নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ২০)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ২০)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ২০তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 
পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯

২০০৫ পাঁচ সালের এক ঘটনা বলি। সেদিন ছিল রোববার। আমার ডাবল শিফট অর্থাৎ আমি চব্বিশ ঘণ্টার জন্য গাড়ি ভাড়া নিয়েছি কারণ মঙ্গলবার আমি দেশে যাচ্ছি। আমেরিকা আসার পর প্রথম দেশে যাওয়া। আনন্দে আমার মন ভরপুর। তখন রাত ন’টা। সকাল পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম, প্রায় পনেরো-ষোল ঘণ্টা গাড়ি চালানো হয়ে গেছে। দেশে যাওয়ার আনন্দ আর উত্তেজনায় আমার মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই। তখন প্রায় সাড়ে চার শ’ ডলারের মতন কামিয়ে ফেলেছি। আমার টার্গেট পাঁচ শ’! যাই হোক, কুইন্সে এক প্যাসেঞ্জার নামিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে ম্যানহাটানে ফিরছিলাম। ঠিক তখনই এক কালো লোক হাত উঠিয়ে আমাকে থামাতে বলল। ভাবছি থামাব নাকি টান দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাব? কারণ জায়গাটা খারাপ। কাছেই প্রোজেক্ট। প্রোজেক্ট হচ্ছে সরকারী এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। মেথর কলোনি টাইপের জায়গা। নোংরা, ঘিঞ্জি। দুনিয়ার হেন অপরাধ নেই সেখানে হয় না। মারামারি, কাটাকাটি, ড্রাগ বিক্রি এঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তারপরও কী মনে করে আমি গাড়ি থামালাম। লোকটি গাড়িতে উঠল।

তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে?

সে বলল, আমার দুটা স্টপ।

আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, দুটা স্টপ কোথায়?

সে বলল, প্রথমে ম্যানহাটান যাবো সেখানে পাঁচ মিনিট থামব তারপর ব্রুকলিন।

যেহেতু আমি তখন নতুন ক্যাব চালাই এবং ব্রুকলিনের রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না অতএব তাঁকে বললাম, দেখো আমি তো ব্রুকলিন ভালোমতো চিনি না, তুমি যদি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমার জন্য যেতে সুবিধা হবে।

সে ফট করে বলে ফেলল, জাস্ট ফাকিং ড্রাইভ নিগা ইউ ফাকিং ইমিগ্রান্ট।

গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। আমি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিলাম। আমার মেজাজ তখন খিঁচড়ে গেছে! রগচটা টাইপের মানুষ হিসেবে বন্ধুমহলে আমার পরিচিতি আছে। আমাকে ফাকিং ইমিগ্রান্ট ডেকেছে আমি কিছু মনে করিনি কিন্তু এই হারামজাদা আমাকে নিগার ডাকছে কেন? আমি তো তার মতন নিগ্রো নই। তাঁর পূর্বপুরুষের মতন আমি তো এ দেশে জাহাজের পাটাতনে বসে দাস হিসেবেও আমেরিকায় আসি নি। আমি এসেছি ইমিগ্রান্ট হয়ে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সুপরিসর বিমানের গদিওলা সিটে বসে।

আমি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ইয়ো হুয়াই দ্য ফাক ইউ কল মি এ নিগার? (ওই ব্যাটা তুই আমারে নিগ্রো ডাকলি ক্যান?)

কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভার তাঁকে এমন একটা প্রশ্ন করতে পারে সে খুব সম্ভবত সেটা ভাবে নি। লোকটি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

আমি থামলাম না। তাঁকে বললাম, গেট দ্য ফাক আউট অফ মাই কার।

লোকটা বলল, যদি না বের হই?

আমি কঠিন গলায় বললাম, বের না হলে আমি গাড়ির দরজা লক করে তোকে নিয়ে সোজা পুলিশ প্রিসেন্টে নিয়ে যাব। গিয়ে বলব তুই আমাকে থ্রেট করেছিস। (প্রিয় পাঠক, আমি জানি পুলিশ আমাকেই বিশ্বাস করবে তাঁকে কখনোই করবে না।)

লোকটা আমাকে ‘ইউ আর ক্রেজি’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। হা হা হা! 

আসলে কালো মানুষেরা সবাইকেই নিগার ডাকে। তাঁদের কাছে সব বর্ণের মানুষই ‘মাই নিগার’ কিন্তু অন্য বর্ণের মানুষ যদি তাঁদের নিগার ডাকে তবে বিরাট সমস্যা!

