অন্যদিন-এ আছি, থাকব: নাসরীন জাহান

অন্যদিন-এ আছি, থাকব: নাসরীন জাহান

প্রায় জন্মশুরুর অন্যদিন-এর সঙ্গে প্রাণজ যুক্ততার প্রসঙ্গ। নতুন বেরোনো একটা ঝকঝকে ম্যাগাজিন একসময় আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতে শুরু করে। সম্পাদকম-লী প্রগাঢ় আন্তরিকতায় সেই ম্যাগাজিনের জন্য একটি গল্প চেয়েছিলেন। গল্প চাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ্ নাসের। আমি তাঁর কাছ থেকে গল্প পাঠানোর স্বাধীন সময় বেছে নিলাম। কী আন্তরিক কী অসাধারণ মানুষ তিনি! এক কথায় রাজি। ক’দিন ফোন এল না। আমি ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে’ নামে একটা গল্প লিখে ফেললে সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুমুল আন্তরিকতায় তাঁদের গ্রীন রোড অফিসে আমাকে দাওয়াত দেন। এলাহি খাবারদাবার! কী আর! এসে ভবে ফেঁসে যাওয়া। যে আমি তীব্রভাবে ওই বছর বই করার বিরোধী ছিলাম, তাকে দিয়ে তাঁরা অনুভব যুক্তি দিয়ে যে গল্প ছাপতে নিয়ে যাই সেই নামেই একটি গল্পের বই করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললেন। এখানেই থেমে নেই। এর আগে আমি একবার স্কুলে আরেকবার বাংলাবাজার পত্রিকায় দুবছর করে করে চাকরি ছেড়ে দিই। ক্রমে ক্রমে অন্যদিন-এর সাহিত্য পাতার দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন এলে মাজহার ভাই বলেন, পাক্ষিক পত্রিকা, আপনি যখন সময় পাবেন, লেখা দেখবেন, প্রয়োজনে আমরা বাসায় ম্যাটার পাঠিয়ে দেব। দীর্ঘ দীর্ঘ দিন নিয়মিত যেতাম। প্রচুর নতুন লেখকের লেখা অন্যদিন-এ ছাপা হয়েছে। সে সময় থেকে এখনো মোমিন রহমান একনিষ্ঠ কাজ করে যাচ্ছেন।

ধীরে ধীরে অন্যদিন রথি মহারথিতে ভরে উঠতে থাকে। উনাদের একটা শর্ত ছিল, কাজটা হুট করে ছাড়ার আগে তাঁদের যেন বলি। প্রায় পঁচিশ বছরের কত স্মৃতি! মাজহার ভাইয়ের আম্মার অসাধারণ রান্না! এ দেশের অনেক বড় বড় লেখক অন্যদিন অফিসে এসে খেয়েছেন।

প্রথম ঈদসংখ্যা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ঈদসংখ্যাকে কীভাবে বিষয় বৈচিত্র্যে আলাদা করা যায়, এজন্য জরুরি মিটিং বসত ঈদসংখ্যা প্রকাশের আগে। লেখকের জীবনে নারী। এমন একটা আয়োজন থাকত ঈদসংখ্যায়। তখন আড্ডা, ইন্টারভিউ হতো আমাদের বাসায়। অফিসের কাজ না জমজমাট আড্ডা দিচ্ছি, কিচ্ছু মাথায় থাকত না। চিরকাল বলেছি, অন্যদিন হাউজ আমার হাউজ। একসময় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ অন্যদিন-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন। আমি অন্যদিন-এ যুক্ত হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে অন্যপ্রকাশ থেকে সব বই বের করতে থাকি। ধীরে ধীরে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে মাজহার ভাইদের প্রাণজ সম্পর্কের কারণে তিনিও সেই পথেই হাঁটলেন। তখন অন্যদিন-এর পাতা হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক উপন্যাস, নাটক, ফিল্মের নানা খবরে জমজমাট থাকত। এইসব লেখা আমার সম্পাদনার কিছু নেই। ফলে সবার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক থাকলেও অফিসে গিয়ে আমার কাজ করার ব্যাপারটা ক্রমে ক্রমে শিথিল হয়ে আসে। হুমায়ূন ভাইয়ের অনবদ্য সঙ্গ, আড্ডায় কত কত সময় যে গেছে! এখন যাই, না যাই, ওই যে দীর্ঘ দীর্ঘ বছরে অন্যদিন-এর মানুষগুলোর সঙ্গে আমার প্রগাঢ় আত্মার আত্মীয়তা তা একেবারেই অযোগাযোগে নয়, সাহিত্য পাতাটা সেইভাবে দেখা না হয়ে উঠলেও প্রতিবছর অন্যপ্রকাশ থেকে আমার যে বই হয়, সব কাজ হয় অন্যদিন অফিসেই। আমার তেলাপোকা হাতে লেখার অজস্র কাটাকুটিতে কতবার যে প্রুফ আসা-যাওয়া করে! এতগুলো বছরের অন্যদিন, একেবারে গেঁথে গেছি। বাকি জীবনের জন্যও।

