বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় জাতের ধান

বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় জাতের ধান

আমাদের এই বাংলাদেশ মূলত কৃষি প্রধান দেশ। ভাত আমাদের বাঙালিদের প্রধান খাদ্য। সঙ্গত কারণেই ধান আমাদের মূল কৃষি পণ্য। ১৯৭১ সালে এদেশের মোট জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে সাত কোটি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এদেশের জনসংখ্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটির মতো। কাজেই বিশাল এই জনগোষ্ঠীর অন্ন চাহিদা মেটাতে কৃষকদের এদেশে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে বহু গুণ। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধান উৎপাদনের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। দ্রুত নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে প্রতি বছর বর্তমানে আমরা আমাদের মোট কৃষি ভূমির ১% জমি হারাচ্ছি। বিগত ৫৪ বছরে এপর্যন্ত মোট কৃষি ভূমির ৩০ শতাংশ জমি হারিয়েছি। দ্রুত কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে খাদ্য উৎপাদনের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এদেশের কৃষকদের এদেশীয় ধান চাষের পরিবর্তে বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড ধান উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়তে হয়েছে।

বহুডজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের দাপটের কারণে আমাদের দেশীয় প্রজাতির ধান ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমার গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে। আমার মরহুম পিতামহ ছিলেন একজন জোতদার। প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। কৃষি জমি থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের ভরণপোষণ করেছেন। আমার বাবা-চাচাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সত্তর দশক পর্যন্ত আমাদের কৃষি জমিতে এদেশীয় আউশ, আমন ও বোরো ধানের আবাদ হতো ব্যাপকভাবে। ছোটোবেলা থেকেই সারা বছর আমাদের গ্রামের বাড়িতে বোরো ধানের ভাত খাওয়ার প্রচলন দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বোরো ধানের ভাত খেতে বেশি পছন্দ করতাম। এখন আর সেই দেশি প্রজাতির বোরো ধান আমাদের ফসলের মাঠে উৎপাদিত হয় না। ময়মনসিংহের লাল রঙের ঢেঁকি ছাটা বিরই চালের ভাতের কথা আমি এখনো ভুলতে পারি নাই। বর্তমানে বাজারে যে বিরই চাল পাওয়া যায় ওগুলো আসল কি নকল জানি না। আমার সব সময় পছন্দ দেশীয় জাতের ঢেঁকি ছাটা লাল মোটা চাউলের ভাত। আজকাল বাজারে আমার পছন্দের সেই ঢেঁকি ছাটা চালগুলো খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশ কয়েকদিন আগে রাজধানী ঢাকা শহরের একটি বড় চাউলের মার্কেটে গিয়ে খোঁজ করে কোথাও দেশীয় জাতের ঢেঁকি ছাটা চাউল কিনতে পারি নাই। আগেকার দিনের সেই ঢেঁকি ছাটা চাউল পেতে হলে আমাদের যেতে হবে বড় সুপার সপগুলোতে। ওরা কৃষকদের কাছ থেকে চড়া দামে অর্ডার দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় ধান সংগ্রহ করে শৌখিন ক্রেতাদের কাছে এই ধরনের সুস্বাদু চাউল বিক্রি করে থাকে। আমি কিছুদিন আগে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১১০ টাকা কেজি দরে ঢাকার একটি সুপারশপ থেকে সখ করে হরিদিয়া গনজিয়া লাল রঙের চাউল কিনে খেয়েছিলাম। ভর্তা, ভাজি ও ইলিশ মাছ দিয়ে এই চাউলের ভাত খেতে অনেক সুস্বাদু লাগে। দুঃখের বিষয়, হাইব্রিড ধানের ব্যাপকতার ভিড়ে দেশীয় জাতের চাউল আমাদের দেশ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ১০ হাজার জাতের দেশীয় ধান হারিয়ে গেছে। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলাদেশে প্রায় ১৮ হাজার জাতের দেশীয় ধান ছিল।