আমেরিকায় মানুষের বর্ণ চার প্রকার। হোয়াইট (শ্বেতাঙ্গ), ব্ল্যাক (কৃষ্ণাঙ্গ), ব্রাউন পিপল (দক্ষিণ এশীয় কিংবা দক্ষিণ অ্যামেরিকার মানুষ আর এশিয়ান পিপল, কোনো এক উদ্ভট কারণে এঁদেরকে আমেরিকার লোকজন ইয়েলো পিপল বলেও ডাকে) বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্থানের অবস্থান এশিয়া মহাদেশে হলেও এরা কখনোই আমাদের এশীয় বলে গণ্য করে না। তাঁদের কাছে আমরা সবাই ইন্ডিয়ান- অবশ্য তাঁর সংগত কারণও আছে। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান একসময় ভারতবর্ষের অংশ ছিল। আমরা বাংলাদেশিরা শ্বেতাঙ্গ ডাকি শাদাইয়া, কালোদের ডাকি কাউলা, চাইনিজদের ডাকি চাংকু আর দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সবাইই আমাদের কাছে মেক্সিকান অথচ তাঁরা ইকুয়েডর, বলিভিয়া কিংবা পেরুর মানুষও হতে পারে!

২০০৫ সালের এক দুপুরবেলা। দিনটি ছিল শুক্রবার। সকালবেলা কাজে এসেছি। কোনো এক কারণে দুপুরবেলা জুম্মার নামাজে যেতে পারি নি। ভাবলাম নামাজ যেহেতু মিস হয়েছে অতএব কাজ করা যাক। নিউইয়র্ক শহরের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা সর্বাধিক। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সেনেগাল, সোমালিয়া, সুদান অল্প কিছু ইন্দোনেশিয়ান কিংবা মালয়েশিয়ান। শুক্রবারে প্রায় সবাইই দুপুর বারোটা পর্যন্ত কাজ করে তারপর জুম্মার নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে বাসায় চলে যায়, আবার অনেকে ট্যাক্সি পার্ক করে ম্যানহাটানেই নামাজ পড়ে নেয়। হঠাৎ করে প্রচুর ট্যাক্সিড্রাইভার নামাজে যাওয়ার কারণে পুরো  ম্যানহাটানজুড়ে শুরু হয় ট্যাক্সির জন্য হাহাকার। খালি ট্যাক্সি পাওয়া আর লটারিতে মিলিয়ন ডলার জেতা তখন মোটামুটি এক। সেই দুপুরবেলায় ব্যবসাপাতি খুব ভালো চলছিল। একটার পর একটা প্যাসেঞ্জার গাড়িতে উঠছে নামছে। একেবারে তামা তামা ব্যবসা যাকে বলে! ফিফথ এভিনিউর ফ্ল্যাট আয়রন বিল্ডিং থেকে মধ্যবয়সী এক শ্বেতাঙ্গ যুগলকে গাড়িতে উঠিয়েছি। তাঁদের গন্তব্য গ্রাউন্ড জিরো বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সাইট। তখন ফ্রিডম টাওয়ারের কাজ চলছে। ফ্রিডম টাওয়ার হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নতুন দালান। প্যাসেঞ্জারের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম এঁরা নিউইয়র্কের স্থানীয় মানুষ না। খুব সম্ভব মিডওয়েস্টার্ন স্টেটের মানুষ। যাই হোক গাড়ি চলছে। হঠাৎ করে পেছনে বসা পুরুষ লোকটি বলে উঠল, হেই ড্রাইভার তুমি কি মিডলইস্টের লোক? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘নো’ এবার সে বলল, তোমার চেহারা অনেকটা নাইন ইলেভেনের ওই হাইজ্যাকারদের মতোন!

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। এই ব্যাপারটি আমার সাথে অনেকবার ঘটেছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে অনেক প্যাসেঞ্জারই আমাকে এই প্রশ্নটি করেছে আমি মিডলইস্টের লোক কি না অথচ কোনো মিডলইস্টের মানুষ কখনই আমাকে এই প্রশ্নটি করে নি। আমি তাঁর কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি। এবার তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন।

এই ড্রাইভার তুমি কি টেরোরিস্ট? কোন সুইসাইড মিশনে আমার দেশে এসেছ? 

আমার মেজাজ গেল খিচড়ে। রাস্তার পাশেই পুলিশের গাড়ি পার্ক করা ছিল, আমি ট্যাক্সি পুলিশের গাড়ির পাশে পার্ক করে গাড়ি থেকে নামলাম। গাড়িতে বসা পুলিশ অফিসারকে বললাম, এই প্যাসেঞ্জার আমাকে ভার্বালী এবিউস করছে। পুলিশ আমার কথা শুনে দুই মিনিট তাঁদের সাথে কথা বলল এবং দুজনকেই ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দিল। মিটারে যে ভাড়া উঠেছিল, পুলিশ তাঁদের সেটা পরিশোধ করতে বাধ্য করল। ভাড়া না দিলে থেফট অফ সার্ভিসের জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করবে বলেও জানিয়ে দিল। কারণ লোকটি ভাড়া দিতে ধানাইপানাই করছিল। 

ঠিক একইরকম ঘটনার সম্মুখীন আরেকবার হয়েছিলাম। সেদিন সেই প্যাসেঞ্জারকে ইংরেজি ভাষায় যে ক’টা গালি জানি সবগুলো শুনিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম! শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়া অন্য বর্ণের মানুষের কাছ থেকে কখনো এমন বিরূপ ব্যবহার পাইনি।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.