‘ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!/তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!’ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই কবিতা পড়লে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুন্দরী ঝরনার পাশে যেতে চায় মন। তো মনকে খুশি করতে এই বর্ষায় ছুটে যেতে পারেন ঝরনার পাশে। বাংলাদেশের নানা জায়গায়ই রয়েছে ঝরনা। কয়েকটি ঝরনা তো অপরূপ। এইসব ঝরনা বা জলপ্রপাতের কথা বলা হলো এখানে।
বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত আছে আমাদের দেশে। তার মধ্যে মাধবকুণ্ড, পরীকুণ্ড ও হামহাম—এই তিনটি জলপ্রপাত মৌলভীবাজারে। বান্দরবানে আছে নাফাখুম, বাকলাই, ঋজুক, শৈলপ্রপাত। খাগড়াছড়িতে রিছাং, রাঙামাটির শুভলঙ, কক্সবাজারের হিমছড়ি। এমনি অনেক জানা-অজানা জলপ্রপাত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাহাড়ি অঞ্চলে। সবগুলোই এত সুন্দর যে কোথায় যাব তা ঠিক করাই কঠিন। দেখুন আপনারা ঠিক করতে পারেন কি না!
মাধবকুণ্ড
দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। এখানে সারা বছরই কমবেশি পর্যটক থাকে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলিতে অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি। প্রায় ২৭০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলপ্রপাতটি। মাধবকুণ্ডের একটি ধারায় সারা বছরই পানি থাকে। অন্য ধারাটিতে শুধু বর্ষাকালে পানি থাকে। পানির তোড় বেড়ে গেলে ধারা দুটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখনই জলপ্রপাতটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়। জলপ্রপাতটিতে যাওয়ার পথে একপাশে মাধবকুণ্ড ইকো পার্ক, অন্যপাশে, পাহাড়ের ঢালে ঢালে খাসিয়াদের পল্লি। ১০ মিনিটের এ পথটিও কম আকর্ষণীয় নয় সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকদের কাছে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে রেল ও সড়ক পথে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়। ঢাকায় ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি বাস যায় মৌলভীবাজার। ট্রেনে মৌলভীবাজার যেতে হলে নামতে হবে কুলাউড়া স্টেশনে। যেখান থেকে সুবিধামতো যানবাহন নিয়ে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়।
পরীকুণ্ড
মাধবকুণ্ড দেখতে এসে পরীকুণ্ড দেখে না গেলে ভুল করবেন। মাধবকুণ্ড ঝরনার কিছুটা আগে শিব মন্দিরের বিপরীতে পাথুরে ঝিরি পথটি ধরে হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন পরীকুণ্ড জলপ্রপাতে। ঝরনাটির ধারা মাধবকুণ্ডের চেয়ে ছোট হলেও সৌন্দর্যে তা পুষিয়ে দিয়েছে। প্রায় ১৫০ ফুট উপর থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে আছড়ে পড়েছে ঝরনাটি। চারপাশের গাছগাছালি আর প্রকৃতি জলপ্রপাতটির সৌন্দর্যে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। তবে বর্ষা ছাড়া বছরের বেশিরভাগ সময় ঝরনাটি শুকনো থাকে।
হামহাম জলপ্রপাত
মৌলভীবাজারের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার হামহাম জলপ্রপাত। কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমাটিবিট এলাকায় অবস্থিত জলপ্রপাতটি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে এর অবস্থান। শুধু জলপ্রপাত নয়, দুপাশের প্রকৃতিও আপনার দৃষ্টি কেড়ে নেবে। এখানে প্রকৃতিতে এখনো মানুষের হাত পড়ে নি। তাই উপভোগ করতে পারবেন অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। জায়গাটিতে দুর্গমতা অ্যাডভেঞ্জারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য হতে পারে বাড়তি আর্কষণ।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সহজেই ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। সেখান থেকে বাস বা জিপে যেতে হবে চাম্পারার চা-বাগানের কলাবন পাড়ায়। তারপর শুরু হবে দুর্গম এলাকা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় গাইড নিয়ে যেতে হবে। কলাবন পাড়া থেকে জলপ্রপাতে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।