পঙ্খিরাজ, গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাইবালাম, রূপকথা, রাঁধুনীপাগল কিংবা পাঙাশ- বিচিত্র এসব নাম শুনলে এখন বোঝাই যায় না যে এগুলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার দেশীয় জাতের ধানের নাম। আবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বয়স্ক কৃষকরা অনেকে শুধু মনেই করতে পারেন যে লক্ষèীজটা, রানি সেলুট, ঝুমুর বালাম কিংবা হিজলদীঘি ও রাজা মোড়ল যেগুলো এখন আর নেই।

লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে শুধু গেল পাঁচ বছরের ব্যবধানে মুড়ি, চিড়া, খই, পোলাও, বিরিয়ানি আর ফিরনি পায়েস তৈরির অন্তত ২০ জাতের বাহারি দেশি ধান পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লক্ষ্মীপুর জেলার স্থানীয় পর্যায়ের কৃষক, কৃষি ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

চর মনসা গ্রামের কৃষক মো. ইসমাইল জানান, আউশের মৌসুমে গ্রামের প্রায় কৃষক কমবেশি হলিধান চাষ করত। মিষ্টি চিড়া তৈরির জন্য বিখ্যাত হলিধানে কেউ চাল তৈরি করে ভাত খেত না। গত পাঁচ বছর থেকে পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে মিষ্টি এ ধান।

সৈয়দ আহমেদ জানান, উপকূলীয় এ লক্ষ্মীপুর জেলায় খই তৈরির জন্য সুপরিচিত ছিল লোহাচূড়া নামের ধান। খুবই বড় বড় কালো রঙের এ ধান এখন আর নেই। ফলে এখন কেউ খই চেনে না।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় ধান চাষ হয়। ভাতের ধান ছাড়াও মুড়ির জন্য গিগজ ধান, ভূসিহারা, চিড়ার জন্য হলিধান, খইয়ের জন্য লোহাচূড়া এবং পোলাওর জন্য কালোজিরা আর শাক্কর খোরা ধানের চাষ হতো। এখন বৈচিত্র্যময় এসব ধানের চাষ হয় না। এসব ধানের বীজও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪০-৫০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ বছর আগেও লক্ষ্মীপুর প্রচুর আউশ চাষ হতো। এখন কমে গেছে। আউশ আর আমনে অন্তত পঞ্চাশ জাতের দেশি ধান চাষ হতো। যার মধ্যে আমনে ছিল প্রায় ৩০-৪০ জাতের বাহারি নাম ও রঙের দেশি ধান। বাকিগুলো ছিল আউশ ধান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সালেহ উদ্দিন পলাশ জানান, গত ৫ বছরের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় আমন মৌসুমে মধুমালতি, কালারাজাশাইল, লোতড়, বাজাইলসাদা, রাজাশাইল, আগুনিশাইল, কাতিশাইল, কুটিয়া মনি, পক্কীরাজ, পাটজাত, লোহাচূড়া, ধলামোডা, নোনাহাইল নামের বৈচিত্র্যময় ১৩ জাতের দেশীয় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এগুলোর বীজও এখন নেই।

বর্তমানে গিগজ, ভুষিহারা, কাজলশাইল, কালোজিরা, শাক্করখোরা নামের পাঁচটি দেশীয় জাত খুবই কম পরিমাণে চাষ করছে কৃষক। বর্তমানে আউশ মৌসুমে কালাহাঠিয়া নামের একটি ধান ছাড়া অন্য কোন দেশীয় ধান নেই। আউশ মৌসুমে গত পাঁচ বছরে বোলাইম, গয়াল, হলিধান, মাড়িছা, কেরোনডোল, কটকতারা, পানবিড়া নামের ৭ প্রজাতির ধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

ফয়েজ আহমেদ (৬৫)। অবসরপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুর জেলার এ কৃষি কর্মকর্তা জানান, দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে কৃষকরা লাভ আর চাপে পড়ে স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদন ছাড়তে শুরু করে। ফলে দেশি অনেক জাতের ধান বিলুপ্ত হতে থাকে। এতে করে বৈচিত্র্যময় খাদ্য  ও বাহারি ধান হারিয়ে যায়।