অনেকে অন্যদিনকে পশ্চিম বাংলার সানন্দার মতো বলেন। সানন্দায় নারীদের ব্যাপারটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় অনেক বেশি। অন্যদিন অন্যদিন-এর মতো। এখানে নানারকমের ফিচার, সাহিত্য সব আছে। কতকিছু মনে পড়ছে! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নারী, এ সাক্ষাৎকারটি এত আনন্দের ছিল, যে আমরা জমজমাট আড্ডায় বসেছি না সাক্ষাৎকার নিচ্ছি বোঝা যেত না। এমন আড্ডার মুখোমুখি বসেছিলেন কবি শামসুর রাহমান, কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। আজ উনাদের কেউ বেঁচে নেই। আড্ডা মধ্যরাত অব্দি গড়াত। একেকজন আমাদের সন্তর্পণে করে যাওয়া একেবারে ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর আবেগে আবেগে দিয়ে পরদিন কিছু কিছু ডিলিট করতে বলতেন।

ঈদসংখ্যার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে শুরু থেকেই আমি একটা প্রতিকূল এবং বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের দেশের কয়েকজন কম লিখিয়ে কথাসাহিত্যিক বলতেন, না না কিছুতেই লেখা দিতে পারব না, নাসরীন তুমি নিজেও তো লেখো, ব্যাপারটা তুমি না বুঝলে কে বুঝবে? এই একটা জায়গায় রীতিমতো লা জবাব হয়ে যাওয়া। কিন্তু চাপেও কিছু ভালো লেখা হয়, এমন বললে মনে আছে এক সাহিত্যিক একেবারে গলা চড়িয়ে হই হই করে বলেছিলেন, সে কখনো হলে হতে পারে, তবে এ বছর, উপন্যাস! অসম্ভব! আমি হাল ছেড়ে মাজহার ভাইকে জানালাম। কিছুদিন পর সেই লেখকের পাণ্ডুলিপি আমার চোখের সামনে ঘোরাতে ঘোরাতে মাজহার ভাই যখন হাসছিলেন, আমি ভাষা হারিয়েছিলাম। এমন বেশ ক’বার হয়েছে।

