দেজা ভ্যু

দেজা ভ্যু

 

আমরা এখানেই মরব

ডেনভার, কলোরাডো, ইউএসএ

আগস্ট, ২০১৫

ডেনভার এয়ারপোর্টে নেমেই মন ভালো হয়ে গেল মিরিয়ামের। গত কয়েকদিনের তুমুল মন খারাপ আর ত্রিশ ঘণ্টা জার্নির ধকল তার সবটুকু শক্তি যেন শুষে নিয়েছে। নামিবিয়া থেকে আমেরিকা; সেই উইন্ডহোক থেকে শুরু করে ডেনভার পর্যন্ত, মাঝখানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুট এয়ারপোর্টে ট্রানজিট, সব মিলিয়ে পাক্কা ত্রিশ ঘণ্টা। এই পুরোটা সময়জুড়ে মিরিয়ামের মনের ভেতরে ছিল ঘন কালো মেঘ। এয়ারপোর্ট থেকেই আব্রাহামকে একটা টেক্সট করে দিল, নিরাপদে পৌঁছেছে সে। হোটেলে গিয়ে সময় নিয়ে দুই মেয়ে আর আব্রাহামের সাথে কথা বলবে ঠিক করল। নাহ আজকে মনে হয় আর কথা হবে না, হোটেলে যেতে যেতে কম করে হলেও দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণে নামিবিয়ায় গভীর রাত। নামিবিয়ার কথা মনে পড়তেই মনের ভেতরের টুকরো টুকরো কাচগুলো যেন আবার নড়াচড়া করে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। মিরিয়াম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, নামিবিয়া হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ। মিনারেল এনার্জি এনালিস্ট হিসেবে কত দেশেই তো গিয়েছে সে, নামিবিয়ার চেয়ে সুন্দর সি বীচ আর কোথাও দেখে নি সে। এসব ভাবতে ভাবতে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলো সে। সন্ধ্যা নেমেছে ডেনভারের আকাশজুড়ে। নীল আকাশের ওপর গোলাপি প্রলেপ, সেই আকাশ চিরে বের হয়েছে ছাই রঙের পর্বতমালা। এতক্ষণে মনে হচ্ছে আবার জীবনীশক্তি ফিরে পেয়েছে সে। মনে মনে আওড়াল, ‘মিরিয়াম বি রেডি ফর ইউর বিগেস্ট জার্নি।’

নামিবিয়ার মেয়ে মিরিয়ামের ছোটবেলা কেটেছে দেশের যুদ্ধের ভেতরে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া সে এক কঠিন সময়। ছোটবেলায় যুদ্ধ দেখে দেখে বড় হওয়ার কারণেই মনে হয় নিজেকে ভীষণ শক্ত করে গড়ে তুলেছে সে। সব পরিবেশেই ঠিক ঠিক মানিয়ে যায়, টিকে যায় মিরিয়াম। স্কুল থেকেই তার প্ল্যান ছিল খনিজ সম্পদ নিয়ে পড়াশোনা করার। দেশের খনিজ সেক্টরে কাজ করার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে কিন্তু তার পথচলা থামে নি। আরও বড় স্বপ্ন নিয়ে সে এবারে এসেছে কলোরাডো স্কুল অব মাইনসে পড়বে বলে। সেই যে গ্রাজুয়েশনের পর পর মিনারেল এনার্জি এনালিস্ট হিসেবে মিনিস্ট্রি অব মাইন এন্ড এনার্জিতে চাকরি নিল আর তারপর টানা চার বছর কাজ করে সে গড়েছে দুর্দান্ত কেরিয়ার। দেশে-বিদেশের সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং-এ অংশ নেওয়া, রিসার্চ পেপার লেখা, প্রফেশনাল গ্রুপে লিড দেওয়া—এই সবকিছু তার স্বপ্নের পথকে আরও মসৃণ করেছে। এরপর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে মিনারেল এন্ড এনার্জি ইকোনোমিক্স পড়তে তার আমেরিকায় আসা।

