আশার ভেলায় ভেসে…

আশার ভেলায় ভেসে…

‘জিন্দেগি এক সাফার হ্যায় সুহানা, ইহা কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা...’-এই গানের পংক্তিগুলো দিয়েই সব সময় নিজের জীবনকে ব্যাখ্যা করেন কিংবদন্তি আশা ভোঁসলে। জীবন যে স্থির নয় সেই ব্যাপারটাই তিনি উপভোগ করেন জীবনে বারবার।

সংগীতপ্রেমী মানুষের কাছে এই নামটির পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রজন্মের পর প্রজন্মে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের লাবণ্য আজও শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করে। শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে মেলোডি, পপ বা লোকসংগীত—সবই হৃদয় স্পর্শ করে আশার সুর মাধুর্যে।

ভারতীয় সংগীত জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আশা ভোঁসলে। গত ৮ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ৯০তম জন্মদিন। দীর্ঘ এ জীবনে চড়াই-উতরাই আর অভিজ্ঞতায় ভরপুর গল্পই আজ আমরা জানব।

শৈশব

আশা ভোঁসলে জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩ সালে, ভারতের সাঙ্গলিতে। তাঁর বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর, যিনি মারাঠি সংগীত মঞ্চের একজন অভিনেতা ও শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। অন্যদিকে আশা ভোঁসলের মায়ের নাম সেবন্তী।

বড় বোন লতা মঙ্গেশকর, সেজ বোন হলেন আশা। মেজো বোন মীনা। আশার পরের বোন ঊষা আর ছোট ভাই হৃদয়নাথ।

পরিবারের হাল ধরতে লতা সংগীত অঙ্গনে নিজের নাম লেখাতে শুরু করেন এবং একসময় জনপ্রিয়তায় শীর্ষে উঠেন। একই পরিবারের দু’বোন যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে সংগীতাঙ্গনে জায়গা করে নেন।

সংগীতে হাতেখড়ি

সুরের সঙ্গে মঙ্গেশকর পরিবারের যোগ বহুদিনের। মহারাষ্ট্রের মঙ্গেশকর পরিবারের সুর সফর শুরু হয়েছিল আগেই। দীননাথ মঙ্গেশকরের হাত ধরে। সেই পরিবারেই জন্ম আশা ভোঁসলের।

কিন্তু বেশিদিন বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের সান্নিধ্য পান নি আশা। যে বয়সে বাবার কাছে গানের তালিম নেওযার কথা ছিল, সেই বয়সেই বাবাকে হারান আশা ভোঁসলে। বাবা হারানোর পরে শুরু হয় জীবনের আরেক সংগ্রাম।

বাবা চলে যাওয়ায় পুনে থেকে মুম্বাই চলে আসেন পরিবার। তখনো সংগীতের প্রতি ভালোবাসা বোঝেন নি আশা। নিছকই পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতে গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দুই বোন আশা ভোঁসলে ও লতা মঙ্গেশকর।

এক ইন্টারভিউতে আশা ভোঁসলে বলেছিলেন, ‘আমি গান তৈরি করি নি বরং গান আমাকে তৈরি করেছে। আমার তো খুব সাধারণ জীবনযাপন করার স্বপ্ন ছিল। ওইটাকে বলে টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান নারী। গানের জগতই তো আমাকে গড়েছে।’

আলো-ছায়ায় আশা

গায়িকা হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করা আশার পক্ষে সহজ ছিল না। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে চমৎকার চমৎকার শিল্পীদের রাজত্ব ছিল। তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, সুরাইয়া, সমসাদ বেগমরা বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে রাজস্ব করছেন। সেই সময় আশা বলতে গেলে খানিকটা অবহেলিতই ছিলেন। তাই তিনি আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় ট্যালেন্ট অনুযায়ী ভালো গান গাওয়ার সুযোগ আমি পাই নি।’

নায়িকা নয় বরং খলনায়িকার কণ্ঠেই গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ত আশার। এমনকি যে গানগুলি সেই সময়ের স্বনামধন্য শিল্পীরা গাইতে চাইতেন না, কেবল সেই গানের অফার আসত আশা ভোঁসলের কাছে। যে সকল ছবির বাজেট ছিল কম, সেখানে কাজ পেতেন তিনি। তবুও দমে যান নি আশা ভোঁসলে। একমনে সংগীতের প্রতি অনুরাগ রেখে গান গেয়েছেন এবং নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন।

গানের জগতে যাত্রা

‘আমি কখনো ভাবি নি যে প্লেব্যাক গায়িকা হব। কিন্তু নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করি নি। নিজেকে ভেঙে গড়ে তৈরি করেছি।’ চলচ্চিত্রে গান করার প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আশা বলেছিলেন।

১৯৪৩ সালে মারাঠি গানের মধ্য দিয়ে প্রথমবার কোনো ছবির জন্যে গান করেন তিনি। এরপর হিন্দি ছবির জগতে তার পা রাখা ১৯৪৮ সালে, হংশরাজ বেহলের ছবি ‘চুনারিয়া’ দিয়ে। তবে হিন্দি ছবিতে তাঁর প্রথম একক গান শোনা গিয়েছিল ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রাত কি রানি’তে। তারপর শুধু সামনে এগিয়ে চলা।

মঞ্চের আশা ভোঁসলে

‘আমি জেনে বুঝেই ব্যতিক্রমী স্টাইলে গান করেছি। গৎবাঁধা ধাঁচের গান গাইলে আমাকে কর্মহীন থাকতে হতো।’ বলেছেন আশা ভোঁসলে।

অন্য সব কণ্ঠশিল্পীর থেকে কনসার্ট পারফরম্যান্স আশা ভোঁসলের ভিন্ন। কারণ তাঁর পজিটিভ এনার্জি দর্শক অনুভব করতে পারে, তাই তো তাঁর কনসার্ট তুমুল জনপ্রিয়। সবাইকে মাতিয়ে তোলার দক্ষতা তার মধ্যে যে ঐশ্বরিক।

ভারতীয় সকল গায়িকার তুলনায় তার স্টেজ প্যারফমেন্সের সংখ্যা বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বাধিক কনসার্ট করার পরেও আশা মনে করেন, এখনো তার কাজ বাকি আছে!