মনে পড়ে, একেবারে শুরুর দিকে নামকরা কত লেখকের কাছে কত অচেনা ছিল অন্যদিন। ধীরে ধীরে এ দেশের প্রধানতম সব লেখকের পদচারণায় অন্যদিন মুখর হয়ে উঠল। মাজহার ভাই আমার কচ্ছপ মনে হয় এমন জনের কাছ থেকে এমন কিছু আদায় করে ছাড়েনই, বিস্ময়কর! মোমিন ভাই কম কথা বলেও তার করা ফিচার, সাক্ষাৎকার, রিভিউ কোনো কাজে পিছিয়ে নেই উনি। আমি এর আগে বাংলাবাজার পত্রিকায় দুই বছর সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। সেই সূত্রে এ দেশের সব লেখকের সঙ্গে আমার প্রাণজ সম্পর্ক ছিল। অন্যদিন-এ সেটা কাজে এসেছিল। অন্যপ্রকাশের কাজের সূত্রে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আবদুল্লাহ্ নাসের, নাসের ভাইয়ের সঙ্গে প্রগাঢ় আন্তরিক আর নিবিড় যোগাযোগ আছে। একটা মানুষকে কীভাবে কতটা ভোগালেও তিনি যেন আত্মায় বদ্ধপরিকর তিনি শান্ত থাকবেন এবং হাসবেন। প্রতিদিন তাঁকে এমন কত ভোগান্তির মধ্যে ফেলি আমি! অন্যদিন অফিসে গেলে দেখি তো মাজহার ভাইয়ের দুই কানে ফোন আর নাসের ভাই এ টু জেড লেখকের প্রুফ পর্যন্ত মন দিয়ে দেখে যাচ্ছেন। আমি এখনো যেটা উপভোগ করি, বিশেষ করে বইমেলায় নিজ জায়গায় আসন করে নেয়া কিছু কবি-লেখক যখন বলে, অন্যদিন-এ আপনি আমার প্রথম লেখা ছেপেছিলেন। অন্যদিন-এর আরও অন্য বিভাগের, কম্পিউটার বিভাগের আরও যাঁরা আছেন, অনেকে আছেন, অনেকে অন্য জায়গায় গেছেন। তাদের সবার সঙ্গে আমার অনেক অনেক আন্তরিক আর মজার সম্পর্ক ছিল। একসময় আমি আমার ডানদিকের রুমে না ঢুকে বাঁ দিকের বিভিন্ন টেবিলে বসা ওদের ওখানে দুম করে চেয়ার নিয়ে কত কত দিন বসে সবার খোঁজ নেয়া থেকে শুরু করে কত জম্পেশ আড্ডাই না দিয়েছি! এমনভাবে কথাগুলো বলছি, যেন এখন আমি অন্যদিন-এ নেই। আসলে অন্য কোথাও যাই না যাই অন্যদিন-এর সব অনুষ্ঠানে আমি যাই। আমি এখনো যুক্ত আছি অন্যদিন-এ।

আরেকটা জোরালো কারণ, আমি কঠিন অসুখে পড়ে টানা মৃত্যুময় দশা থেকে উঠেছি। এর আগে বার কয়েক ভেবেছিলাম, ফের জোরেশোরে সাহিত্য পাতা দেখা শুরু করব। আমার একটা রুম মাজহার ভাইদের সাজিয়ে দিতে বলব। অবশ্য সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার পর কেমন যেন উদ্যম মরে যায়। ফুলটাইম চাকরি আমার রক্তে নেই।

আমার প্রায় প্রতিটি বই অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয়। বছরে একটি উপন্যাস লিখলে অন্য পত্রিকার অনেক আকুতি থেকে বেরিয়ে তা অন্যদিন ঈদসংখ্যায় দিই। ছিলাম, আর বলব না। আমি অন্যদিন-এর সঙ্গে আছি।

মূলকথা হলো, অন্যদিন-এর সঙ্গে জমজমাট আড্ডা, লেখা বিনিময়ে মুখর থাকা হুমায়ূন আহমেদসহ আগেই যাঁদের কথা লিখেছি, তাঁদের অনেকেই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। অন্য যারা আছেন, করোনা আগ্রাসন মানুষের জীবন থেকে শুরু করে অনেক উল্লাস কেড়ে নিয়েছে। সমস্ত সংস্থার মতো অন্যদিন-এ এর প্রচ্ছায়া পড়েছে বৈকি। মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। এরমধ্যে অন্যদিন পঁচিশ বছর পূর্তিতে এমন একটি সংখ্যা করার উদ্যোগ নিয়েছে, এ কম কথা নয়।

খারাপ-ভালো সব সময় যেভাবে আপনারা আগে থেকেছেন, থাকবেন প্রত্যাশা করি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.