হাইওয়ে ধরে ট্যাক্সি চলছে গন্তব্যে। বাইরে নামছে অন্ধকার। শহরের সন্ধ্যার আলোগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করেছে। ট্যাক্সিতে বসে মিরিয়াম ভাবছে গত কয়েক দিনের কথা। আব্রাহামের সাথে কুৎসিত ঝগড়া হয়ে গেল আসার আগে। আব্রাহামের অভিযোগ, ভীষণ রকম কেরিয়ারিস্ট মিরিয়াম। অথচ আব্রাহামের সাথে তার প্রেম এক যুগের উপরে। একসাথে স্বপ্ন দেখেছিল তারা। মিরিয়ামের সমস্ত স্বপ্নের কথা সে খুব ভালো করেই জানে। কেরিয়ার নিয়ে সিরিয়াস মিরিয়াম তবে পরিবারকে অবহেলা করে নি কখনো। দুই মেয়ের পড়াশোনা আর তাদের বেড়ে ওঠার যাবতীয় অনুষঙ্গ, আবদার মিরিয়ামকেই দেখতে হয়েছে। কলোরাডো স্কুল অব মাইনসে পড়ার স্বপ্ন এত সহজে সত্যি হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করে নি। এ সুযোগ সে হারাবে কীভাবে ? তা ছাড়া একটু থিতু হয়ে মেয়েদের নিয়ে আসবে এখানে, সাথে আব্রাহামও আসবে। অথচ আব্রাহামের ধারণা এসব কিছু আব্রাহামের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে। নামিবিয়ার চাকরি ছেড়ে দিলে, অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে তার কেরিয়ার। মিরিয়াম আর ভাবতে চায় না। সে মন দিল ডেনভারের সন্ধ্যায়। ডাউন টাউন ডেনভারে ঢুকে পড়েছে ট্যাক্সি। হোটেল আশেপাশেই হবে। গুগল ম্যাপ দেখতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে।

 

হোটেলে চেক ইনে সময় লাগে নি। ডিনার সেরে রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনিতে এসে বসে মিরিয়াম। চোখের সামনে এখন রাতের ডেনভার। ডেনভারের আলো দেখতে দেখতে মিরিয়ামের মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। তারা তিন বোন থাকত দাদির সাথে। মা-বাবা শহরে কাজ করত। সাউথ আফ্রিকান ডিফেন্স ফোর্স আর নামিবিয়ার সোয়াপো পার্টির মধ্যে যুদ্ধ, নামিবিয়াকে স্বাধীন করার যুদ্ধ চলছিল। মিরিয়ামের শৈশবের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে ছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে। চারদিকে গোলাগুলি। সাউথ আফ্রিকান আর্মি অস্ত্র নিয়ে নেমেছে তাদের এলাকায়। আশেপাশের সবাই ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। মিরিয়ামরা তিন বোন দাদিকে জড়িয়ে ধরে থাকত। দাদি ফিসফিস করে বলত, আমরা কোথাও পালাব না। আমরা এখানেই মরব।

‘আমরা এখানেই মরব, আমরা এখানেই মরব’—ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মিরিয়াম।

 

ডু অর ডাই

ডেনভার, কলোরাডো, ইউএসএ

সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রথমবারের মতো দেশের বাইরের মাটিতে পা রাখল অনামিকা। কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছে সে। সেই উদ্দেশ্যেই আমেরিকায় আসা। সে এক সপ্তাহ হলো ইউনিভার্সিটির ডর্মে উঠেছে। প্রথমে এসে উঠেছিল ফরহাদ আংকেলের বাসায়। অনামিকার মায়ের কেমন যেন লতায় পাতায় আত্মীয় হন তিনি। ফরহাদ আংকেলের ফ্যামিলি অনেক আদরযত্ন করেছে অনামিকার। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখী পরিবার আংকেলের। তারা স্বামী-স্ত্রী, দুজনেই চাকরি করেন স্টেট গভর্মেন্টের ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে। ভীষণ ব্যস্ত দুজনেই। তারপরও তারা অনামিকাকে ধরে ধরে শিখিয়েছেন কোথা থেকে গ্রোসারি কিনতে হবে, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের নিয়ম, ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে কী করতে হবে এইসব কিছু। তবু নিজেকে অশিক্ষিত আনাড়ি মনে হচ্ছে অনামিকার। অথচ বাড়ি ছেড়েছে সে সেই কবে। নতুন শহরে এটা তার প্রথমবার নয়। হয়তো দেশের বাইরে বলেই এই বিড়ম্বনা। তবুও এতটা অপদস্ত হতে হবে ভাবে নি সে। বরাবরই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সে। হোক আমেরিকা, এ তো তার অচেনা নয়। মুভিতে, নিউজে, বইয়ের পাতায় আমেরিকাকে জেনেছে, বুঝেছে সে। কে জানত বাস্তব আর বইয়ের পাতায় দেখা এতটা আকাশ-পাতাল তফাত! এই যেমন সকালে গ্রোসারি স্টোরের সেলস গার্লের একটা কথাও সে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে নি সে। মনে হয় মুখের ভেতর শব্দ নিয়ে গার্গল করে। আইএলটিসে প্রথমবারেই সাড়ে সাত তোলা অনামিকা যখন ইংরেজিতে কথা বলতে যায়, মনে হয় মাথা থেকে সমস্ত ইংরেজি শব্দ উধাও হয়ে যায়। নিজেকে তো আর এমনি এমনি অশিক্ষিত মনে হচ্ছে না।

