অনেক বেশি এগিয়ে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত চর্চা: কামাল আহমেদ

অনেক বেশি এগিয়ে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত চর্চা: কামাল আহমেদ

ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর টান। ছাত্র অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। ছায়ানট থেকে লাভ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। রবীন্দ্রসংগীতে নিবেদিতপ্রাণ। তিনি কামাল আহমেদ।

আধুনিক, দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত, ভাষার গানসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও বহু গান করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনটি অ্যালবাম আছে তাঁর। এ এক অনন্য উদাহরণ। প্রথিতযশা তিন কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও নির্মলেন্দু গুণের তিনটি বিখ্যাত কবিতাও গান হয়ে বেজেছে তাঁর কণ্ঠে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কিশোর কুমারের গান নতুন করে গেয়েছেন দুটি অ্যালবামে। দেশ-বিদেশের বহু জায়গায় তিনি সংগীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের প্রশংসা লাভ করেছেন। নানা ধরনের ২৮টি অ্যালবাম রয়েছে তাঁর। সংগীতে তাৎপর্যপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ৯টি পদক। পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ২০২৩’। বাংলাদেশ বেতারের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে তিনি নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র ‘ধ্বনির অগ্রপথিক’। তাঁর আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র হলো ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’। ‘মিউজিক অব বেঙ্গল’ নামে তাঁর একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ বেতারের উপ-মহাপরিচালক।

কামাল আহমেদ। সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল অন্যদিন। নানা প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোমিন রহমান। এই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো। গ্রন্থনায় শিলা আক্তার মৌ।

মোমিন রহমান: আপনার জন্ম তো পাবনায়। আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন। শৈশব-কৈশোরে কোন দিকে আপনার ঝোঁক ছিল?

কামাল আহমেদ: বাঙালির আদিকালে পরিবারের যে চেহারা ছিল ঠিক সে রকমই ছিল আমাদের পরিবার। আমরা ছয় ভাই তিন বোন একেবারে অকৃত্রিম পরিবেশে বেড়ে উঠি। সেখানে কোনো নগরায়ন ছিল না। আমার বাবা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। সুতরাং ধর্মের নিয়মনীতি মেনেই আমাদের জীবন চলত। কিন্তু সুর, সংগীত আমার ভেতরে ছিল। গুরুর কাছে শিক্ষা নিয়ে শুধু সেটাকে শাণিত করা হয় এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। লেখাপড়ায় ছোটবেলা থেকেই আমি ভালো ছিলাম। সব সময় ক্লাসে প্রথম হতাম। আর সংগীত আমাকে টানত। আমার পড়াশোনার সাথি ছিল ছোট্ট একটি রেডিও। রেডিওটি আমি চালু করেই পড়তে বসতাম। এটাই ছিল আমার অভ্যাস। এবং অনেক সময় দেখা গেছে, বিশেষ করে ম্যাথ যখন করতাম, তখন অনেক জোরে সাউন্ড দিয়ে আমি রেডিও শুনতাম। গানই বেশি শুনতাম। রাজশাহী রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠান টিউন করে শুনতাম। কলকাতার আকাশবাণী শুনতাম। আর আকাশবাণী রেডিও শোনার মাধ্যমেই সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমারকে চিনেছি। তাঁদের গান  আমি একদম কিশোর বয়স থেকেই ধারণ করেছি।

মোমিন রহমান: আপনার ভাইবোনদের মধ্যে কারও কি শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল?

কামাল আহমেদ: সেটা ছিল, কমবেশি সবার মধ্যে ছিল। তবে আমি তো এই জায়গায় ফাইটার ছিলাম। বাবা যেহেতু এসব পছন্দ করতেন না সেহেতু পরিবার থেকে কখনো অনুপ্ররণা পাই নি। কিন্তু আমি আমার ভালোলাগার জায়গায় অটল ছিলাম। আমি ক্লাস এইটে স্কলারশিপ পাই। সেই টাকা দিয়ে আমি একটা হারমোনিয়াম কিনি। কিন্তু সেটি আমি বাসায় আনতে পারি নি। অন্যের বাসায় রেখেছিলাম। আমার মনে জেদ ছিল, যে করেই হোক গান আমি শিখবই।

মোমিন রহমান: সারগাম শিখলেন কোথা থেকে?

