চিকুনগুনিয়া...

চিকুনগুনিয়া...

চিকুনগুনিয়া হচ্ছে মশাবাহিত একটি রোগ। এক ধরনের ভাইরাস দিয়ে এই রোগ হয়। আমাদের অতি পরিচিত ডেঙ্গুজ্বরের সঙ্গে এই রােগের বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। ডেঙ্গুর মতাে এ ভাইরাসটিও এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস অ্যালবপ্টিকাস মশার কামড়ের মাধ্যমে এই রােগ ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া টোগা ভাইরাস গােত্রের ভাইরাস। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবাে ভাইরাসও বলা হয়। চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর মতােই মানবদেহ থেকে মশা এবং মশা থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে থাকে।

চিকুনগুনিয়া মূলত আফ্রিকান একটি রােগ। আফ্রিকার আঞ্চলিক ভাষায় এই চিকুনগুনিয়ার মানে বাঁকা হয়ে যাওয়া। জ্বরে হাড়ের জোড়গুলাে ফুলে যাওয়ার জন্য এই নামকরণ। কেউ বলেন ল্যাঙ্গা জ্বর। কারণ এতে আক্রান্ত রােগীর ঘাড়, পিঠ, কোমরে, পেশিতে, গিরায় এত তীব্র ব্যথা হয় যে সােজা হয়ে দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। তখন কেউ কেউ খুঁড়য়ে হাঁটতে বাধ্য হন। রােগতত্ত্ব, রােগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫২ সালে চিকুনগুনিয়া প্রথম ধরা পড়ে আফ্রিকায়। ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় রােগটি সনাক্ত হয়। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তার ঘটে। এখন বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে রােগটি দেখা যায়। তবে সম্প্রতি এই রােগটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তিন বছর পরে ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রােগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রােগী ছাড়া বড় বিস্তার ছিল না। তবে এ বছর ঢাকায় এই রােগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেক বেশি তাপমাত্রার জ্বর ওঠে। কাপুনি দিয়ে জ্বর 1. আসে, সেই সঙ্গে বমি বমি ভাব, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের সংযােগস্থলে তীব্র ব্যথা হয় এবং ফুলে যায়। জ্বর চলে যাওয়ার পর শরীরে লাল র্যাশ ওঠে। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যায়। জ্বর ভালাে হলেও রােগটি অনেকদিন ধরে রােগীদের ভােগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবােপিকটাস জাতের মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। এ জাতের মশা স্রোতহীন, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এবং সেখান থেকেই এর বিস্তার ঘটে। রাস্তাঘাটের চেয়ে ঘরের মধ্যে এ মশা অবস্থান করে বেশি। রেফ্রিজারেটর, এসি ও ঘরের মধ্যে থাকা টব প্রভৃতির মধ্যে জমে থাকা পানি এ মশার আদর্শ জন্মস্থল। ফলে ঘরের মধ্যে মশার কামড় খেয়ে রােগাক্রান্ত হওয়ার শঙ্কাও বেশি। এ মশা ভাের ও সন্ধ্যার নরম আলােতে কামড়ায়। সে সময়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকা প্রয়ােজন। দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ঘরে মশানাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। মশা যেহেতু শরীরের খােলা জায়গায় কামড় দেয়, তাই যতদূর সম্ভব শরীর পোশাকে আবৃত রাখতে হবে। প্রয়ােজনে শরীরের অনাবৃত স্থানে মশানিবারক ক্রিম/লােশন ব্যবহার করা যেতে পারে (মুখমণ্ডল ব্যতীত)। সম্ভব হলে জানালা-দরজায় মশা প্রতিরোধক নেট লাগাতে হবে, যাতে মশা প্রবেশ করতে না পারে।

পরিবারের কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে আবার যেন মশা না কামড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রােগীকে কামড় দেওয়ার পর সেই মশা যদি সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দিলে ওই ব্যক্তি এ রােগে আক্রান্ত হবেন।

চিকুনগুনিয়া জ্বরে নির্দিষ্ট কোনাে চিকিৎসা নেই। সমস্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই রােগ প্রতিরােধে কোনাে টিকা বা ভ্যাক্সিন নেই। জ্বর কমানাের জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধও চিকিৎসকের পরামর্শ মােতাবেক গ্রহণ করা উচিত। তবে রােগ নির্ণয় অবশ্যই করানাের প্রয়োজন।

চিকনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসায় কোনাে এন্টিবায়ােটিক প্রয়ােজন হয় না। এসপিরিন জাতীয় ওষুধ থেকে বিরত থাকতে হবে। জ্বরে ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খেতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক যত্ন ও চিকিৎসার অভাবে চিকুনগুনিয়া দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে নবজাতক, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রােগী যদি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয় তাহলে প্রকট স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঢাকার ২৩টি এলাকাকে চিহ্নিত করেছে রােগ পর্যবেক্ষণকারী রােগতত্ত্ব, রােগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এলাকাগুলাে হলাে—ধানমণ্ডি ৩২, ধানমণ্ডি ৯/এ, উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, লালমাটিয়া, পল-বী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়ের বাজার, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মণিপুরিপাড়া, মােহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর ১ ও কড়াইল বস্তি।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে রােগতত্ত্ব, রােগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খােলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে এডিস মশা নিধন করতে হবে। ধ্বংস করতে হবে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির পাত্র, কলসি, বালতি, ড্রাম, টায়ার, টিনের কৌটা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেট, নারিকেলের মালা, ডাবের খােসাসহ যেসব জায়গায় পানি জমতে পারে, সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। এসব স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখতে হবে এবং নিয়মিত বাড়ির আশপাশে পরিষ্কার রাখতে হবে। মশার বংশ বিস্তার রােধে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রশাসনকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। মনে রাখতে হবে, চিকুনগুনিয়া মরণঘাতী নয়। সুতরাং ভয়ের কারণ নেই।

Leave a Reply

Your identity will not be published.