সন্ধে নামতে আর কিছু সময় বাকি। শহরের উঁচু বহুতলা দালানগুলোর পেছনের দিকে, যেখানে আলো পৌঁছায় না ঠিকঠাক, সেখানে এক টুকরো বস্তি, নাম নেই, ঠিকানা নেই। চারপাশে নর্দমার গন্ধ, বৃষ্টির পানি জমে থাকা কাদামাটি আর আবর্জনায় স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া মাটির রাস্তা। মাঝেমধ্যে ভেজা কাপড় শুকাতে টাঙানো দড়িগুলোতে হাওয়া লাগে, একটা ছেঁড়া জামা ধপ করে পড়ে যায় কাদায়। কারও নজর পড়ে না। এই গলি দিয়ে হেঁটে আসছে একজন মানুষ। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ—ময়লাপরিষ্কারক। শহরের নর্দমা, বর্জ্য, মানুষের বমি আর পচা খাবারের সঙ্গে যার দিনরাত এক হয়ে গেছে। হ্যাংলা শরীরটা হেলেদুলে হাঁটছে দ্রুত পায়ে, যেন কিছু লুকানোর আছে। গায়ের জামাটা ময়লা আর ঘামে ভিজে চুপচুপে। পলিব্যাগে মোড়া একটা জিনিস ধরা তার ডান হাতে। ব্যাগটা খুব সাধারণ, তবু চোখ আটকে যায়...ব্যাগের গায়ে লাল ছোপ, যেন রক্ত।
চারপাশে ছেলেপিলেরা চ্যাঁচামেচি করছে, কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেজা পলিথিনে পান্তাভাত খাচ্ছে। কেউবা চুলার সামনে হাঁসফাঁস করছে, জ্বলছে শুকনো পাতার ধোঁয়া। এইসব চেনা কোলাহলের মাঝে ওই মানুষটা যেন সবার অচেনা। বেশি দিন হয় নি সে স্ত্রী-সহ ঢাকা শহরে উঠেছে।
তার হাঁটার ভঙ্গিতে অস্বস্তি। চেহারায় অস্থিরতা। মাঝেমাঝে সে পিছনে তাকায়, হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়, আবার হাঁটে। তার চোখের মধ্যে কিছু আছে—ক্লান্তি নয়, ভয়ও নয় পুরোপুরি...যেন গিলে রাখা কোনো গোপন হিংস্রতা।
বস্তির ভেতরে আরও গলি আছে, গলির ভেতর গলি। সেইসব সরু, আঁধারে গলে যাওয়া পথ ধরে সে এগিয়ে যায় তার একচিলতে টিনের ঘরের দিকে। চারপাশে শব্দ—ভাঙা রেডিওর গান, কাশির দমকা আওয়াজ, শিশুর কান্না, তবু তার ভেতরে নীরবতা। আজ সন্ধ্যাটা যেন বস্তিতে অন্যরকম ভারী। আর সেই পলিব্যাগ, যার ভেতরের বস্তুটা এখনো নড়ছে কি না, কেউ জানে না। শুধু এক কুকুর, দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, ব্যাগটার গন্ধে একবার গা ঝাঁকিয়ে পেছনে সরে গেল।
গলির একদম শেষ মাথায় তার ঘরটা। টিনের ছাউনি ছিড়ে একপাশ ঝুলে পড়ে আছে, দরজার জায়গায় মচমচে একটা পর্দা—ময়লার দাগে কালচে হয়ে গেছে। ঘরের সামনে পা রাখা মাত্র চটচটে কাদা। একটা বিড়াল ছায়ার মতো পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেল। ভেতরে অন্ধকার, গুমোট একটা গন্ধ।
সে দ্রুত পা ফেলে ঢোকে। ব্যাগটা কাঠের ওপর রাখে, তারপর ঝুঁকে এক ঝাপটায় চোখ-মুখে কলসির ঠান্ডা পানি ছিটায়। পানির ফোঁটাগুলো গাল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু ভেতর থেকে সেই ক্লান্তির ছায়া মুছে যায় না। নিচু গলায় স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে—এই...শেফালি, এই...
