। ঋতু বৈচিত্র্যের আমাদের এই বাংলাদেশে সারাবছরই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানারকম উৎসব আয়োজন লেগেই থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ক্রমেই  হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামবাংলার বাহারি পিঠার আয়োজন। অথচ একসময় পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় ছোট-বড় সকলেই পিঠা খাওয়ার আনন্দে মেতে উঠত। কিন্তু এখন তা আর চোখে পড়ে না। এই ব্যস্ত জীবনের কারণে পিঠা তৈরির উৎসব আয়োজন থেকে আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি।  আর আগে শীতকাল এলে এদেশের গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি ঘরে ঘরেও পিঠা বানানোর ব্যস্ততা বেড়ে যেত। বাহারি রকমের পিঠা তৈরির উৎসবে আত্মহারা হতো সর্বস্তরের মানুষ। মনে পড়ে, শীতের এই মৌসুমে আমার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় প্রতি ঘরেই চিতল, দুধচিতল, পুলি, নকশি, পাটিসাপটা, ভাপা,পাখন, তেলে ও গোটা পিঠাসহ হরেক রকমের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন বাড়ির গৃহিণীরা। ছেলেবেলায় চুলার পাশে বসে গরম গরম পিঠা খাওয়ার আনন্দ এখনো আমাকে আবেগ তাড়িত করে তোলে। সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। কালের বিবর্তনে ও মানুষের কর্মচাঞ্চল্যের কারণে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এখন আর আগের মতো পিঠা তৈরির আয়োজন হয় না বললেই চলে। এলাকার মানুষ বাড়িতে পিঠা তৈরির সেই উৎসবমুখর আমেজ হারিয়েছে বহু বছর আগেই। পিঠা বানানোর যাবতীয় আয়োজন করার এত সময় কই ? সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। অবসর সময়ে বাড়ির মহিলারা টিভি সিরিয়াল দেখে কিংবা মোবাইল ফোনে ফেইসবুক ব্রাউজিং করতে বেশি ভালোবাসে।

শীতের মৌসুমে আগে আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেক ধরনের পিঠা বানানো হতো। সারা রাত বসে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করা, ভোরে উঠে বাড়ির মহিলাদের সবাই মিলে বড় আয়োজনে পিঠা তৈরি করার পরিবেশ এখন আর আমাদের চোখে পড়ে না। পিঠা বানানোর সেই আমেজ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। নতুন প্রজন্মকে হারিয়ে যাওয়া পিঠার সাথে পরিচয় করে দিতে রাজধানী ঢাকা শহরের রবীন্দ্র সরোবরে গতবছর শীত মৌসুমে নবান্নের পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক আগ্রহ নিয়ে আমি সেই পিঠা মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। হাতে গোনা মাত্র ১০/১২টি পদের পিঠা মেলাতে স্থান পেয়েছিল। বিষয়টি আমাকে হতাশ করেছে।

শীতের শুরু মানেই ছিল গ্রাম কিংবা শহুরে সব জায়গাতেই ম ম করে ওঠা পিঠার স্বাদ আর ঘ্রাণ। তখন হেমন্তের পাকা ধান কৃষক ঘরে তুলত। অমনি ধুম পড়ে যেত নবান্নের পিঠা বানানোর আয়োজনের। খেজুরের রস, গুড়, চালের গুঁড়ার মিশ্রণের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত বাড়িজুড়ে ।

এখন সবাই পিঠা বাজার থেকে কিনে এনে খায়। এতে কোনো আনন্দ-উৎসাহ থাকে না। হাতে গোনা মাত্র কয়েক পদের পিঠা ছাড়া বাজারে অঞ্চলভিত্তিক রকমারি পিঠাগুলো টাকা দিয়েও কিনতে পাওয়া যায় না।

গ্রামের গৃহিণীদের মধ্যে আগের মতো পিঠা বানানোর উৎসাহ নেই। হরেক রকমের পিঠার সাথে আমাদের নতুন প্রজন্ম একেবারেই পরিচিত নয়। তাই পিঠা বানানোর আনন্দ-আয়োজন এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে সত্তরের দশকে জন্ম নেওয়া আমাদের প্রজন্মের অনেকের কাছে।

সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক পুরাতন অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান নাগরিক জীবনে এখন আর সেই উৎসব আমেজ নেই। কৃষকের ঘরে হেমন্তের পাকা ধান ওঠে। কিন্তু হয় না সেই পিঠার আয়োজন। পাড়ায় পাড়ায় খুঁজেও পাওয়া যাবে না গাছিদের। পরিবেশ দূষণ ও নিপা ভাইরাসের ভয়ে মানুষ এখন খেজুরের রস খেতে ভয় পায়। অথচ খেজুরের রসের সাথে এদেশের পিঠাপুলির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে খেজুরের গাছের দেখা মিলত। পুরোনো সেই বাড়িগুলো ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। কেটে ফেলা হয়েছে খেজুর গাছসহ অন্য সকল আম, জাম, নারিকেল গাছগুলো। খেজুরের রসের হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া এখন দুষ্কর ব্যাপার। কাঁচা খেজুরের রসের অভাবে মানুষ পিঠা তৈরির আয়োজন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবেই অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি পিঠা তৈরির উৎসব।

ধারণা করা হয়, এ দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলো—চিতোই পিঠা, পাকানো পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, পক্কন পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ভাত পিঠা, কাটা পিঠা, নকশি পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা, গড়গড়া পিঠা, ম্যারা পিঠা, মুঠা পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, চাছি পিঠা, সাগুদানা, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, জামদানি পিঠা, হাদি পিঠা, পাটা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলেভাজা পিঠা, ঝুরি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, চষি পিঠা, খান্দেশা, গোলাপফুল পিঠা, পাতা পিঠা, সবুজ পিঠা, কেক পিঠা, গুলগুলা, ফুলকুচি, সেওই পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষিরডুবি, খাস্তা পিঠা, পেঁপের সন্দেশ, কড়ি পিঠা, সি রিনচ পিঠা, ঝিকমিক পিঠা, পয়সা পিঠা, সংসার পিঠা, শিঙাড়া পিঠা, বিবিখানা পিঠা, চান্দ পাকোড়া, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, পাকোন পিঠা, সাজ পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, কাটা পিঠা, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।

নিম্নে আমাদের দেশের কয়েকটি জনপ্রিয় পিঠার বিবরণ দেওয়া হলো :

নবান্ন উৎসবের একটি জনপ্রিয় পিঠা হলো কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা। দুই কাপ চালের গুঁড়ার সঙ্গে ১/৪ কাপ ময়দার মিশ্রণে মণ্ড তৈরি করা হয়। এরপর ভাগ করে নিয়ে হাতের তালুর সাহায্যে লম্বা সরু লতার মতো করে বেলে নিতে হয়। এরপর এক হাতে ধরে অন্য হাতের তালু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি অন্তর কাটা হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার শুধু চালের গুঁড়ার মণ্ড দিয়েই পিঠাটি তৈরি হয়। এই পিঠা কাটার কৌশল সবাই রপ্ত করতে পারে না। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরাই সেমাই পিঠা তৈরিতে বেশি পারদর্শী। সেমাই বানানোর পর এই পিঠা খেজুরের গুড়, দুধ ও নারিকেল দিয়ে রান্না করা হয়। আবার অনেকে কড়া রোদে শুকিয়ে সেমাই পিঠা বয়ামে তুলেও সংরক্ষণ করতেন।

দুধ পুলি হলো একটি জনপ্রিয় বাংলাদেশি এবং ভারতীয় পিঠা, যা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পুলি ও নারকেল-গুড়ের পুর দিয়ে তৈরি হয় এবং দুধের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন করা হয়। শীতকালে এই পিঠা তৈরি করা হয় এবং এটি সাধারণত তৈরি হয় খেজুরের গুড় ও নারকেল দিয়ে।

