শীতল পাটি : আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ

শীতল পাটি : আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ

কৃষিভিত্তিক আমাদের এই বাংলাদেশে কুটির শিল্পের ইতিহাস-ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। বছরের সব সময় এদেশের কৃষকদের হাতে কাজের চাপ একরকম থাকে না। বাড়তি উপার্জনের আশায় এদেশের কৃষকেরা বাড়িতে নানারকম কুটির শিল্পকর্মে নিজেদের নিয়োজিত করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকে।

বাংলাদেশের কুটির শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও এদেশের শীতল পাটির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। শীতল পাটি এক ধরনের মেঝেতে পাতা আসন বা গালিচা। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প। মুর্তা বা পাটি বেত বা মোস্তাক নামক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। হস্তশিল্প হিসেবে এগুলোর যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সত্তরের দশকে আমার ছোটবেলায় নানি-দাদিদের শীতল পাটি ব্যবহার করতে দেখেছি। গরমের মৌসুমে আমাদের আরামে ঘুমানোর জন্য ওনারা শীতল পাটি বিছিয়ে দিতেন। আমরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসে চলতি শতাব্দীর প্রথম দিকে। যখন-তখন বিদ্যুৎ চলে যাওয়া সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাতে ঘুমাতে শীতল পাটির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। যে কারণে  আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে শীতল পাটির ব্যবহার এখনো ধরে রেখেছি। বাড়িতে অতিথি এলে ঘরের মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করা হতো। এখন শীতল পাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে আধুনিক ডাইনিং টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ৷ গ্রামের মাটি কিংবা টিনের তৈরি ঘরের জায়গায় গড়ে উঠেছে এখন আধুনিক দালানকোঠা। আধুনিক টাইলসের মেঝেতে শোভা পাচ্ছে শীতল পাটির পরিবর্তে দামি সিনথেটিক বিদেশি কার্পেট।  পিড়িতে কিংবা শীতল পাটিতে বসে খাওয়ার সংস্কৃতি অনেক আগেই গ্রামের উচ্চবিত্ত বাড়িগুলো থেকে হারিয়ে গেছে। তবে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা পিঁড়ি , মাদুর কিংবা খেজুর পাতার পাটিতে আসন পেতে বসে খাওয়ার অভ্যাস এখনো ধরে রেখেছে।

শীতল পাটির নামের মধ্যেই এর গুণ নিহিত রয়েছে। এর বৈশিষ্ট্য গরমে ঠান্ডা অনুভূত হয়। গুল্ম জাতীয় এক ধরনের মুর্তা গাছের বেত দিয়ে তৈরি মসৃণ মাদুরের নাম শীতলপাটি। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হওয়ায় শীতলপাটি স্বাস্থ্যসম্মত। নয়নাভিরাম বৈপরীত্যে বুননের সুক্ষè ছিদ্র দিয়ে ব্যবহারকারীর শরীরের ঘাম শুষে নিয়ে অঙ্গ শীতল করে বলে এর নাম শীতল পাটি। প্রচণ্ড গরমে এ পাটির শীতল স্পর্শ ব্যবহারকারীর দেহ ও মনে আরামদায়ক অনুভূতি এনে দেয়। রকমারি নকশায় সজ্জিত মাদুরকে নকশি পাটিও বলা হয়ে থাকে।

শীতল পাটির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। শীতল পাটিতে বসে বা শুয়ে যে আরামপ্রদায়ী শীতল অনুভূতি পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যাতীত। আধুনিক নগর জীবনেও বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের আসন হিসেবে শীতল পাটির ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে । শীতল পাটির খণ্ডাংশ অন্যান্য হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী আকর্ষণীয় নকশার জন্য একে ‘নকশি পাটি’ বলা হয়ে থাকে। শহরে আধুনিক সজ্জার উপকরণ হিসেবে বাতির শেড, কার্পেট বা ওয়াল ডেকোরেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাটির খণ্ডাংশ দিয়ে মানিব্যাগ, হাতব্যাগ, টেলিম্যাট এবং অন্যান্য হস্তশিল্পের জিনিস তৈরি করা হয়ে থাকে। অতীতে পাখা টানার জন্য শীতল পাটির ব্যবহার ছিল, যা বিদ্যুতের পাখা না থাকলে গরমকালে অফিস-আদালত , শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। আমার স্কুল জীবনে টানা পাখার ব্যাবহার দেখেছি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে রাখা টুলে বসে একজন নিয়োজিত স্কুল কর্মচারী রশি টেনে আমাদেরকে বাতাস করতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে শীতল পাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।

প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা উপকরণ দিয়ে আমাদের দেশের কুটিরশিল্পীরা তাদের সুনিপুণ কারিগরি হাতে ধৈর্য ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় শীতল পাটি দিয়ে নানাবিধ কারু পণ্য তৈরী করে দেশের অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। শীতল পাটি সহ আকর্ষণীয় বিভিন্ন কুটিরশিল্পজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে আমরা প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি।

বিসিকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কুটির শিল্পে বছরে ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার পণ্য উৎপন্ন হয়। মূল্য সংযোজন হয় ৩১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপিতে যোগ হয়। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর কুটিরশিল্পে ১৭ লাখ কর্মক্ষম লোক যোগ হয়। যা বেকার সমস্যা সমাধানের অন্যতম একটা মাধ্যম বলে বিবেচিত।