সহস্রধারা ও সুপ্তধারা
সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের প্রধান ফটক পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়বে সুপ্তধারা জলপ্রপাত। পাহাড়ি ছড়া ধরে এগোলে পৌঁছানো যায় ঝরনার একেবারে পাদদেশে। সহস্রধারা নামে অন্য জলপ্রপাতটি আছে ইকোপার্ক এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ সীমানায়। ঝরনার পাদদেশে যেতে ভাঙতে হবে প্রায় তিন’শ ফুট সিঁড়ি এবং পাড়ি দিতে হবে কিছু পাহাড়ি পথ। নয়নাভিরাম জলপ্রপাত দুটি দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য সৌন্দর্যপিপাসু এখানে ভিড় করে।
কীভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম থেকে বাসে সীতাকুণ্ড শহরে যাওয়া যায়। সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে এগোলেই পাওয়া যাবে সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। ইকোপার্কের ভেতরেই জলপ্রপাত দুটি।
নাপিত্তাছড়া/খৈয়াছড়া
নাপিত্তাছড়া ঝরনা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পাহাড়ে অবস্থিত। এখানে তিনটি ঝরনা রয়েছে—কুপিকাটাকুম, মিঠাছড়ি এবং বান্দরকুম বা বান্দরিছড়া। অন্যদিকে খৈয়াছড়া ঝরনার বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সরাসরি উপর থেকে নিচে এসে পড়ে নি। এর সাতটি ধাপ রয়েছে।
কীভাবে যাবেন
বাস বা ট্রেনে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বাসে মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারী বাজারে নামতে হবে। সেখানে থেকে নাপিত্তাছড়া ঝরনায় যাওয়া যাবে। অন্যদিকে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে হলে যেতে হবে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে।
বাকলাই জলপ্রপাত
অনেকের মতেই বান্দরবানের এই জলপ্রপাতটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত। থানচি উপজেলার বাকলাই পাড়ায় অবস্থিত এ জলপ্রপাতটির অন্যান্য জলপ্রপাত থেকে আলাদা করা যায় বুনো সৌন্দর্যের আধার এ জলপ্রপাতটিকে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান আসা যায়। এসি, ননএসি দু’ধরনের বাসই আছে। বান্দরবান থেকে বাস বা চান্দের গাড়িতে থানচি যাওয়া যায়। প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগবে। থানচি থেকে জলপ্রপাতে যেতে কয়েক ঘণ্টা লাগে। এ অঞ্চল চেনা না থাকলে অবশ্যই গাইড নিতে হবে।
নাফাখুম জলপ্রপাত
বান্দরবানে প্রকৃতির আরেক বিস্ময় নাফাখুম জলপ্রপাত। রেমাক্রি খালের পানি হঠাৎ বাঁক খেয়ে নেমে গেছে ২০-২৫ ফুট। জলপ্রপাতের প্রস্থও অনেক, ৪০ ফুটের কম হবে না। অনেকেই মনে করেন পানি প্রবাহের দিক থেকে নাফাখুমই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নির্ভেজাল উৎস নাফাখুম। নাফাখুমে যাওয়ার পথও সৌন্দর্যপিপাসু অভিযাত্রীকে মুগ্ধ করবে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান। সেখান থেকে বাস বা চান্দের গাড়িতে থানচি। থানচি থেকে রেমাক্রি যেতে হবে নৌকায়। সেখান থেকে ২-৩ ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছতে হবে নাফাখুম জলপ্রপাতে।
শুভলঙ জলপ্রপাত
রাঙামাটি শহর থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আকর্ষণীয় এ ঝরনাটি। রাঙামাটি সবুজ নিসর্গের বুকে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার শুভলঙ ঝরনা। শিলাকডাক পাহাড়ের একটি ছড়া থেকে এ ঝরনার সৃষ্টি। প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আসে ঝরনাটি দেখতে। এ ঝরনাটি গোসল করা পর্যটকদের জন্য এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। এ ঝরনাটি উচ্চতা প্রায় তিন’শ ফুট।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি রাঙামাটিতে এস আলম, চ্যালেঞ্জার, ডলফিন, সৌদিয়া বাস সার্ভিস আছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকেও খুব সহজেই বাসে রাঙামাটি যাওয়া যায়। রাঙামাটি শহর থেকে ইঞ্জিন বোটে শুভলঙ যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। যাওয়ার পথটিও শুভলঙ ঝরনা থেকে কম সুন্দর নয়।
Leave a Reply
Your identity will not be published.