গোকুল পিঠা এখন অনেকের কাছেই অপরিচিত। মধ্যযুগ থেকে এই দেশের নানান অঞ্চলে বেশ প্রচলিত ছিল এই পিঠা। চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড়, নারিকেলের কোরা দিয়ে বানানো পুর দিয়ে তৈরি হতো। এই পিঠার অন্যতম উপকরণ ছিল এলাচ। পুরের সঙ্গে এলাচের মিশ্রণটি খুব ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া হতো। চালের গুঁড়ার ডো বানিয়ে এর মধ্যে পুরটি ভরে নেওয়া হতো। এরপর তেলে ভেজে রসে অথবা দুধে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পরিবেশন করা হতো গোকুল পিঠা।

ক্ষিরমোহন পিঠা তৈরি হতো দুধছানা, চিনির সংমিশ্রণে। পিঠাটি খেতে দারুণ মিষ্টি। সাধারণত বিয়ে, জন্মদিনের মতো উৎসবে অতিথি অ্যাাপায়নে এই পিঠার বেশ কদর ছিল।

গুজা পিঠা, যা খাজা পিঠাও নামে পরিচিত, একটি জনপ্রিয় মিষ্টি নাস্তা যা বাইরে খাস্তা এবং ভেতরে নরম থাকে। এটি ময়দা, চিনি এবং সাধারণত মুচমুচে রসালো উপাদানে তৈরি করা হয়। গুজা পিঠা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পিঠার একটি অংশ এবং এটি মোগল আমল থেকেই বাংলায় প্রচলিত।

গাজীপুর, নরসিংদী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে জামদানি পিঠার কদর ছিল কয়েক বছর আগেও। চালের গুঁড়ার কাই বানিয়ে সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে কলাপাতার ওপর চলত নানান নকশা। কড়া রোদে কয়েক দিন শুকিয়ে তবেই তা ঘরে তোলা হতো। খাওয়ার আগে মুচমুচে করে ভেজে এর ওপর চিনি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। জামদানি পিঠাকে অনেকে নকশী পিঠা বলে থাকেন। সুন্দর কারুকার্যময় এই পিঠাগুলো দেখলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই অবাক হয়ে যায়। গরম তেলে ভাজা নরম মচমচে এই জামদানি পিঠাগুলোর ওপরে খেজুরের ঝোলা গুড় ছিটিয়ে খেতে হয়। আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে একসময় এই জামদানি পিঠা তৈরির প্রচলন ছিল।

গোলাপ ফুলের মতো দেখতে হওয়ায় একটি পিঠার নাম ছিল গোলাপ পিঠা। চালের গুঁড়া দিয়ে রুটি বানিয়ে কেটে কেটে তৈরি করা হতো এটি। বানিয়ে তেলে ভেজে নিতে হতো প্রথমে। এরপর চিনির সিরা তৈরি করে পিঠাটিকে কিছুক্ষণ চুবিয়ে পরিবেশন করা হতো।

ম্যারা পিঠা আর চেপা শুঁটকির ভর্তা বৃহত্তর ময়মনসিংহের খুবই জনপ্রিয় খাবার। প্রায়ই এই অঞ্চলের মানুষগুলোর শীতের সকাল হয় গোশতের ঝোলের সঙ্গে কুড়মুড়ে ম্যারা পিঠা দিয়ে। একেক স্থানে একেকভাবে খাওয়া যায় এই পিঠা। বানানোও খুব সোজা। তাই নিয়মিতই এই পিঠা তৈরি হতো। অনেক অঞ্চলে এটি মুঠি পিঠাও বলে পরিচিত।

চন্দ্রপুলি আবহমান গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা। শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও প্রায় সবাই এই পিঠা বানিয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও এ পিঠা খুবই জনপ্রিয়। শুকনো কিংবা দুধ বা রসে ভেজানো—নানাভাবেই এ পিঠা খেতে ভালো লাগে। চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠার কাইয়ের ভেতরে নারকেল, দুধ ও চিনি বা গুঁড়ের মিশ্রণের পুর থাকে। দেখতে অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই পিঠা বানানো বেশ সময় সাপেক্ষ। ফলে জনপ্রিয়তা থাকলেও এই পিঠা অনেকটাই এখন অবহেলিত।