অনামিকার বাড়ি রাজশাহী। তাদের শান্ত, সুন্দর শহরটায় সময় গড়ায় খুব ধীরে। দুপুরগুলো এত লম্বা যেন শেষই হতে চায় না। সেই শান্ত দীর্ঘ দুপুরগুলোতে স্বপ্ন বোনার শুরু। এরপর যেদিন পাড়ার রায়হান ভাই পিএইচডির জন্য আমেরিকা পাড়ি জমায়, সেদিন অনামিকাও ঠিক করে, সেও পিএইচডি করতে বিদেশ যাবে। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় মনোযোগী আর পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের জন্য বরাবরই টিচারদের প্রিয়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর সেই যে ঘরছাড়া হলো, তারপর আর বাড়ি ফেরা হলো না। ফার্মেগেটের হোস্টেল থেকে ছাত্রী হল। তারপর আবার কয়েকজন বান্ধবী মিলে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া। এভাবেই ঠিকানা বদল হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিল; সেখান থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস দেওয়া, পাশাপাশি স্কলারশিপের চেষ্টা। দুটোতেই সফল সে। বিসিএস হলো। তারপর ট্রেনিং, প্রাথমিক পোস্টিং শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া। এর মাঝে বিয়ে, সংসার, বাচ্চা—একেবারে মুভির ট্রেইলার যেন। তার পুরোপুরি এরেঞ্জড ম্যারেজ। শোভন, তার বরও রাজশাহীর ছেলে, বিসিএসে তার দুই ব্যাচ সিনিয়র। পাড়ার সবাই বলে, অনামিকার রাজকপাল। সবকিছুতেই সফল। এসব কথা শুনলে অনামিকার অবশ্য পিত্তি জ্বলে যায়। আহা! কী আমার রাজকপাল! কেউ তো দেখে নি তার স্ট্রাগল, তার পরিশ্রম। এই এতটুকু পেতে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে তাকে, জানে কেউ ? পড়াশোনার জন্য ঘর ছেড়েছে, ছেড়েছে আরাম, আয়েশ, আনন্দ। পড়তে পড়তে রাতদিন এক করে ফেলেছে। একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেছে। বিসিএস, আইএলটিএস, জিআরই আরও কত শত পরীক্ষা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে শত কাজের ভিড়ে পড়াশোনার সুযোগ বের করা, পরীক্ষা দেওয়ার সময় বের করা—কত কঠিন দিন যে গেছে! শ্রেয়ার জন্মের পর তো আরও কত কঠিন অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হতো আর বোধ হয় সম্ভব না। ঠিক তখনই মনে হতো ওয়াহিদ স্যারের কথা। ওয়াহিদ স্যার স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। অনামিকা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী। স্যার প্রায়ই বলতেন, ‘ডু অর ডাই’—এই হবে আমাদের স্বপ্ন পূরণের মন্ত্র। যখনই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেত, অনামিকা নিজেকে বলত, ‘ডু অর ডাই অনামিকা!’ মন্ত্রের জোরেই হোক কিংবা ভাগ্য অথবা পরিশ্রমের বদৌলতে কোনো না কোনো পথ বের হয়ে যেত। তখন অদ্ভুত রকমের শক্তি এসে ভর করত অনামিকার কাঁধে।