কোনো উত্তর নেই।
সে একটুখানি থেমে শোনে, নিঃশব্দতা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। যেন ঘরটা নিশ্বাস বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় না। শুধু নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা রাখে মাটিতে, পাশে একটা স্টিলের থালা পড়ে আছে। গত রাতের অবশিষ্ট পান্তাভাত।
সে পলিথিন ব্যাগটা খুলে একটানে ভেতরের বস্তুটা তুলে নেয়—নরম, ভেজা, আরেকটু হলে পিছলে যেত হাত থেকে। ত্রিকোণাকার। কালচে লাল রং। থ্যাবড়া হয়ে গেছে চাপ লেগে। তবু স্পষ্ট বোঝা যায়—এটা মানুষের কলিজা।
সে নিঃশব্দে সেটা ভাতের ওপরে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে সাদা ভাত লাল হয়ে ওঠে। পাতলা রক্তের ছোপ ভাতের ফাঁকে গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একটা টকটকে, কাঁচা রক্তের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সে বসে পড়ে থালার সামনে। কাঁপা হাতে কলিজাটা কচলে কচলে ভাতের সঙ্গে মেখে নেয়। আঙুলে রক্ত, নখের খাঁজে মাংসের টুকরো। মুখে তোলে এক লোকমা, তারপর আরেকটা। চোয়ালে লেগে থাকা কাঁচা মাংসের স্নিগ্ধতা তার চোখে একটা অন্যরকম প্রশান্তি আনে। এক চিলতে হাসি ফোটে ঠোঁটের কোণে—যেন বহুদিন পর পাওয়া প্রাপ্তির পরিতৃপ্তি।
আস্তে আস্তে চিবিয়ে গিলে মনে মনে বলে, আজকে সেই একখান জিনিস ছিল! তাজা...কাঁচা গন্ধ...কম বয়সী মেয়ে। আহ্...
ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা তার স্ত্রীর নিথর শরীরের দিকে একবারও তাকায় না সে। তাকে যেন দরকার নেই এখন। আজকের খাবারটাই সব। ঘরের মধ্যে তখন একধরনের নীরব হাহাকার। আর ভাত-রক্ত-মাংসের এক বিকৃত শান্তি।
সে পলিথিনের মুখটা গুটিয়ে রাখে পাশে। এক হাতে থালা, অন্য হাত ভাতের গাদায় আঙুল ঢুকিয়ে মেখে চলেছে। রক্ত মাখানো আঙুলটা মুখে তোলার আগে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে—যেন সে এখনো বেঁচে আছে, যেন এখনো শোনে।
জানিস শেফালি...আইজকা হালার কপালডা বড্ড ভালা আছিল রে। হঠাৎ এমনভাবে হেসে ওঠে—যেন গল্প শোনাতে গিয়ে নিজেই আনন্দে কেঁপে উঠছে।
এই বৃষ্টির দিনে কামে যাইয়া আফসোস হইতাছিল, ভাবতাছিলাম ক্যান যাইলাম ? মাথা ধইরা আছিল। ভাবছিলাম, বিকাল বেলা একটু ঘুমাইলেই পারতাম রে...কিন্তু, কয়ডা বাসা ঘোরার পর যে জিনিসটা পাইলাম—ইশশ!
তার চোখ তখন জ্বলজ্বল করে, যেন কোনো শিকারি নিজের সাফল্যের গল্প বলছে।
ওই মাইয়ার বয়স হইবো ১৭/১৮, একদম কচি...আইজকা ওর মা ঘরে আছিল না। আমি সেদিন জিগাইলাম, তার মায় কইল, ‘আমার আর মাইয়া ছাড়া কেও নাই ঘরে।’ মহিলাডা বেশ মিশুক, বুঝলা ? সে থালায় হাত চালায়, ভাতের মাঝে রক্ত-কলিজা মেখে নিচ্ছে মসৃণভাবে, চেনা অভ্যেসে।
আঁতকাই আমার লোভ উঠল শেফালি... তুই নাই দুই দিন, আর দুই দিন তো ঠিকমতো খাইতে পারি নাই। সেই যে কবে তোরডা খাইলাম...