কামাল আহমেদ: আমি একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছায়ানটে ভর্তি হই। ছায়ানট থেকেই আমার পদ্ধতিগতভাবে গান শেখা শুরু। কিন্তু স্কুলের গানের প্রতিযোগিতায় অন্যরা হারমোনিয়াম বাজিয়েছে এবং সাথে আমি গান গেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সে এক আনন্দের স্মৃতি!

মোমিন রহমান: ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুনের কথা বলুন।

কামাল আহমেদ: ১৯৮২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, একই সাথে ছায়ানটে ভর্তি হলাম। ছায়ানটে ভর্তি হওয়ার পর যেটাকে গ্রুমিং বলে, ছায়ানট তো শুধু গান শেখায় না, একজন বাঙালি ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সেই বিষয়বস্তুগুলো ছাত্রদের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। আমি খুবই সৌভাগ্যবান, প্রথম বর্ষেই রবীন্দ্রনাথের গানের তালিম পেয়েছি। আমাদের দেশের শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতচর্চার যিনি পথিকৃৎ, সেই ওয়াহিদুল হককে পেয়েছি। তিনি শিখিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রনাথকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা চাওয়া-পাওয়া সবকিছুই আমাদের ভেতরে তিনি প্রোথিত করার চেষ্টা করেছেন। ঠিক তখনই আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার কমফোর্ট জোন, আমার আসল জায়গা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। 

মোমিন রহমান: রবীন্দ্রসংগীতের কিছু গান আছে যেখানে পূজা, প্রেম মিলেমিশে একাকার। তো রবীন্দ্রনাথের কোন ধরণের গান আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করে?

কামাল আহমেদ: রবীন্দ্রনাথের যে গানের বিভাজন পূজা, প্রকৃতি, প্রেম। তাঁর পূজার গান কখনো মনে হয় প্রেমের গান, আবার প্রেমের গানকে মনে হয় পূজার গান। কারণ রবীন্দ্রনাথ পূজার গানকে ওইরকম নান্দনিকভাবে দেখেছেন। প্রেমের আসনটা অনেক উপরে দিয়েছেন। সেই প্রেম আবার ভক্তির সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে। যেখানে ভক্তি নেই সেখানে তো প্রেম থাকবে না। আমি যাকে ভালোবাসব তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথে প্রেম অন্যরকম। এ কথা বলা কিন্তু একেবারে কঠিন যে আমি পূজার গান পছন্দ করি না, প্রেমের গান পছন্দ করি। তবে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গান আমাকে অনেক বেশি টানে। কারণ রবীন্দ্রনাথের এ ধরনের গানের ভেতর নিজেকে বিলিয়ে ও মিলিয়ে দেওয়া যায়। সেখানে যে প্রশান্তি সেটা কিন্তু অকৃএিম। প্রকৃতি আপনাকে কখনো নিরাশ করবে না। আপনার প্রেমের জায়গায় আপনি প্রেয়সীর কাছে প্রত্যাশিত প্রেম নাও পেতে পারেন। ঈশ্বরকেও যেভাবে ভালোবাসলেন সেভাবে না পেতে পারেন। কিন্তু আপনি প্রকৃতির কাছে যখনই যাবেন, যেভাবেই চাইবেন, প্রকৃতি সেভাবেই আপনার ডাকে সাড়া দিবে। সুতরাং সেই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির গান আমাকে বেশি টানে।

মোমিন রহমান: সংগীতের ক্ষেত্রে আপনি কোন ঘরানার?

