মিসির আলি আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, ‘অবসেশন’ শব্দটার বাংলা কী বলুন তো!
আমি খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেলাম। চট করে মাথায় কিছু আসছে না। তাই তো, অবসেশনের ঠিক বাংলাটা কী?
মিসির আলি মিটিমিটি হাসছেন। সচরাচর তাঁকে হাসতে দেখা যায় না। তাঁর হাসি দেখে ভালো লাগছে। বেচারা দীর্ঘদিন রোগভোগ করে কাহিল হয়ে আছেন। পনেরো দিন পর গতকাল প্রথম শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আমি গিয়েছি রোগী দেখতে।
মিসির আলি আবার বললেন, অবসেশনের বাংলা বলতে পারছেন না, তাই না?
আমি বললাম, মাথায় আসছে। মুখে আসছে না।
মিসির আলি বললেন, ইংরেজি অনেক শব্দ আছে যার ঠিক বাংলা নেই। আবার অনেক বাংলা শব্দও আছে যার ইংরেজি হয় না। যেমন- ‘অভিমান’। অভিমানের ইংরেজি বলতে পারবেন?
আমি বললাম, ভাষাতত্ত্ব থাকুক, আপনার শরীর কেমন বলুন।
মিসির আলি বললেন, শরীর সেরে গেছে। এই জন্যে মনটা সামান্য খারাপ।
শরীর সারায় মন খারাপ কেন?
মিসির আলি বললেন, শরীর যখন খুব খারাপ থাকে, তখন মনের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। এই অবস্থাটা আমার পছন্দের। ঘোরলাগা অবস্থায় কোনো কিছু ভাবতে ভালো লাগে।
আমি বললাম, চেষ্টা করুন আবার যেন অসুখে পড়তে পারেন। শীতের সময় আছে, ধানমন্ডি লেকের নোংরা পানিতে ডুব দিয়ে এলে কেমন হয়?
খারাপ হয় না। চলুন যাই।
মিসির আলি খাট থেকে নেমে গেলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। উনি কি সত্যি লেকে গোসল করার কথা ভাবছেন? মিসির আলী জাতীয় মানুষরা উদ্ভট কর্মকাণ্ড পছন্দ করে। আমি বললাম, যাচ্ছেন কোথায়?
মিসির আলী বললেন, আপনাকে একজন মানুষের ছবি দেখাব।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মিসির আলী বললেন, আপনি কী ভেবেছিলেন? লেকে গোসল করার জন্য টাওয়েল আনতে যাচ্ছি!
আপনাকে দ্রুত খাট থেকে নামতে দেখে সেরকমই ভেবেছি।
আমি খুবই সাধারণ মানুষ। ‘অ্যাকসেনট্রিক’ কেউ না। আমি একজন অ্যাকসেনট্রিক মানুষের ছবি আপনাকে দেখাব। ভালো কথা, ‘আকসেনট্রিক’ শব্দটার বাংলা বলুন তো?
আমার হাতে একজন বুড়ো মানুষের সাদাকালো ছবি। মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতো চুল। সব চুল সাদা। বড় বড় চোখ। তিনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।
মিসির আলী বললেন, ছবি দেখে লোকটাকে কেমন মনে হচ্ছে?
ভালোমানুষ মনে হচ্ছে।
ভালোমানুষ মনে হচ্ছে কেন? চোখ বড় সেই জন্যে? সরু চোখের মানুষরা ভালো হয় না? সব জাপানি কি খারাপ?
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না। কী বলবেন বলুন।
মিসির আলী বললেন, ভদ্রলোকের নাম মোহম্মদ সালাম। কৃষি ব্যাংকে
কাজ করতেন। এখন রিটায়ার করেছেন। অতি ভালোমানুষ। দুই ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে সুখী সংসার। তাঁর বড় ছেলেটি ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।
ভদ্রলোকের ছবি নিয়ে ঘুরছেন কেন?
