জানালায়

জানালায়

আমার মাটি চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। এই বাড়ির সবকিছু আমার চোখের সামনে আয়নার মতো। ফিরোজার শরীর আমার কাছে শুধু আয়না নয়, ওর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ আমার দেখা ও জানা, তাও ও আমার সামনে আসে না, মুখ ছাড়া শরীরের আর কোনো অংশ নিয়েই সে সামনে আসে না, তাহলে সে কি পাকিস্তানি মিলিটারিদের লাঞ্ছনার শিকার?

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে ছাইয়ের গাদা ঘেঁষে যে বিশাল তালগাছ আকাশ ছুঁয়ে, সেই তালগাছে পাঁচটি বাবুই পাখির বাসা বাতাসে দোল খাচ্ছে। দেখে এত কষ্টের মধ্যেও বেশ আনন্দ হয়। আমরা দেশে ঢুকেছি ডিসেম্বরের ছয় তারিখে। ওদিন আমাদের দলে আনন্দ ও বেদনা দুটোই বেশ প্রবল ছিল। অপারেশনে যাওয়ার আগে দুপুরে আমাদের লিডার নওশের ভাই দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বিরাট সুখবর আছে। গ্রেট নিউজ!

আমরা তখন গ্রুপ গ্রুপ হয়ে তৈরি হওয়া বাদ দিয়ে সবাই ছুটে এসে নওশের ভাইকে ঘিরে ধরলে জানাল, আজ ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে। শুনে সে কী ফুর্তি আমাদের! সেই ফুর্তিতেই দলের মালেক আকাশে রাইফেল উঁচিয়ে ঠা ঠা করে কয়েকটা গুলি ছুড়লে নওশের ভাই ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর।

এই শালা, এই গুলি ছোড়ার ফল কী হতে পারে জানিস?

আমরা মুহূর্তে ভয়ে কাঁটা হয়ে যাই। লিডারের হুকুম ছাড়া গুলি ছোড়া চরম দণ্ডনীয় অপরাধ মনে করে ভেবে নিই, নওশের ভাই হয়তো এক্ষুণি মালেককেই গুলি করবেন। তা তিনি করেন না, কিন্তু মালেক জোড়া পায়ের লাথিতে পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ার পর বুঝতে পারে আসলে কী মারাত্মক ভুলটা সে করেছে। আমাদের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটির দূরত্ব ঠিক সোয়া মাইল। আমরা যে এখানে গত রাতেই ঘাঁটি গেড়ে বসেছি তা ওরা জানে না। আমাদের উদ্দেশ্য, দুপুরে ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে সন্ধ্যার পরপরই অপারেশনটা চালাব। শীতের দিন, পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। আক্রমণের উপযুক্ত সময় পেতে আমাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতো না। কিন্তু সব ভণ্ডুল করে দিল মালেকের ওই আনন্দের গুলি। আমরা সাথি হারালাম তিনজন, গুরুতর আহত হলো সাতজন, অল্প আহত বারো। গুলির শব্দে পাকিস্তানিদের আমাদের অবস্থান বুঝতে দেরি হয় নি।

ভারতের স্বীকৃতির আনন্দ বেদনা হয়ে গেল মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী! মরব কিংবা আহত হব।

Leave a Reply

Your identity will not be published.