[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন অষ্টম পর্ব।]
আমি তখন ট্যাক্সি লাইনের প্রথম গাড়ি এবং একমাত্র গাড়ি। প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষায় চুপচাপ গাড়িতে বসে আছি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই হোটেলের ডোরম্যান আমার গাড়িতে মধ্যবয়সী সাদা এক লোককে ঢুকিয়ে দিল। আমি ডোরম্যানকে দুই টাকা দিলাম, সেটাই নিয়ম। সে ভেতর থেকে লা গুয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার এনে দিলে রেট এক টাকা (ডলার) জে এফ কে’র প্যাসেঞ্জার এনে দিলে রেট দুই টাকা আর নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টের রেট তিন টাকা। ডোরম্যান দুই টাকা হাতে নিয়ে বলল, আমাকে আরও এক টাকা দাও তোমার প্যাসেঞ্জার নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টে যাবে। নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টের নাম শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি রাস্তা চিনি না। পেছন দিকে তাকালাম, লাইনে আমি ছাড়া আর কোনো গাড়ি নেই। থাকলে সে গাড়িতে প্যাসেঞ্জারকে তুলে দিতাম। কি আর করা! শুরু হলো যাত্রা। অনেক কষ্টে লিংকন টানেল খুঁজে বের করলাম। টানেল পার হওয়ার পর নিউ জার্সি টার্ন পাইক সাউথ ধরার নিয়ম আমি ধরলাম নিউ জার্সি টার্ন পাইক নর্থ এবং অবধারিত ভাবেই রাস্তা হারালাম। রাস্তা হারিয়ে খেয়াল করে দেখলাম, নিউ জার্সির ছোট্ট এক শহরে ঢুকে পড়েছি, যার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক গাড়ি চালাচ্ছি। আমার শরীর দিয়ে তখন কালো ঘাম, সাদা ঘাম সবই বের হতে শুরু করেছে। আমার এই অবস্থা দেখে প্যাসেঞ্জার ব্যাটাও খুব সম্ভব টের পেয়েছে।
সে আমাকে বলল, স্যার তুমি কি রাস্তায় ভুল করেছো?
আমি মিনমিনিয়ে বললাম, হ্যাঁ!
সে চিৎকার করে উঠল, হোয়াট? আর ইউ কিডিং মি? যার সোজা বাংলা হচ্ছে, আমার সাথে বাইছলামি করস? তারপর পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করল। আমি আমার ফ্লাইট মিস করব! এখন কী হবে?
প্রিয় পাঠক, ওই যুগে জিপিএসের ব্যবহার ছিল না। ম্যাপই ভরসা। আমি রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে প্যাসেঞ্জারকে বললাম, আমাকে দুটো মিনিট সময় দাও। ম্যাপটা দেখে নিই। সে তখন বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলছে। ফ্লাইট মিস করার চিন্তায় তার মাথা অর্ধেক খারাপ হয়ে গেছে বলেই আমার ধারণা! ঠিক তখনই কালো এক হোমলেস লোক আমার জানালার কাছে এসে টোকা দিলো। আমি জানালা নামালাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি কোনো সমস্যায় পড়েছো?
আমি বললাম, হ্যাঁ! রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।
কোথায় যাচ্ছিলে?
নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টে।
এয়ারপোর্ট তো কাছেই!
আমি বললাম, তুমি কি জানো সেখানে কীভাবে যেতে হয়?
সে বলল, অবশ্যই। আঠারো বছর আমি ওই এয়ারপোর্টে চাকরি করেছি।
আমি বললাম, ভাই যদি কিছু মনে না করো আমার সাথে আসবে? আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তোমাকে টাকা দেব।
সে রাজি হলো। অন্য কোনো স্টেট থেকে লোকজনকে গাড়িতে ওঠানো বেআইনি। আমি সেটা ভুলে গিয়ে তাঁকে গাড়িতে উঠালাম। আমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল।
এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর প্যাসেঞ্জারকে বললাম, সরি তোমার অনেক সময় নষ্ট করেছি, কিছু মনে করবে না আর তোমার ভাড়া না দিলেও চলবে!
প্যাসেঞ্জার লোকটা ভালো ছিল সে বলল, কোনো সমস্যা নাই তুমি আমাকে এখন নিয়ে এসেছো অতএব ভাড়াটা তোমার প্রাপ্য। সে আমাকে আশি ডলার ভাড়া দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
আমি আমার জীবন রক্ষাকারী কালো ওই লোকটাকে একটা বিশ ডলারের নোট ধরিয়ে দিয়ে ম্যানহাটানে ফিরে এলাম। এরপর অনেকদিন আমি কোনো প্যাসেঞ্জার নিয়ে ওই এয়ারপোর্টে যাই নি। নিউওয়ার্ক নাম শুনলেই আমার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করত। এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর আমি নিজে একটি গাড়ি ভাড়া করলাম এবং ম্যাপ দেখে নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্টের রাস্তা চিনে এলাম। এরপর অন্তত হাজারবার ওই এয়ারপোর্টে প্যাসেঞ্জার নিয়ে গিয়েছি। আর কখনো ওই এয়ারপোর্টে যেতে পথ হারাই নি। তবে নিউইয়র্কের বাইরে গিয়ে পথ হারিয়েছি। সেই গল্প বলা যেতে পারে।
ঘটনাটি খুব সম্ভব ২০০৬ সালের।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.