একটু আগে ‘অবসেশন’ শব্দটা নিয়ে কথা বললাম না? ঐ ভদ্রলোকের একটা ভয়াবহ অবসেশন আছে। যখন আমি অসুখে পড়েছিলাম তখন ভদ্রলোকের অবসেশনটা নিয়েই ভেবেছি। তাঁর অবসেশনের গল্পটা শুনবেন?
শোনার মতো হলে শুনতে পারি।
শোনার মতো তো বটেই, তবে ছোট্ট সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
ভদ্রলোকের গল্প শুনলে তাঁর অবসেশন আপনার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। তার ফল শুভ হবে না।
গল্পটা বলুন।
মিসির আলী বললেন, চা বানিয়ে আনি। চা খেতে খেতে বলি। আপনি খাটে পা উঠিয়ে আরাম করে বসুন।
আমি আরাম করে বসেছি। চা খাচ্ছি। রাত নয়টার মতো বাজে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মিসির আলী খাটে হেলান দিয়ে গল্প বলছেন।
মোহম্মদ সালাম সাহেব এ রকম এক বর্ষার রাতে বাড়ির সবাইকে নিয়ে টিভিতে কী একটা নাটক দেখছিলেন। হাসির কোনো নাটক। সবাই হাসছে। তিনি হাসছেন। নাটকের মাঝখানে হঠাৎ তিনি উঠে বারান্দায় চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ হলো তিনি ফিরছেন না। তাঁর স্ত্রী, উনার নাম মহল, স্বামীর সন্ধানে বারান্দায় এসে দেখেন- ভদ্রলোক বেতের চেয়ারে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন।
মহল বললেন, কী হয়েছে, নাটক দেখবে না?
সালাম সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর চোখ চকচক করছে। মহল বিস্মিত হয়ে বললেন, কাঁদছ না-কি?
সালাম সাহেব চাপা গলায় বললেন, মহল, আমি আমার জীবনে ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ করেছি। অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার। আমি কাল থেকে প্রায়শ্চিত্ত শুরু করব।
মহল বললেন, কী অপরাধ করেছ?
সালাম জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে রাখলেন।
মহল বললেন, অফিসের টাকা-পয়সা মেরে দিয়েছ?
সালাম বললেন, ছি! তুমি আমাকে চেনো না?
মহল বললেন, তাহলে কী? অফিসের কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে? তাকে নিয়ে হোটেল ফোটেলে গেছ? রুম ভাড়া করেছ?
সালাম বললেন, ছি ছি!
মহল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে উঠে আস।
সালাম বললেন, না।
মহল বললেন, নাটক না দেখলে ভাত খেতে আস। ঝিম ধরে বসে থাকবে না।
সালাম সাহেব উঠে গেলেন। স্বাভাবিকভাবে ভাত খেলেন। জর্দা দিয়ে
পান খেলেন। দিনের শেষ সিগারেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। মাঝরাতে মহলের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, সালাম শোবার ঘরের কাঠের চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মহল বললেন, এই কী হয়েছে?
সালাম বললেন, কিছু না।
চেয়ারে বসে আছ কেন?
ঘুম আসছে না।
ঘুম আসছে না কেন?
পাপটা মাথায় ঘুরছে। ভয়ঙ্কর একটা পাপ করেছি মহল।
মহল বললেন, খুন করেছ কাউকে?
সালাম বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি খুন করব মানে? কাকে খুন করব?
মহল বললেন, পাপটা তাহলে কী? বলো আমাকে?
সালাম মাথা নিচু করে রইলেন। কিছু বললেন না।
মহল বললেন, ঘুমের ওষুধ দেই, খেয়ে ঘুমাও।
সালাম বললেন, দাও।
তিনি দু’টা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে সারারাত জেগে বসে রইলেন। তাঁর সমস্যা সে-রাত থেকেই শুরু হলো।
চাকরি শেষ হওয়ার আগেই রিটায়ারমেন্টে চলে গেলেন। আলাদা ঘরে বাস করতে লাগলেন। সারাদিন একা থাকেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। রাতে ঘুমান না। তাঁকে বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো। সাইকিয়াট্রিস্টরা রোগ ধরতে পারলেন। রোগের নাম অ্যাকিউট অবসেশন। কোনো একটা বিষয় মাথার ভেতর গভীরভাবে গেঁথে গেছে। এই রোগ সারাতে হলে পাপটা কী তা জানতে হবে। সালাম সাহেব এই বিষয়ে কিছুই বলবেন না। তাঁর স্ত্রী নানানভাবে চেষ্টা করলেন। যেমন— মহল: শোন, তুমি কি বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে কিছু করেছ? করে থাকলে বলো। আমি কিছুই মনে করব না।
সালাম: ছি মহল, ছি! আমি কি এত ছোট!