ডেনভারে আসা অবধি অনামিকা নিজেকে প্রতি মুহূর্তে মনে করাচ্ছে, ‘ডু অর ডাই, করো অথবা মরো অনামিকা’। এই যেমন এখন এডমিশন ডিপার্টমেন্টের খিটখিটে মেজাজের বুড়ি মহিলাটাকে ফেস করতে করতে সে ক্রমাগত আওড়াচ্ছে, ‘ডু অর ডাই, ডু অর ডাই’। মহিলার একেকটা কথা বুঝতে এত সময় লেগে যাচ্ছে।এদিকে বুড়ি প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে আর সেই বিরক্তি লুকানোর কোনোরকম চেষ্টাও সে করছে না। মনে হচ্ছে কাঁচা খেয়ে ফেলবে সে অনামিকাকে। কম্পিউটারে কীসব এন্ট্রি দেওয়ার পর মহিলা ভেতরে কোথায় যেন গেল। মিনিট দশেক পরে মহিলা একটা কাগজের ফোল্ডার নিয়ে ফেরত এল। ফোল্ডারটা অনামিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘ওয়েলকাম টু কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি’। অনামিকা মনে মনে ভাবে, বাহ! বদখত বুড়ির হাসি এত সুন্দর! সেই হাসিতেই দিনটা সুন্দর হয়ে গেল অনামিকার।

অনামিকা হেঁটে হেঁটে ডর্মে ফিরছে। আমেরিকার অল্প কয়েকদিনের জীবনে এই প্রথম অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসটা ভারি সুন্দর। কফি হাউজ থেকে আসা কফির স্মেল আর উড়ে আসা ঝরা পাতাদের খেলা, সব মিলিয়ে দিনটাও খুব সুন্দর। পর মুহূর্তেই শ্রেয়ার কথা মনে পড়ে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। তার ছোট্ট মেয়েটা কী করছে কে জানে! কবে ছুটি পাবে শোভন আর কবে যে দেখতে পাবে মেয়েটাকে ? হঠাৎই এক রাশ বিষণ্নতা ঘিরে ধরে তাকে। অনামিকা শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘ডু অর ডাই’।

 

ওয়েলকাম এন্ড এন্টারটেইন দেম অল!

ডেনভার, কলোরাডো, ইউএসএ

জানুয়ারি, ২০১৬

সকাল নয়টা। ডাউনটাউন ডেনভারের হোটেল হিলটনের বলরুম। একটু পরেই এখানে শুরু হবে কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি আর কলোরাডো ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাচারাল রিসোর্সেস-এর কোলাবোরেশানে তিন দিনের সেমিনার। সেমিনারের বিষয়বস্তু কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি টু কনজার্ভ ন্যাচারাল রিসোর্সেস। এই সেমিনারে আলিয়াকে মনোনয়ন দিয়েছে তার অফিস। সেমিনারে যোগ দিতেই সে মেলবোর্ন থেকে উড়ে এসেছে গত পরশু দিন। গতকাল কেটেছে ডেনভার ডাউনটাউনে ঘোরাঘুরি করে। আজ বেশ সকাল সকাল ভেন্যুতে এসে পড়েছে। তার একটা পেপার প্রেজেন্টেশন আছে। ব্ল্যাক স্যুট, মেরুন শার্ট আর চুলগুলো পোনিটেল করে বাঁধা আলিয়াকে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আলিয়া কাজ করে মাইনিং কোম্পানিতে। এখানে কাজ করতে করতেই ন্যাচারাল রিসোর্স নিয়ে তার আগ্রহ জন্মায়। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে কিছু রিসার্চেও সে নাম লিখিয়েছে। গত বছর তার একটা পেপার পাবলিশ হয়েছে, যা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তার ইচ্ছা এ বিষয়ে বই লেখার। এজন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। কর্পোরেট ব্যবসা, ন্যাচারাল রিসোর্স আর সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে গবেষণা করছে সে। মা’র সাথে মাঝেমধ্যে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তার সাথে কথা বলতে গেলেই ঘুরেফিরে আফগানিস্তানের কথা চলে আসে। আসে কাবুলের সেই বাড়িটার কথা—যেখানে চারদিকে অনেক গাছ, ফুলের বাগান আর সবুজ উপত্যকা।