গায়িকা না হলে রাঁধুনি হতেন আশা

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘গায়িকা না হলে কী হতেন?’ আশার ঝটপট জবাব, ‘পেশাদার রাঁধুনি হতাম। বেছে বেছে চারটা বাসায় রান্না করে প্রচুর টাকা কামাতাম। হা হা হা।’

রান্না করতে খুব ভালোবাসেন তিনি। রাঁধেনও চমৎকার। মুম্বাইয়ের অনেক নায়ক-নায়িকাই তাঁর হাতের রান্না চেখেছেন। তাঁর হাতের মাংস আর বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য এখনো অনেকে চেপে ধরেন। আসলে এটিও তাঁর শখ। ফলে কাছের মানুষদের রেঁধেবেড়ে খাওয়ান আজও। তাঁর হাতের রান্না খেয়ে মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

আশা ভোঁসলে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই রান্না পছন্দ করতাম এবং আমার ছেলে আনন্দ একটি রেস্তোরাঁ খোলার ধারণা দিয়েছিল। সেই থেকে রেস্তোরাঁ দেওয়া আমার।’

একটি রেস্তোরাঁ চেইনও খুলে ফেলেছেন আশা ভোঁসলে। দুবাই এবং কুয়েতে রেস্তোরাঁ রয়েছে তাঁর। যার নাম আশা’জ। এ ছাড়া আবু ধাবি, দোহা, বাহরাইনেও তার রেস্তোরাঁ আছে। এই রেস্টুরেন্ট চেইনে মূলত ভারতীয় খাবার মেলে। শেফদের আশা নিজে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পারফেক্ট স্বাদের পাশাপাশি পারফেক্ট গন্ধের খাবার পাওয়া যায় এসব রেস্তোরাঁয়।

দাম্পত্যজীবন

আশার প্রথম বিয়ে হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে, গণপতি রাও ভোঁসলের সাথে। আর তখন গণপতি ভোঁসলের বয়স ছিল ৩১। কিন্তু বিয়ের সাত বছর পর আশার ক্যারিয়ার থমকে যায়। তিন সন্তানের জননী তখন তিনি। পরে নির্যাতনের দায়ে গণপতিকে ডিভোর্স দেন। এরপরেই ১৯৮০ সালে গায়ক ও সুরকার শচীন দেব বর্মনের পুত্র প্রথিতযশা সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মনের সাথে আশার আলাপ হয়। এরপর দুজনে একসাথে জুটি বেঁধে জনপ্রিয় সব গান উপহার দেন দর্শকদের। এক পর্যায়ে রাহুল দেব বর্মনের সাথে আশার বিবাহ হয় এবং রাহুলের মৃত্যু অবধি আশা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

তিনি ছিলেন তিন সন্তানের জননী। বড় ছেলে হেমন্ত। তিনি ক্যানসারে মারা যান। তাঁর মেয়ে বর্ষা ২০১২ সালে আগ্নেয়াশাস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছোট ছেলে আনন্দের সাথে তিনি বর্তমানে থাকেন।

ভালো থাকার মন্ত্র

আশা ভোঁসলে একবার বলেছিলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেই নারী হিসেবে, যে সৎ মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ থেকে কখনো পালিয়ে যায় নি। যে কাজ পেলেই এনার্জি পেয়ে গেছে। যে মঞ্চে পারফর্ম করেই বসে থাকে নি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে। যে নিজে রান্না করেছে। যে পরিবারের সবাইকে দেখেছে। যে কর্তব্য সামনে দেখলেই নতুন এনার্জিতে ভরপুর হতে পেরেছে।’

আশার সকল অর্জন

সংগীতজীবনে মোট ৯২৫টিরও বেশি সিনেমায় গান গেয়েছেন। ২০১১ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাঁকে সর্বাধিক সংখ্যক গান রেকর্ডকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ছাড়া দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আঠারোটি মহারাষ্ট্র রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার, একটি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ নয়টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং দুটি গ্র্যামি মনোনয়ন জিতেছেন। ২০০০ সালে পান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০০১ সালে তিনি আজীবন সম্মাননা পুরষ্কারে ভূষিত হন। ২০০৮-এ পান পদ্মবিভূষণ। ১৯৬২ সালে মহারাষ্ট্র সরকারের সেরা গায়কের পুরস্কারও জিতেছিলেন তিনি। ২০০০ সালে আশা ভোঁসলে দুবাইতে ‘সিঙ্গার অফ দ্য মিলেনিয়াম’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। শুধু হিন্দি নয়, ২০টিরও বেশি ভারতীয় ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও গান রেকর্ড করেছেন তিনি। তাঁর প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে বারো হাজারেরও বেশি গান।

Leave a Reply

Your identity will not be published.