দেশি ধানের জায়গা দখল করে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত বিআর এবং ব্রি ধান। উচ্চ ফলনশীল এ ধানগুলো বছর বছর সংখ্যা দিয়ে নতুন নতুন নাম নিয়ে ধান আনেন বিজ্ঞানীরা। আরও উৎপাদনের আশায় একসময় চলে আসে অত্যন্ত কৃত্রিম হাইব্রিড ধান। এখন হাইব্রিডের চাপে উচ্চ ফলনশীল বহু ধানও হারিয়ে গেছে। ফলে শুধু ভাত না, বরং বৈচিত্র্যময় খাদ্য তৈরির ধান ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ১০৬টি উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে। যার মধ্যে আউশ ২৩টি, হাইব্রিড ৭টি, আমন ৪৬টি এবং বাকি জাতগুলো বোরো ধান। একই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) ৩০টি জাতের ধান উদ্ভাবন করেছিল। পূর্বে দেশি জাতের বিচিত্র ধানকে হটিয়ে গবেষণাগারে উদ্ভাবিত ধানগুলো কৃষকের খেতে স্থান পায়। তবে ধান উৎপাদনের এলাকা লক্ষ্মীপুরে এখন প্রতি মৌসুমে ৩-৪টি ধানই চাষ হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় বীজ বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে ১৭০টি হাইব্রিড জাতের ধান আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। যার মধ্যে আমন ধান ১৮টি এবং বোরো ধান ১৫২টি।

কৃষক এবং কৃষি পণ্য ব্যবসায়ীরা জানায়, সবার শেষে হাইব্রিড এলেও বোরো ধান হাইব্রিডের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। এখন আমন মৌসুমেও ব্যাপক পরিমাণ হাইব্রিড ধান চাষ করছে কৃষক। ফলে কৃষকের দেশি ধান বিলুপ্ত হওয়ার পর উফশী জাতগুলো হুমকিতে। তাই কৃষকরা এখন ধান চিনে রাখতে পারছেন না, আবার বীজও সংরক্ষণ করতে পারছেন না।

পরিবেশ ও কৃষি বিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবুজ বাংলাদেশের গ্রিনল্যান্ড প্রকল্পের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান জানান, দেশি ধানের বিলুপ্তির পর এখন হাইব্রিড ধানের চাপে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় আবিষ্কৃত উচ্চফলনশীল অনেক ধানও হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কৃষকের হাতে কৃষকের বীজ নেই। তাই বিপর্যয় ঠেকাতে দেশি ধানের জন্য জেলাভিত্তিক জিনব্যাংক স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে।

এখন আর সিলেটের হাওর অঞ্চলে দেশি জাতের বোরো ধান চাষাবাদ হয় না।। দুই যুগ আগেও বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনি, মাটিয়ান, মহালিয়া, বর্ধিতগুরমাসহ সুনামগঞ্জের ছোট বড় সবগুলো হাওরেই চাষাবাদ হতো দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন জাতের বোরো ধান।

দেশীয় বোরো ধান রোপণের পর তেমন কোনো যত্ন করতে হতো না। এমনকি সার ও কীটনাশকও দেওয়া হতো না। জলবায়ু সহিষ্ণু ছিলো দেশি জাতের সব কয়টি ধান। ফলন একটু কম হলেও অতিবৃষ্টি কিংবা খরাতে তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। জমিতে সেচেরও প্রয়োজন হতো না।

কিন্তু বর্তমানে হাইব্রিড আর বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের বোরো ধান। বেশি ফলনের আশায় কৃষকরা ঝুঁকছেন হাইব্রিড ধান চাষাবাদে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে সরকারও জোর দিচ্ছে হাইব্রিড ধান চাষাবাদে।

তবে তাহিরপুর উপজেলা কৃষি অফিস সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল বীজ ধানের পাশাপাশি দেশি প্রজাতির ধানের বীজ রাখার জন্যও পরামর্শ দেন। হাওর অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির ধান যা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে তার মধ্যে রয়েছে রাতা, গচি শাইল, নাজিশাইল, লাকাই, পানি শাইল, বোর, টেপি, রঙ্গিলা টেপি, রাজাশাইল, বেগুন বিচি, কালো জিরা, বাশফুল ইত্যাদি। একটা সময় অতিথি আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু জাতের ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হতো। খেতেও সুস্বাদু ছিল সেসব ধানের চাল।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলেছেন, দেশি জাতের ধানে ফলন কম হওয়ায় কৃষক এখন আর আগেরে মতো দেশি ধান চাষাবাদে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অধিকাংশ হাওরেই এখন চাষাবাদ হচ্ছে ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ২৯, ব্রি ১২০৩, শক্তি।