আলিয়ার মা-বাবা আফগান আর আলিয়ার জন্ম পাকিস্তানে। আলিয়া যখন মায়ের পেটে, সেই সময়ে আফগানিস্তান দখলে গেল তালেবানদের। তার ডাক্তার মা-বাবা সারা জীবনের সঞ্চয় এক স্যুটকেসে ভরে পাকিস্তানে পালিয়ে বাঁচল। সেখান থেকে বহু চেষ্টার পর অস্ট্রেলিয়া। আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের কোনো স্মৃতি আলিয়ার নাই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অস্ট্রেলিয়াই দেখে আসছে সে। তবে মা’র কাছে গল্প শোনে আফগানিস্তানের, পাকিস্তানের রিফিউজি ক্যাম্পের। খুব ভয়াবহ নাকি ছিল সেই ক্যাম্পের দিনগুলো। কাবুলে তাদের দোতলা বাড়িটা নাকি খুব সুন্দর ছিল। বাগানে যেসব ফুল ফুটত, সেসব ফুল নাকি শুধু কাবুলেই ফোটে। আলিয়া অবশ্য নিজেকে গ্লোবাল সিটিজেন মনে করে। অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়ায় বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে সে মিশেছে; বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি আর ভাষাও তার জানা। সে স্কুলে শিখেছে স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ। কাগজে কলমে অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেন। তবু মা বলে তার শেকড় নাকি আফগানিস্তানে। স্কুলে তাকে বুলিংও করা হয়েছে, তার ভিন্ন চেহারার জন্য। তবে সেসব অনেক আগের কথা। এখন সে পুরোদস্তুর গ্লোবাল সিটিজেন। পুরো বিশ্বের জন্য কাজ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। দেশ, জাতি, শেকড় এসব বিষয় খুব বেশি ভাবায় না তাকে। মা একটা কবিতা বলত রুমির লেখা, ‘দা গেস্টহাউস’। পশতু ভাষার কবি রুমি নাকি আফগানে খুব জনপ্রিয়। দা গেস্টহাউজ কবিতা আলিয়ারও অনেক পছন্দ। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর সংকটের মুহূর্তগুলোতে দা গেস্টহাউস কবিতা তার সঙ্গী। স্কুলে যখন কেউ বুলিং করত, চোখ বুজে সে আওড়াত—

This being human is a guest house.

Every morning a new arrival.

A joy, a depression, a meanness,

some momentary awareness comes

as an unexpected visitor.

 

Welcome and entertain them all!

স্কুলে ম্যাথের সেরা ছাত্রী ছিল আলিয়া। এজন্যই পরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে মেয়ের সংখ্যা ছিল খুব কম। মোটে তিন জন। সে বাদে একজন চাইনিজ আর একজন ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত মেয়ে ছিল তার ক্লাসে। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যদের মতো কাজও করত সে, রেস্টুরেন্টে, লাইব্রেরিতে, চেইন শপে। কিন্তু আলিয়া জানত তার পথ সম্পূর্ণ আলাদা। যত কষ্ট হোক, অনেকদূর যেতে হবে তাকে। সেই অনেক দূর কতটা দূর আলিয়া জানে না। সে শুধু জানে, এভরি মর্নিং এ নিউ এরাইভাল।

 

তিন দিনের সেমিনার শেষ। কাল আবার মেলবোর্ন ফিরে যাবে আলিয়া। সেমিনারে আলিয়ার পেপার বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আজ রাতে তার মন খুব ভালো। আলিয়া মনে মনে রুমি আওড়ায়—

‘The dark thought, the shame, the malice,

meet them at the door laughing,

and invite them in.

Be grateful for whoever comes,

because each has been sent

as a guide from beyond.’

 

বিন্যাস আর সমাবেশ

ঢাকা, বাংলাদেশ

জানুয়ারি, ২০১৬

অনামিকা আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার পর তার মেয়ে শ্রেয়া থাকে অনামিকার মায়ের সাথে। নানির সাথে খালামণি নিবেদিতাও দেখাশোনা করে তার। এই মুহূর্তে নিবেদিতা অঙ্ক করছে আর শ্রেয়া তার পাশে বসে আছে।

শ্রেয়া বলে, খালামনি কী করছ ?

অঙ্ক করছি

কিসের অঙ্ক ?

বিন্যাস সমাবেশ।

সেটা কেমন ?