কামাল আহমেদ: আসলে সময় তো অনেক পেরিয়েছে। আমি রবীন্দ্রনাথের সকল গান শুনেছি। এর বাইরেও আমি নানা জনের গান শুনি। সকলেরই একটা ঘরানা আছে। যেটাকে বলে নিজস্ব স্বত্তা। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে আলাদা। আমি যেহেতু ছায়ানটের ছাত্র, আমি ছায়ানট থেকে শিখেছি। আর আমি সংগীতকে নিজের মতো করে গ্রহণ করেছি। আমি কাউকে অনুসরণ করি না। রবীন্দ্রনাথের গান বাণীপ্রধান গান। আমি সেই বাণী বোঝার চেষ্টা করি। তারপর আমি তাঁর সুরকে হুবহু রেখে আমার আবেগ দিয়ে আমার মতো গাইবার চেষ্টা করি। তবে গানের ক্ষেত্রে আমাকে সব সময় চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রভাবিত করে।

মোমিন রহমান: প্রচলিত একটা কথা আছে, রবীন্দ্রসংগীতে একজন শিল্পীর কোনো স্বাধীনতা নেই। এটা কতটুকু সত্য?

কামাল আহমেদ: এ কথা ঠিক না। কারণ আপনি যদি একটা নোটেশনের গান পাঁচজন শিল্পীর কণ্ঠ থেকে শোনেন, সেটা পাঁচ রকম হবে। কোনটার সাথে কোনটা মিলবে না। সুর এক থাকলেও সংগীতে পারফেকশন বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সুর প্রক্ষেপণ আলাদা হবে। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত শিখতে হবে। না শিখে কেউ গাইতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের বাণীটা যেমন পড়তে হবে ঠিক তেমনি বুঝতে হবে। যদি বাণীর বাইরেই চলে যাই, তাহলে তো সেটা রবীন্দ্রসংগীত থাকবে না।

এখানে শিখতে হবে, জানতে হবে, তারপর গাইতে হবে। এটাকে অনেকে বলে, আমার হাতটা বেঁধে দিল। স্বাধীনতা মানে এই নয় যে স্বেচ্ছাচারিতা। অবশ্যই স্বাধীনতা আছে। শিল্পী তার মতো গাইবে। তবে তাকে জেনে শুনে বুঝে গাইতে হবে।

মোমিন রহমান: রবীন্দ্রসংগীত নিজের মতো গাওয়া বা নানা যন্ত্র ব্যবহার করে নিজের মতো সুর করার প্রয়াসকে আপনি কীভাবে দেখেন?

কামাল আহমেদ: রবীন্দ্রনাথের গানকে রবীন্দ্রনাথের চেহারায়ই রাখতে হবে। আমি যদি কোনো গানকে নিয়ে নিরীক্ষা বা ফিউশন করতে চাই, তাহলে সেটা আমিই সৃষ্টি করি না কেন? সেখানে তো আমার হাত-পা কেউ বেঁধে দেয় নি বা দিবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান করতে হলে অবশ্যই নিয়মকানুন মানতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান ডিফাইন করে গেছেন, আকৃতি দিয়ে গেছেন। তিনি বাণী লিখেছেন, সুর করেছেন, নোটেশন করেছেন, পাবলিকেশন করে গেছেন। সুতরাং সেখানে আপনার ইচ্ছার কোনো সুযোগ নাই। আপনাকে ওই স্ট্যাকচারের মধ্যে থেকেই গান গাইতে হবে। কারণ এসবের বাইরে গেলে এটাকে ভুল হিসেবেই ধরা হবে। কেউ যদি অপচেষ্টা করে, তাহলে সেটার অস্তিত্ব বেশিদিন টিকবে না।

মোমিন রহমান: বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা কেমন হচ্ছে?

