নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৯)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৯)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ১৯তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব 

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮

বর্ণবাদী মানুষ এই পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আমেরিকায় তো আছেই। যেমন কালোরা সাদাদের সহ্য করতে পারে না ঠিক তেমনি সাদারা কালোদের। চাইনিজরা নিজের জাত ছাড়া অন্য কোনো জাতকেই সহ্য করতে পারে না, আমাদের জাতের মানুষরাও কালো কিংবা চাইনিজদের সহ্য করতে পারে না কিন্তু সাদাদের ঠিকই জি হুজুর, জি হুজুর করে। তার কারণ শ্বেতাঙ্গ বর্ণের মানুষদের বেশিরভাগই ভদ্র-বিনয়ী এবং এরা ভালো বকশিস দেয়! ‘ভালো বকশিস দেয়’ কথাটি বললাম ফ্রম এ ক্যাব-ড্রাইভারস স্ট্যান্ডপয়েন্ট।

একদিন দুপুরবেলা কাজ করছি। হঠাৎ ফোন এল। ফোন করেছে এক বন্ধু। ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বন্ধু আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল, দোস্ত জানোস এই সাদা মানুষগুলো যদি খ্রিষ্টান না হয়ে মুসলমান হতো তাহলে মৃত্যুর পর তাদের সবার স্থান হতো বেহেস্তে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ওরা বেহেশতে না গেলে হেভেনে যাবে। এখন বল সাদা মানুষের প্রতি হঠাৎ তোর ভালোবাসা উথলে পড়ছে কেন? ঘটনা কী?

সে বলল, আরে মামা বুড়া সাদা প্যাসেঞ্জার আমাকে পঞ্চাশ ডলার টিপস দিছে।

আমি বললাম, এক পয়সা টিপস না দিলে বলতি সবার স্থান হতো দোযখে কিংবা হেলে!

মোদ্দাকথা যে দেশে এক শ’ এক বর্ণের এবং জাতীয়তার মানুষের বাস, সেখানে বর্ণবাদ থাকবেই। তবে সবাইকে এক পাল্লায় মাপাটাও ঠিক নয়! বর্ণবাদী সবখানেই আছে।

নিউইয়র্কের রাস্তার খুব পরিচিত একটি দৃশ্য বর্ণনা করা যাক। ধরা যাক, কালো এক লোক ট্যাক্সির উদ্দেশ্যে হাত উঁচিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। একটার পর একটা ট্যাক্সি তার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউই থামছে না! কেন থামছে না? এর কারণ কী? এটাত বর্ণবৈষম্য! শুনলে বিস্মিত হবেন কালো আফ্রিকান ট্যাক্সিড্রাইভাররাও তাদের জাতভাইদের ট্যাক্সিতে ওঠায় না। তার একমাত্র কারণ কালো প্যাসেঞ্জার মানেই যন্ত্রণা! এরা গাড়িতে উঠে প্রথমেই ফ্লাটরেটে ভাড়া দিতে চাইবে, যা আইন বহির্ভূত। ট্যাক্সিতে মিটার বসানো আছে। দূরত্ব ও সময় অনুযায়ী সেই মিটার চলে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মিটার যে টাকার অংক দেখাবে সেটাই তার ভাড়া। ফ্লাটরেটে যেতে আমরা সাধারণত রাজি হই না। কারণ ফ্লাটরেট ভাড়ায় ওরা যে পয়সা দিতে চায় সেটা সাধারণত মিটার ভাড়ার চেয়ে কম। ন্যায্য ভাড়ায় অর্থাৎ মিটার রেটে গেলেও এরা কখনোই বকশিশ দেয় না! আমাদের আয়ের বিরাট একটি অংশ জুড়ে আছে বকশিশের টাকা।

গাড়িতে উঠে কালো মানুষেরা নানান যন্ত্রণা করে। যেমন হাই ভলিউমে রেডিও চালাতে বলে, দিকনির্দেশনা দেয় যার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা যারা এই শহরে ট্যাক্সি চালাই, আমাদের সিংভাগই এই শহটিকে খুব ভালোভাবেই চিনি। না চিনলে জিপিএস তো আছেই। কখনো কখনো গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ভাড়া না মিটিয়েই গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেয়, ড্রাইভারদের গায়ে হাত তোলে, কথা কাটাকাটি হলে গাড়ির ক্ষতি করে, সাইড ভিউ মিরর ভেঙে ফেলে। এদের আচরণ মোটামুটি পশুর মতন। অতএব, পারতে এদের কেউ গাড়িতে উঠায় না। বিচিত্র শোনালেও সত্য, অনেক ইমিগ্রান্ট আফ্রিকান ট্যাক্সিড্রাইভারেরাও তাদের জাত ভাই কালো আমেরিকানদের গাড়িতে ওঠায় না। দেখেও না দেখার ভান করে কেটে পড়ে। তবে শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত এবং স্যুট টাই পরা কালো লোকদের প্রায় সবাইই গাড়িতে ওঠায়। আমি নিজেও উঠাই। কমবয়সী কালো ছেলেপুলে যাদের পরনের প্যান্ট হাঁটুর কাছে ঝুলে আছে, মাথায় ডুরেগ-বাঁধা এদের দেখলেই কিছু দেখে নি এমন একটা ভাব করে সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

অনেক সময় নিউইয়র্ক ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশন বর্ণবাদী ড্রাইভারদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতে। টিএলসিতে কর্মরত কোনো কালো অফিসারকে প্যাসেঞ্জার সাজিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে। এরা খালি ট্যাক্সি দেখলেই হাত ওঠায়। যেসব ট্যাক্সি ড্রাইভার এদের গাড়িতে ওঠায় না, তাদের বড়ো অংকের ফাইন গুনতে হয়।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.