সেটা একটা মজার জিনিস। এই যে তুই লেগো দিয়ে খেলছিস এটা একটা বিন্যাস সমাবেশের খেলা। আবার প্রকৃতিতেও আছে বিন্যাস সমাবেশ। যেমন ধর কাল যে রংধনুটা দেখলি সেখানে রংগুলো কেমন একটা অর্ডারে সাজানো। এই রংগুলোর অর্ডার কিন্তু সব সময় একই থাকে, এ কখনোই চেঞ্জ হয় না। আবার ফুলের পাপড়ি কীভাবে সাজানো থাকে, দেখেছিস ? এগুলো হচ্ছে এক ধরনের অঙ্ক। প্রকৃতি সব সময় অঙ্ক মেনে চলে।

 

নিবেদিতা যখন শ্রেয়াকে বিন্যাস সমাবেশ বোঝাচ্ছিল, ডেনভারে মেট্রোতে প্রকৃতি তখন সবার অলক্ষে একটা বিন্যাস ঘটাচ্ছিল। মিরিয়াম, অনামিকা আর আলিয়া পাশাপাশি বসে মেট্রোতে। পৃথিবীর তিন প্রান্তের তিন দেশ থেকে আসা তিন মেয়ে অথচ তাদের গল্পটা প্রায় একই রকম, তাদের সংগ্রাম আর স্বপ্নগুলোতেও রয়েছে অদ্ভুত মিল। কেউ জানে না তাদের এই মিলের কথা, এমনকি তিন কন্যাও না। গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে ডেনভার মেট্রো। তিন কন্যা তিন ভিন্ন ভিন্ন স্টেশনে নেমে পড়ে। তারা জানে না প্রকৃতি আরও একবার তাদের এক কাতারে বসাবে। কারণ, প্রকৃতিতে এই বিন্যাস সমাবেশের খেলা নিত্য চলে। মানুষ তা জানে না।

 

দেজা ভ্যু

সেপ্টেম্বর, ২০৩৫

কিয়োটো, জাপান

আজকের দিনটা মিদোরির জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। গত তিন মাস ধরে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে শুধু আজকের দিনটার জন্য। কিয়োটো কনফারেন্স হলের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির দিকে সে আরও একবার চোখ বুলায়। কনফারেন্স অফ পার্টিস-এর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সেশন শুরু হতে যাচ্ছে সকাল দশটায়। বাংলাদেশ, নামিবিয়া আর অস্ট্রেলিয়া থেকে তিনজন ভিভিআইপি যোগ দেবে এই সেশনে। মিদোরির দায়িত্ব এই সেশন সঞ্চালনা করার।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। জাপানিজ মেয়ে মিদোরি বলতে থাকে, প্রিয় দর্শক! আপনারা জানেন সারা পৃথিবীতে এখন ন্যাচারাল রিসোর্সের ঘাটতি। পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর পুরো বিশ্ব। আজকের এই সেশনে আমরা এ বিষয়ে শুনব তিন জন বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ সেক্টরে কাজ করছেন এবং তাদের কাজ সমাদৃত হয়েছে পুরো বিশ্বে। লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান, প্লিজ ওয়েলকাম মিস অনামিকা চৌধুরী, সেক্রেটারি, মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট বাংলাদেশ; এন্ড মিস মিরিয়াম সিলংগো, ডেপুটি মিনিস্টার, মিনিস্ট্রি অফ ইন্ডাস্ট্রিজ, মাইন এন্ড এনার্জি, নামিবিয়া; এন্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, প্রফেসর আলিয়া রিচার্ড, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া।

মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে উঠল পুরো কনফারেন্স হল। দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের বক্তব্য শোনার জন্য। কেউ জানে না স্পিকার প্যানেলের তিন জনকে প্রকৃতি আরও একবার এক সারিতে বসিয়েছিল ডেনভার মেট্রোতে। তাদের আজকের এই একসারিতে বসা কি সেদিনই নির্ধারিত হয়েছিল ? প্রকৃতি রহস্যময়। সেই রহস্য পুরোপুরি ভেদ করতে মানুষ কোনোদিনই পারে নি।যা

 

[‘অন্যপ্রকাশ লাখ পেরিয়ে উদযাপন’ গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় ১০জন গল্পকার বিজয়ী হয়েছেন। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন আসফিয়া সুলতানা তার গল্পটি এই সংখ্যায় ঠাঁই পেল।—বি.স]

Leave a Reply

Your identity will not be published.