কামাল আহমেদ: আমি মনে করি কলকাতার থেকেও অনেক বেশি এগিয়ে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত চর্চা। কারণ কলকাতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রভারতীতে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা হয় বা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু সামাজিকভাবে সাংগঠনিকভাবে সেটি আমাদের দেশে বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশে যারা আছেন তারা রবীন্দ্রসংগীত চর্চা যেভাবে বিস্তৃত করেছেন, চর্চা করছেন, তা প্রশংসনীয়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আছেন ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, সংগীত ভবন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীত শেখানো হচ্ছে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চার ব্যাপ্তি বাংলাদেশে বেশি।

রবীন্দ্রসংগীতের যে বোধ ও চাওয়া-পাওয়া তা আমরা নিজেদের মধ্যে বেশি ধারণ করেছি। অনেকে বলতে পারে যে আশানুরূপ রবীন্দ্রসংগীতচর্চা তারা দেখছেন না। এই প্রসঙ্গে আমি বলব, ভালো জিনিসের সংখ্যা তো কম হয়। এছাড়া রবীন্দ্রসংগীতের একটা নিজস্ব গুণাবলি আছে। আপনি অন্য সব সংগীতে যেমন অহরহ শিল্পী পাবেন কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে তেমন পাবেন না। এটি শিখতে হয়, জানতে হয়, চর্চা করতে হয়। তাহলেই নিজের ভেতরে সেটা ধারণ করতে পারবেন।

মোমিন রহমান: আপনি নিজেও তো নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন? এই বিষয়ে বলুন।

কামাল আহমেদ: আমি আজীবনই সংগঠক হিসেবে কাজ করেছি। আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য কাজ করেছি। আমি যেহেতু সরকারি চাকরি করি সেহেতু কোনো প্রতিষ্ঠান করতে পারি নি। কিন্তু সংগঠনের জায়গা থেকে কাজ করে গেছি এবং করে যাব। কাজ করেছি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাথে। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ ছিলেন ওয়াহিদুল হক। তিনি বিরামহীন কাজ করে গেছেন। নিরলস ছুটে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। করিয়েছেন ওয়ার্কশপ। প্রোথিত করে গেছেন মানুষের মধ্যে সংস্কৃতির বোধ। সবাইকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা তাঁর থেকে শিখেছি অনেক কিছু।

মোমিন রহমান: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ডাকসুর সাথে জড়িত ছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে বলবেন কি?

কামাল রহমান: আজকের যে কামাল আহমেদকে দেখছেন তার পেছনে দুটি বিষয় ক্রিয়াশীল। এক ছায়ানট, দুই রবীন্দ্রনাথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন তথা ডাকসু থেকে একজন বাঙালী হিসেবে আমার গড়ে উঠা। এই সংগঠন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গাগুলো ও আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকার প্রতি সচেতন হতে শিখিয়েছে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি, পুরো সময়টাই নানা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ে কাজ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় গণআন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। ছোট ছিলাম তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু করতে পারি নি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দশটি বছর ছিলাম সেই সময় কাজ করে গেছি নিরলস। আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দল। আমার চেতনার জায়গা শাণিত করেছে ডাকসু। ডাকসুর হয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছি আমরা। ডাকসুর হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম, সেটি ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রথমেই বলেছি সাংস্কৃতিক চর্চায় আমরা তাদের থেকে এগিয়ে। আমাদের নিজস্ব কিছু আন্দোলন আছে, যা আমাদের অহংকারের জায়গা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আছে, ভাষা আন্দোলন আছে। এ নিয়ে আছে নানা সৃষ্টি ও শিল্পকর্ম। যা অন্য দেশ বা জাতির নেই। এ কারণেই সাংস্কৃতিকভাবে আমরা অনেক এগিয়ে।

মোমিন রহমান: শহীদুল্লাহ হলে একবার আপনি বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এই বিষয়ে কিছু বলুন।

কামাল আহমেদ: পড়াশুনায় ভালো থাকা সত্ত্বেও আমার আগ্রহ ছিল শিল্প-সংস্কৃতিতে। এবং এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। সংগীতচর্চা করেছি, সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলাম, তাই সংগঠনের হয়ে কাজ করেছি। বিজয়ী হয়েছিলাম, সেই জায়গায় কাজ করেছি এবং কাজ করার চেষ্টা করেছি। শহীদুল্লাহ হলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার সুবাদে হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সাথে কাজ করেছি। এটি ছিল আমার জীবনের ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

মোমিন রহমান: ক্যাডার হওয়ার ক্যাটাগরিতে তো আপনি অন্য কোনো সেক্টরও চয়েজ করতে পারতেন, তাহলে কেন তথ্য সম্প্রচারে নিযুক্ত হলেন?

