[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধÑসব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এমনকি সংস্কৃতিতেও। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]
কামিনী রায় (সেন) ও যামিনী সেন : কামিনী রায় (সেন) ও যামিনী সেন বরিশালের মেয়ে। তাঁদের পিতা মুন্সেফ ছিলেন। কামিনী রায় জানান, তিনি যখন বড় হচ্ছেন মেয়েদের পড়াশোনাকে সমাজে ভালো চোখে দেখা হতো না। ফলে তিনি মায়ের কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। মাটিতে কাঠি দিয়ে লিখে অক্ষরজ্ঞান হয়েছে তাদের। কেউ এলে মাটি লেপে দিয়ে লেখা মুছে দিতেন। খুব অল্পবয়স থেকেই কবিতা লিখেন কামিনী রায়। তাঁর পিতা মেয়ের এই গুণ দেখে খুব খুশি হন এবং তাঁর লেখাপড়ার ব্যাপারে আগ্রহী হন। কামিনী ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী, যিনি অনার্সসহ ব্যাচেলর ডিগ্রি করেছেন (সংস্কৃত সাহিত্যে)। তাঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে এক বড় সরকারি কর্মকর্তা তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর পরেই দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। একে একে কামিনী তাঁর সন্তানদের ও একটি বোনকেও হারান। তাই তাঁর কবিতা দুঃখে ও পরের প্রতি গভীর ভালোবাসায় সিক্ত।
কামিনীর ছোটবোন যামিনীও বাংলার প্রথম উচ্চশিক্ষিত কয়েকজন নারীর একজন। তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবি ডিগ্রি করেও ডাক্তার হিসেবে পশার জমাতে পারেন নি। দেশি ডাক্তারদের বিশেষ করে মেয়ে ডাক্তারদের কেউ গুরুত্বসহকারে নিতে চায় না, যামিনী তখন ইংল্যান্ডে গিয়ে এফআরসিএস পাশ করে ফিরে আসেন, তিনিই ভারতের প্রথম নারী এফআরসিএস। কাদম্বিনী দেবী নেপালের রাজপরিবারের চিকিৎসার ভার যামিনী সেনকে দিয়ে নিজে কলকাতা ফিরে আসতে চাইলে যামিনী তা সানন্দে গ্রহণ করেন। যামিনী চিরকুমারী থাকেন।
সরোজিনী নাইডু ও মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায় : বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দুই কন্যা—সরোজিনী নাইডু ও মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের অতুলনীয় নেত্রী সরোজিনী নাইডু, যিনি গান্ধীর খুব কাছে থেকে রাজনীতি করেছেন, বহুবার জেল খেটেছেন, সেইসঙ্গে ইংরেজিতে লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতার বই। শুধু নারীআন্দোলন বা নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে মিটিং-মিছিল করাই নয়, নারীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রয়াসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। দেশ স্বাধীনতার পরে সরোজিনী নাইডুকে প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনিই সেই নারী যিনি সর্বপ্রথম ভারতের কোনো রাজ্যের রাজ্যপাল হন। সরোজিনী নাইডুকে উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল করা হয়। কিন্তু বেশিদিন যায় না, রাজ্যপাল হওয়ার দু’ বছরেরও আগে তিনি মারা যান। তাঁর কন্যা পদ্মজা নাইডু আরও অনেক পরে পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল হন।
মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায় অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠা কন্যা ও স্বনামধন্যা রাজনীতিবিদ সরোজিনী নাইডুর ছোট বোন। তিনি তাঁর বড় বোনের মতো বরাবর সাংবিধানিক রাজনীতিতেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করেন এবং মৃণালিনীই প্রথম নারী যিনি কেম্ব্রিজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ‘ট্রাইপ্স্’ লাভ করেন। একসময় মৃণালিনী ভারতের মুক্তিআন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি তাঁর বড়ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জার্মানিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে কাজ করেন।