সরেজমিনে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে দেখা যায় এমন চিত্র। বিস্তীর্ণ হাওর জুড়ে সবুজের হাতছানি। হাইব্রিড ধানই চাষাবাদ হচ্ছে হাওরজুড়ে।

শনির হাওর পাড়ের ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন। তিনি জানান, দেশি জাতের ধান চাষের উৎপাদন খরচ কম ছিল। তখন ধান কাটার মৌসুমে গ্রামে পিঠা পায়েস, চিড়া, খই, মুড়ি তৈরির ধুমও ছিল। এখন তা আর হয় না। দেশি জাতের ধান আবাদে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না বলেও তিনি জানান।

মাটিয়ান হাওর পাড়ের মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক সত্য রায় জানান, দেশি ধান চাষাবাদ করতে কোনো বীজ বাজার থেকে কিনতে হতো না। বীজের জন্য কিছু ধান আলাদা করে ঘরে তুলে রাখলেই চলত। বর্তমানে আমরা যে ধান চাষাবাদ করছি তা বীজ রাখতে পারছি না। বছরে বছরে বাজার থেকে চড়া দামে বীজ কিনতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধান রোপণের পর জমিতে কীটনাশক, সার, সেচ প্রচুর পরিমাণ দিতে হচ্ছে। না হলে ফলন ভালো হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ১০ হাজার জাতের দেশীয় ধান হারিয়ে গেছে। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলাদেশে প্রায় ১৮ হাজার জাতের দেশীয় ধান ছিল। আমাদের কৃষি ঐতিহ্য যে কতোটা সমৃদ্ধ ছিলো তা উপরোক্ত বিস্ময়কর পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই অনুমান করা যায।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এমন ৮ হাজার ধানের জাত সংগ্রহ করে জিন ব্যাংক গড়ে তুলেছে। এতে কৃষক স্থানীয় ও দেশি উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ করে আমন মৌসুমে বেশি পরিমাণ ধান ঘরে তুলতে পারবেন বিলুপ্ত। ১০০ প্রজাতির স্থানীয় জাতের ধান আবার মাঠে ফেরাতে সংরক্ষণ ও গবেষণা করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