ভাদ্র মাস হলো তাল পাকার মাস। এই মৌসুমে বাঙালির ঘরে ঘরে পাকা তালের পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। পাকা তালের রস, চালের গুঁড়া, চিনি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তেলে ভাজা সুস্বাদু তালের পিঠা আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয় একটি খাবার। তা ছাড়া পাকা তালের রস দিয়ে আমাদের গ্রামদেশে রকমারি পিঠা ও সুস্বাদু পায়েস বানানোর প্রচলন রয়েছে।

পাটিসাপটা পিঠার ইতিহাস প্রাচীন বাংলার লোকজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে জড়িত, যেখানে এই পিঠাটি শীতকালের একটি জনপ্রিয় মিষ্টি খাবার হিসেবে পরিচিত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সাহিত্য ও লোকগাথায় এর পরিচিতি রয়েছে। পাটিসাপটা মূলত চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি একটি পাতলা ক্রেপ বা রুটি, যা ক্ষির, গুড় বা নারকেলের পুর দিয়ে তৈরি হয়।

ভাপা পিঠা ও চিতোই পিঠার জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। শীতের মৌসুমে এদেশের শহর বন্দর ও গ্রামের রাস্তার পাশে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করতে দেখা যায়। আমি নিজেও শখ করে এই পিঠাগুলো রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে কিনে খাই অথবা বাসায় নিয়ে আসি।  আবার কোড়ানো নারিকেল ও খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা খেতে অনেক ভালো লাগে। দুধ দিয়ে তৈরি রসালো চিতোই পিঠা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। কোড়ানো নারিকেল ও চিনির মিশ্রণ দিয়ে তৈরি ছিটা পিঠা খেতে অনেক সুস্বাদু লাগে। 

আমাদের দেশে অঞ্চল ভেদে পিঠার ভিন্নতা রয়েছে। এই সকল পিঠার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও আলাদা বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হলো বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। চট্টগ্রামে কলা, নারিকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে পিঠা তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এ পিঠার নাম আতিক্কা পিঠা। আবার বিন্নি চালের গুঁড়ার সঙ্গে নারিকেল ও গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিন্নি পুলি, যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত হাফাইন্না পিঠা বা গোইজ্জা পিঠা নামে।

শরীয়তপুর বিখ্যাত বিবিখান পিঠার জন্য। জামালপুরের রোট পিঠা বা ওট পিঠা তৈরি হয় রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ সব মিশিয়ে। মাটির কলসিতে মিশ্রণটি ঢেলে চুলার আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় বিচিত্র পিঠাটি।

সিলেটের গ্রামাঞ্চলের একটি পিঠা হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা। বাঁশের মধ্যে কলাপাতা দিয়ে তার মধ্যে ভেজানো বিন্নি চাল (সিলেটি ভাষায় বিরণ চাল) ভরে খের (খড়) দিয়ে মুখ আটকে চুলায় পোড়াতে হয়।

এছাড়া সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠা হাত সেমাই পিঠা। সেমাই কাটার মেশিনে চালের গুঁড়ার মণ্ড দিয়ে চিকন চিকন সেমাই কাটা হয়। তারপর ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হতো। এমন এইসব বাহারি পিঠা আজ নেই বললেই চলে। অঞ্চলভিত্তিক পিঠার চলও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

একটা সময় ছিল যখন বাহারি স্বাদের পিঠা ছাড়া গ্রামবাংলার মানুষ বিয়ে, উৎসবের কথা চিন্তা করতে পারত না। এখন সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে বিদেশি খাবার। অথচ বাঙালি কত শত রকমের পিঠা যে তৈরি করত, তার তালিকাকরা আজও সম্ভব হয় নি। ধারণা করা হয়, এ দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হতো। এদেশের বাহারি পিঠা আমাদের লোকজ খাদ্য সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নতুন প্রজন্মের অনেকেই গ্রামবাংলার অসংখ্য পিঠার সাথে পরিচিত নয়। হারিয়ে যাওয়া সেই পিঠাপুলির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সমাজের সচেতন মহলকে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.