আন্নু, গান্নু, নওয়াবীন : আরও অনেক গুণী বাইজির মতো পাটনা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আবেদী বাঈ। ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন তিনি। আবেদির তিন কন্যা—আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন। এই তিন বোনই অত্যন্ত গুণী ছিলেন, কী সংগীতে, কী নৃত্যের ভঙ্গিমায়। তাঁরা নওয়াব আবদুল গনির দরবারে নিয়মিত নাচতেন, গাইতেন এবং মাসোহারা নিতেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুনাম করেছিলেন নওয়াবীন। তিনি ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং ছিলেন ঢাকাতেই। মুনতাসীর মামুনের কথানুসারে, এই তিন বোনই ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ ভাড়া করে ১৮৮০ সালের নভেম্বরে টিকিটের বিনিময়ে ‘ইন্দ্রসভা’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ঢাকায় নারীদের নিয়ে এটিই ছিল প্রথম মঞ্চায়িত নাটক।
অনেকে মনে করেন একক রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় প্রতিভা, পাণ্ডিত্য ও সৃজনশীলতায় ঢাকা পড়ে আছে ঠাকুরবাড়ির অজস্র অসামান্য মেধা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার অধিকারী নারী-পুরুষ। একই রকমভাবে একজন অতি বিখ্যাত সহোদরার দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দেওয়া অবদানে আরেক প্রতিভাময়ী, নিষ্ঠাশীল ভগ্নির কর্মাবলি ও ভূমিকা চাপা পড়ে যেতে পারে। সেকথা মনে রেখেই নিজগুণে বিখ্যাত এই নারীদের কর্মাবলি স্মরণ করার চেষ্টা করেছি, যাঁরা তাদের অনুজা বা অগ্রজার চাইতে তুলনামূলকভাবে কম খ্যাতিসম্পন্ন হলেও তাঁদের নিজস্ব অবদান অগ্রাহ্য করার মতো নয়। আর সে-কথা মনে রেখেই এই জোড়া-উপস্থাপনা। অবশ্য কোনো কোনো ভগ্নিযুগল রয়েছেন, যারা প্রায় উভয়েই সমান স্বনামধন্যা।
তৃতীয় পর্ব
প্রথমা : বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অর্জন/সাফল্য/প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে
সর্বপ্রথম নারী
নিচের তালিকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে/বিষয়ে যে-নারী প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্জন করেছেন, তাঁর নাম, অর্জনের বছর এবং অর্জনের রকম/ধরন উল্লেখিত হলো।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ : বৈদিক যুগের প্রারম্ভের নারী ঋষিগণ যাঁরা মৌলিক শ্লোক রচনা করে গেছেন : যেমন গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ী, শাশ্বতী, বাক, লোপামুদ্রা
৮০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ : কথিত আছে এই দীর্ঘ সময়ের কোনো বিশেষ ক্ষণে খনার জন্ম হয়। ঐতিহাসিক চরিত্র বরাহর আত্মীয়া বলে পরিচিত খনাকে বয়সোপযোগী করতে কেউ কেউ খনার বয়স ষষ্ঠ শতাব্দীরও বলে থকেন।
১৩০০ : রামী; নিরক্ষর রামী কবি ছিলেন। বিখ্যাত কবি চণ্ডিদাসের রজোকিনী প্রেমিকা।
১৪০০ : মাধবী। চতুর্দশ শতাব্দীর নারী কবি মাধবী প্রকৃতপক্ষেই নারী ছিলেন নাকি নারীর ছদ্মনামে কোনো পুরুষ কবি ছিলেন, নাকি নারী ভাবাপন্ন পুরুষ কবি ছিলেন, সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে। মাধবীর তিন-চারটির বেশি কবিতা উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
১৫৫০ ষোড়শ শতাব্দী : বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর শতক।
১৫৫০ : বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর জন্ম। ।
১৫৭৫ : প্রথম যে নারী বাংলায় ‘রামায়ণ’ অনুবাদ করেন তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী।
১৭৯৫ : মঞ্চনাটকে প্রথম যে দুই বাঙালি নারী অভিনয় করেন, যাঁদের নাম সুখময়ী ও ভাগ্যবতী, যাঁরা গেরাসিম স্তেপানোভিচ লিয়েবেদেফের ‘কাল্পনিক সংবদল’ নাটকে অভিনয় করেন কলকাতার বেঙ্গলি থিয়েটার্সে ১৭৯৫ সালে।
১৮৪৯ সালে মেয়েদের জন্যে কলকাতায় বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে এই স্কুলে পড়তে আসা সর্বপ্রথম কয়েকজন ছাত্রীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যৈষ্ঠা ভগ্নী সৌদামিনী দেবী।
Leave a Reply
Your identity will not be published.