শীতলপাটি নিপুণ হাতের বুননে মুর্তা নামে একধরনের ঝোপজাতীয় গাছের বেত দিয়ে তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালে শীতল পরশের জন্য বেড়ে যায় শীতলপাটির কদর। পাটির সঙ্গে ‘শীতল’ নামকরণের মাহাত্ম্য এখানেই। এটি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা মূলত এ শিল্পের আদি স্থান। এর বাইরে সিলেটের গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর; হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখা, রাজনগরসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার দুই শতাধিক গ্রামে শীতলপাটি বুননের সঙ্গে কয়েক সহস্রাধিক পরিবার যুক্ত রয়েছে। যুগ যুগ ধরেই বংশপরম্পরায় এসব গ্রামের নারী-পুরুষেরা এই কাজ করেন।

প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে এই পাটি পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত। সিলেটের চার জেলা ছাড়াও নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় শীতলপাটির কারিগরদের দেখা মেলে। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাটি তৈরি হলেও সিলেটেই বুননশিল্পীদের দেখা বেশি মেলে। এখানে বুননশিল্পীরা বংশপরম্পরায় পাটির বুননকৌশল আয়ত্ত করেছেন। গ্রামের নারীরা তাদের নিপুণ হাতে বুনছেন শীতলপাটি।

শীতলপাটির রয়েছে নানা নাম আর জাত। এর মধ্যে ‘পয়সা’, ‘সিকি’, ‘আধুলি’, ‘টাকা’, ‘নয়নতারা’, ‘আসমান তারা’, ‘শাপলা’, ‘সোনামুড়ি’, ‘টিক্কা’ নামের পাটির ব্যবহার গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে বেশি। এ ছাড়া অভিজাত পাটি হিসেবে ‘লালগালিচা’, ‘ধাধুলি’, ‘মিহি’ চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ‘সিকি’ পাটি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, মসৃণতার কারণে সিকির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না। এসবের বাইরে দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নানা ধরনের পাটি রয়েছে। বুননের মাধ্যমে পাটিতে পৌরাণিক কাহিনিচিত্র, পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা ও মোটিফ তুলে ধরা হয়। পাটিগুলো সচরাচর ৭ ী ৫ ফুট হয়ে থাকে।

যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থেকে শীতল পাটি তৈরী করা হয় তার স্থানীয় নাম ‘মুর্তা’। স্থানভেদে একে ‘মুসতাক’, ‘পাটিবেত’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। মুর্তা গাছ দেখতে সরু বাঁশের মতো; জন্মে ঝোপ আকারে। গোড়া থেকে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মুর্তার কাণ্ড। দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে দেওয়া হয়, দূর করা হয় ময়লা। এরপর মাটিতে মাছকাটার বটি ফেলে মুর্তার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগে সাদা নরম অংশকে বলে ‘বুকা’। এই বুকা চেঁছে ফেলে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি পাটি তৈরি করে তাকে বলা হয় ‘পাটিকর’ বা ‘পাটিয়াল’। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরি করে নেওয়া। বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। এজন্য হাতের নখ দিয়ে ছিলে বুননযোগ্য বেতী আলাদা করা হয়ে থাকে। বেতী তৈরি হওয়ার পর এক-একটি গুচ্ছ বিড়ার আকারে বাঁধা হয়। তারপর সেই বিড়া ঢেকচিতে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় এবং আমড়া, জারুল ও গেওলা ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী হয় মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে। রঙিন নকশাদার পাটি তৈরির জন্য সিদ্ধ করার সময় ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে রঙের গুঁড়া মেশানো হয়। দক্ষ কারিগর একটি মুর্তা থেকে ১২টি পর্যন্ত সরু বেতি তৈরি করতে সক্ষম। ছিলে ছিলে বেতী তৈরির সময় পাটিকর বুড়ো আঙুল ও মধ্যমায় কাপড় পেঁচিয়ে নেয় যাতে বেতীর ধারে আঙুল না ফেঁড়ে যায়। পাটিকর মাটিতে বসে কাপড় বোনার মতোই দৈর্ঘ্য-বরাবর এবং প্রস্থ-বরাবর বেতী স্থাপন করে নেয়। পাটি বোনার সময় বেতীগুলোকে ঘন আঁটসাঁট করে বসানো হয় যাতে ফাঁক-ফোকড় না-থাকে। নকশী পাটির ক্ষেত্রে পাটিকর তার স্মৃতি থেকে বাদামি বা প্রাকৃতিক রঙের বেতীর সঙ্গে রঙিন বেতী মিশিয়ে নকশা তৈরি করে। পাটি তৈরির কাজে সাধারণত মহিলারা জড়িত। তারা গৃহকর্মের অবসরে বিভিন্ন ধরনের পাটি তৈরি করে সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৮০০০ মানুষ শীতল পাটি তৈরির কাজে নিয়োজিত।

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্প-কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্েযর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।  ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় জাতি হিসেবে আমরা অত্যান্ত গর্বিত ।

শীতল পাটির ব্যবহার আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে মিশে রয়েছে। দেশে ও বিদেশে এই পাটির বিশেষ চাহিদা রয়েছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে শীতল পাটি হতে পারে উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য ।

Leave a Reply

Your identity will not be published.