একটা গা-ঠান্ডা করা বিরতি নেয়। যেন স্ত্রীর শরীরের কথাও স্মৃতি হয়ে গেছে তার কাছে। কোনো তাজা দুঃখ নয়, পুরোনো এক মাংসের গন্ধ।
সে আবার হেসে ওঠে, এবার গলার স্বরটা নিচু, তৃপ্তিতে মোচড়ানো—আমি মাইয়াডারে কইলাম, ‘আমারে একটু পানি খাইতে দাও মা।’ মাইয়াডা কিছু না কইয়া ভেতরে চলে গেল পানি আনতে। জানিস, তখন আমি একটাও শব্দ না তুইলা...একটুও না...চুপচাপ পিছনে গেছি।
তার আঙুল থেমে যায় এক মুহূর্ত। রক্ত লেগে থাকা আঙুলটা ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে চুষে নেয় ধীরে ধীরে। চোখ বন্ধ করে বলে—যখন ঘরে ঢুকি, তখনই শুরু হইছে বৃষ্টি। বৃষ্টি তো না, এত জোরে ঠাডা পড়তাছিল, বৃষ্টির তোড়ে অন্য কোনো শব্দ কানে আসে না।
তার ঠোঁটে একটা বিকৃত হাসি খেলে যায়। চাঁন কপাল আছিল আইজ। তা নাহলে অই মাইয়ার ঘরে ঢুকা হইত না। আর এই জিনিসটা, আহ্...
সে ভাতের শেষ দানাটা আঙুল দিয়ে চেপে মুখে দেয়। আঙুলটা পরে ঠোঁট দিয়ে চেটে নেয়, ধীরে। যেন কিছু অবশিষ্ট রাখা যাবে না, একফোঁটাও না। বাইরে তখন ঘন বৃষ্টি, আর ভেতরে একটা স্যাঁতস্যাঁতে, লালচে নিশ্বাসে ভরা ঘর। রক্ত-মাংস, ক্ষুধা আর এক শিকারির নির্বিকার একাকিত্ব।
বেশি কিছু করা লাগে নাই, বলে সে হালকা ভঙ্গিতে, শুধু কাচের জগটা দিয়া একখান মারছিলাম মাথায়। একবারেই শেষ। চিক্কুর দিছিল, কিন্তু কেউ শোনে নাই। বৃষ্টির শব্দ এমন আছিল, আমি জানতাম কেউই শুনতে পারব না।
সে হাতের আঙুলে জমে থাকা রক্ত ধুয়ে নিচ্ছে গামলাভর্তি ময়লা পানিতে। গড়িয়ে পড়ে লালচে ধারা, কিন্তু তার দৃষ্টি অন্যমনস্ক, চেহারায় যেন তৃপ্ত এক গল্প শেষ করার পর ফাঁকা হাওয়ার মতো হালকা ভাব।
আর বেশি কষ্ট দেই নাই রে...খালি বুকটা ফাইড়া কলিজাটা বাইর করছি। আহ্! কলিজার গন্ধই আলাদা, আর যদি হয় কচি...ইশশ! আবার কবে জোটে কে জানে!
হাত ধুয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। গা এলিয়ে দেয় তার কাঠের ভাঙা তক্তপোশে। চটের ছেঁড়া বিছানা, বালিশে মাথা না রেখেই শরীরটা ফেলে দেয়, যেন অনেক পরিশ্রম শেষে শান্তি পেয়েছে।
তার পাশেই, দেয়ালে, হেলান দিয়ে বসে আছে শেফালি। শরীরে এক টুকরো সুতাও নেই। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত কাটা। শরীরজুড়ে জমে আছে কালচে লাল রক্ত। কাঁধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শুকনো রক্তে চটচটে হয়ে গেছে। মাথা এক পাশে হেলে আছে, চোখ অর্ধেক খোলা।
সারা ঘরে এখন একটা গা-জ্বালানো গন্ধ, মরা মানুষের। পচন ধরা শুরু। এই গন্ধ ধীরে ধীরে কেবল ঘরেই নয়, পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়বে। কেউ একজন হয়তো শুঁকে বুঝবে—কিছু একটা অস্বাভাবিক। কেউ দরজা ঠেলে ঢুকে দেখবে, শেফালির ফাঁড়া শরীর, আর পাশে পড়ে ঘুমিয়ে থাকা তার নিজের স্বামী, যেন অগভীর, নিশ্চিন্ত ঘুম।
কিন্তু সে ?
সে কিছুই ভাবে না। না লাশ, না গন্ধ, না ধরা পড়া, না বিচার, কোনো চিন্তা তাকে স্পর্শ করে না। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটাই চিন্তা, পেট ভরছে...এখন একটু ঘুম দরকার।
Leave a Reply
Your identity will not be published.