মহল: অফিসের গাড়ি নিয়ে আসার সময় গাড়ির ড্রাইভার কাউকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে?
সালাম: না।
মহল: আচ্ছা শোন! তুমি কি সমকামী? এই নিয়ে কোনো সমস্যা? সালাম: মহল, তুমি আমাকে নিয়ে এত নোংরা চিন্তা কীভাবে করছ?
এই পর্যায়ে সালাম সাহেবের স্ত্রী আমার কাছে কেঁদে পড়লেন। তার ধারণা আমি কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। সাধারণ কথাবার্তা। আমি তাঁকে চা খেতে দিলাম। তিনি আগ্রহ নিয়ে চা খেলেন। আমি বললাম, ভাই পাশের ডেফিনেশন কী? কোনটাকে আপনি পাপ ভাবেন?
তিনি বললেন, যেটা ইমমোরাল সেটাই পাপ।
আমি বললাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোরালিটি বদলায়। একটা সময় ছিল যখন বিবাহ নামের ইনস্টিটিউশন তৈরি হয় নি। তখন যে-কোনো ছেলে যে-কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে পারত। কেউ বিষয়টাকে ইমমোরাল ডাবত না। এখন ভাবে।
সালাম সাহেব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি।
আমি বললাম, আপনি কি কোনো ইমমোরাল কাজ করেছেন?
তিনি বললেন, জি-না, তবে তার চেয়েও অনেক বড় পাপ করেছি।
সেটা কী আপনি বলবেন না?
জি-না।
আপনার কারণে আপনার স্ত্রী কষ্ট পাচ্ছেন। আপনার বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে। এটাকে কি আপনার পাপ বলে মনে হয়?
সালাম সাহেব বললেন, জি পাপ। তবে আমি যে পাপ করেছি তারচেয়ে অনেক ছোট পাপ।
এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন?
জি। যেদিন প্রায়শ্চিত্ত শেষ হবে সেদিনই আমি স্বাভাবিক হয়ে যাব। আমি আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
তিনি কি ক্ষমা করবেন?
বুঝতে পারছি না। যে ভয়ঙ্কর পাপ করেছি ক্ষমা পাওয়ার কথা না। তারপরেও তিনি রহমানুর রহিম।
সালাম সাহেব এক পর্যায়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছের নিচে পাটি পেতে বসে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ।
মিসির আলী বললেন, গল্প শেষ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, গল্প শেষ মানে? সালাম সাহেবের কী হলো? উনি পাপটা কী করেছেন বলবেন না?
মিসির আলি হাই তুলতে তুলতে বললেন, সালাম সাহেবের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে পাপটা কী সেটা মনে হয় জানি। অসুস্থ অবস্থায় যখন বিছানায় পড়েছিলাম তখন চিন্তা করে বের করেছি।
আমি বললাম, বলুন শুনি।
মিসির আলী বললেন, আমি গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম সালাম সাহেবের গল্পটা না শোনা ভালো। শুনলে এই গল্পটা মাথায় ঢুকে যাবে। এখন তাই হয়েছে। গল্পটা আপনার মাথায় ঢুকে গেছে। এই গল্প মাথায় নিয়ে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। অসংখ্যবার আপনার মনে হবে, সালাম সাহেব পাপটা কী করেছিলেন? উত্তর পাবেন না।
আমি বললাম, আপনি সত্যি বলবেন না?
মিসির আলী গম্ভীর গলায় বললেন, না।
Leave a Reply
Your identity will not be published.