কামাল আহমেদ: আমি বাঙালি সংস্কৃতিতে নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি সব সময়। সুতরাং আমার ক্যাডার ক্যাটাগরিতে আমি পছন্দ করেছি তথ্য। কারণ আমি মনে করি আমি এই জায়গায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নিজেকে মেলে ধরতে পারব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেবাটা করতে পারব। নিজেকে নিয়োজিত করতে পারব। এর মাধ্যমে অনেক গুণীজনদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁদের থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আমার নিজের ভাবনার জায়গাটাকে ঋদ্ধ এবং এ ক্ষেত্রে সেবা দেওয়ার জন্য আমি এখানে নিযুক্ত হয়েছিলাম। এ ছাড়া আমি টেলিভিশনেও কাজ করেছি।

মোমিন রহমান: তিন কবির গান আপনি গেয়েছেন এবং একজন রবীন্দ্রসংগীতের মানুষ হিসেবে তাঁদের গান সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

কামাল আহমেদ: রবীন্দ্রনাথের গান এবং তিন কবির গানের বাণী ও সুরে অনেক মিল রয়েছে। আমার রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করতে ভালো লাগে। ভালো না লাগলে তো কেউ চর্চা করবে না। আগেই বলেছি ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে কাছের ছিল ছোট্ট রেডিও সেট। তারই মাধ্যমে সেই সময় রেডিও থেকে অনেক গুণীজনদের চিনেছি। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তাঁদের গান শুনেছি, আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। 

মোমিন রহমান: আপনি ভাষার গানও গেয়েছেন। গেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু গান। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাইছি।

কামাল আহমেদ: কমিটমেন্টের জায়গা থেকে আমি ভাষার গান করেছি। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমার গান নিবেদন করেছি। যে মানুষটি না থাকলে আমরা লাল-সবুজের পতাকা পেতাম না, পেতাম না স্বাধীনতা, সেই মানুষটিকে নিয়ে কোনো শিল্পী একক অ্যালবাম তৈরি করেন নি কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি। জাতির পিতাকে নিয়ে আমার করা গান ও অ্যালবামটি একই সাথে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে প্রকাশিত হয়।

মোমিন রহমান: বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর নিয়ে তৈরি আপনার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু বলুন।

কামাল আহমেদ: এ দেশে বেতার কীভাবে শুরু হলো, বেতারের এগিয়ে চলা, বাংলাদেশে বেতারের অবদান— সবকিছু তুলে ধরা হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল অর্জন এখানে আছে। বেতারের সাধারণ শিল্পী কলাকুশলী ও এদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

মোমিন রহমান: মানুষের সম্পদের যেমন উত্তরাধিকার থাকে তেমনি শিল্পের প্রতি আপনার যে ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার উত্তরাধিকার কি আপনার সন্তান বা অন্য কেউ অর্জন করতে পেরেছে?

কামাল আহমেদ: আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় নি। আমার সন্তানেরা একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করে। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে সেই শিল্পচর্চা গড়ে ওঠে নি। অবশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কাজ করি। আমার যে বোধের জায়গা তা অন্যদের মধ্যে শাণিত করার চেষ্টা করি। তবে ওই রকমভাবে কাউকে পাঠদান করানোর সুযোগ হয়ে ওঠে নি। কিন্তু আমার স্বপ্ন আছে, যখন অবসরে যাব, তখন এ দেশের তরুণ-তরুণীদের গান শেখানোর চেষ্টা করব।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.