গবেষণার মাধ্যমে জাতগুলোকে উচ্চফলনশীল জাতে রূপান্তরিত করে ভবিষ্যতে অবমুক্ত করা হবে। এছাড়া জনপ্রিয় বিলুপ্ত প্রজাতির স্থানীয় ধানের জাতের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। কৃষক এখান থেকে তার পছন্দের স্থানীয় জাত বেছে নিয়ে চাষাবাদ করে অধিক ধান উৎপাদন করতে পারবেন। এভাবে স্থানীয় বিলুপ্ত জাতের ধানের চাষাবাদ ফিরে আসবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এদেশের সাধারণ কৃষকরা যে বসে নেই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে হরি ধান। এই হরি ধান একটি বিশেষ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান। বাংলাদেশের কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী এই ধানের আবিষ্কারক। ঝিনাইদহ জেলার অনেক জমিতে এখন এই ধান চাষ হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ফলন ২০ থেকে ২২ মণ। ধানের গোছা পুষ্ট ও খড় শক্ত। মোটা চাল। ভাত মোটা হলেও খেতে সুস্বাদু।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসানসোল গ্রামের কৃষক হরিপদ কাপালী ১৯৯৯ সালে নিজের ধানের জমিতে একটি ছড়া তার নজর কাড়ে। ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ ছড়াটি তিনি নজরদারিতে রাখলেন। ধানের বাইল (ছড়া) বের হলে তিনি দেখতে পান বাইলগুলো তুলনামূলকভাবে অন্য ধানের চেয়ে দীর্ঘ, এবং প্রতিটি বাইলে ধানের সংখ্যাও বেশি। ধান পাকলে তিনি আলাদা করে বীজ ধান হিসেবে রেখে দিলেন। পরের মৌসুমে এগুলো আলাদা করে আবাদ করলেন এবং আশাতীত ফলন পেলেন। এভাবে তিনি ধানের আবাদ বাড়িয়ে চললেন। আর নিজের অজান্তেই উদ্ভাবন করলেন এক নতুন প্রজাতির ধান, হরিধান। মূলত ডারউইনের আবিষ্কৃত কৃত্রিম নির্বাচনের একটি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন প্রান্তিক কৃষক হরিপদ কাপালী। ইরি ও বোরো মৌসুমে এ ধান আবাদ করতে হয়। তার গ্রামের কৃষকরা এর থেকে উপকৃত হওয়ার পর পুরো বাংলাদেশে এর আবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাওয়া ধানগুলো থেকে ১৩০ জাতের বিভিন্ন ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আবহমানকাল ধরে চালকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রধান খাবার ভাত। দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাবারের জোগান নিশ্চিত করা সহজ কথা নয়। এর পেছনে রয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, কৃষি উপকরণ সহায়তা, ভর্তুকি, প্রণোদনা, দেশের ধান বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণা এবং ঘাম ঝরানো কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম। এসবের মধ্য দিয়ে খাদ্য ঘাটতির দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গৌরব লাভ করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্লোগান ছিল, ‘বাংলার প্রতি ঘর, ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে’। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে যে কয়েকটি খাত এগিয়ে আছে, তার মধ্যে বড় অবদান রেখেছে কৃষি খাত। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং অব্যবহিত পরে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় কড়া নাড়তো। এরপরও বছরে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিপুল মানুষের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই বড় অর্জন। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে মন্তব্য করেছিলেন। এদেশের কৃষি বিজ্ঞানী ও কঠোর পরিশ্রমী কৃষককুল তাদের মেধা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে বিশ্ব দরবারে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ এখন আর খাদ্য সংকটের দেশ নয়।

বাংলাদেশ এখন খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক দেশ। ধান, গম, ভুট্টা আলু, আম বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, দুর্যোগ ও জলবায়ু সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষির অভিযোজন বিষয়ক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যেসব দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭২ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১০৬টি (৯৯টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড) উচ্চফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৪৬টি জাত বোরো মৌসুমের জন্য, ১২টি জাত বোরো ও আউশ উভয় মৌসুম উপযোগী, ২৬টি জাত বোনা এবং রোপা আউশ মৌসুম উপযোগী, ৪৫টি জাত রোপা আমন মৌসুম উপযোগী, একটি জাত বোরো, আউশ এবং রোপা আমন মৌসুম উপযোগী, একটি জাত বোনা আমন মৌসুম উপযোগী। এছাড়া বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।

আমাদের দেশের শ্রমশক্তির মোট ৪০.৬০ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত। তাছাড়া রপ্তানি আয়েও কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তাই এদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের কৃষি ভূমিগুলোকে কঠোরভাবে রক্ষা করতে হবে। এদেশের কৃষি ও কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড ধানের উপর নির্ভরশীলতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় জনপ্রিয় সকল দেশীয় জাতের ধানের উৎপাদন বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে বাড়িয়ে আবার মাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় স্বার্থে আমাদের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটকে অধিতর সক্রিয় হতে হবে। বিদেশি হাইব্রিড ধানের উৎপাদন ব্যয় এদেশীয় ধানের চেয়ে অনেক বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আমদের কৃষি এখন প্রতিনিয়ত অতিবৃষ্টি,  আকষ্মিক বন্যা ও খরার ঝুঁকিতে রয়েছে। যে-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের কৃষককুল, ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। জলবায়ু সহিষ্ণু ও ব্যয় সাশ্রয়ী আমাদের দেশীয় জাতের ধান গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল করা গেলে এদেশের কৃষকেরা সবদিক থেকে লাভবান হবে। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড ধানের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের এদেশীয় ধানের প্রজাতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে-কোনো মূল্যে। এটা এখন সময়ের দাবি।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.