[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ১৪ তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব
সিমি,
তোমার দুটি মেইল একই সঙ্গে পেলাম। খুব ভালো লাগল। আমার মনটা যখন খুবই খারাপ হয়েছিল, তখনই তোমার মেইল পেলাম এবং সত্যি বলছি, হুট করেই মনটা ভালো হয়ে গেল।
আমার লেখা পেতে তোমার ভালো লাগে এটা জেনে ভীষণ আপ্লুত হই। এটা তো আর নতুন কিছু নয়। তুমিও যে কত ভালো লিখো তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না। আমিও তোমার লেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকি। এটাও তো আর নতুন কিছু নয়।
একসময় অনেক চিঠি লিখতাম। তখন চিঠি লিখতেও ভালো লাগত, পেতেও। কী যে ভালো লাগত এক একটা চিঠি পেলে! আমার কাছে কি মনে হয় জানো, চিঠির মতো এমন অমূল্য উপহার খুব কমই হয়। অথচ এই চিঠি লেখাটাই উঠে গেল পুরোপুরিভাবে। আমরা তবুও ইমেইলে বেশ লেখালেখি করে যাচ্ছি অথচ এখন এই ইলেকট্রনিক চিঠির জায়গাও দখল করে নিচ্ছে টেক্সট মেসেজ আর মেসেঞ্জার। চিঠির মাঝে একে অপরের কাছে যতটা উন্মোচিত করা যায়, ততটা বোধহয় সামনাসামনিও হয় না।মুখে যে কথা বলা যায় না, চিঠিতে সেকথা অনায়াসে লিখে দেওয়া যায়।
তোমাকে বলেছিলাম কি-না জানি না। কলেজে পড়ার সময়ে, দূরপাল্লার বাসের সিটের পেছনে লেখা ঠিকানা দেখে আমি একটা মেয়েকে চিঠি লিখেছিলাম, কৌতূহলবশত। জয়পুরহাটের মেয়ে, নাম জয়া। ভেবেছিলাম ভুয়া এড্রেস লিখে রেখেছে কেউ। তবুও আমি অপেক্ষায় ছিলাম এবং সত্যি সত্যিই একদিন আমার চিঠির উত্তর এল মেয়েটির কাছ থেকে। সেদিনের সেই অনুভূতি প্রকাশ করা কিছুতেই সম্ভব না। তখনকার সময়ে একজন অপরিচিত মেয়ের কাছ থেকে চিঠি পাওয়া ছিল অপ্রত্যাশিত। তবে বিষয়টা যে কী পরিমান আনন্দের হতে পারে, এ যুগের ছেলে-মেয়েরা তা বোধকরি বুঝবে না। সেই চিঠিটি আমি অনেকদিন রেখে দিয়েছিলাম। কয়েকটি চিঠি চালাচালির পর আমাদের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি হলো। যদিও জয়াকে আমার কখনো দেখা হয় নি। তবে আমার জীবনে যা কিছু ভালোলাগার বিষয় আছে, জয়ার সাথে পেন-ফ্রেন্ডশিপ ছিল তার মধ্যে অন্যতম।
তখন ইন্টারনেটের এত আধিপত্য ছিল না বলেই হয়তো বিশ্বজুড়ে পত্রমিতালি বা পেন ফ্রেন্ডশিপ নামক এই শখ ছিল দারুণ জনপ্রিয়। দেশ-বিদেশের বন্ধুরা একে অপরকে চিঠির সঙ্গে পাঠাত সেই দেশের ভিউকার্ড, স্ট্যাম্পসহ নানা স্মারক, উপহার। ইন্টারনেটের এই যুগে যেখানে ইলেকট্রনিক মেইল করে সব জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক ক্লিকে বন্ধু বানিয়ে ফেলা যায়, সেখানে কষ্ট করে হাতে-কলমে চিঠি লিখে বন্ধু বানানোর কথা হয়তো ভাবাই যায় না। তবে, হাতে লেখা চিঠির গুরুত্বই অন্যরকম। কলমের কালিতে গুটি গুটি হরফে যে বন্ধুত্বের অনুভূতির কথা লেখা যায়, তা কখনো ই-মেইলের যান্ত্রিকতায় ফুটে ওঠে না।
শেষ পর্যন্ত জয়ার সাথে আমার বন্ধুত্বের কী হলো নিশ্চয়ই তোমার জানতে ইচ্ছে করছে? বলছি। তখন রাশিয়াতে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের পড়তে যাওয়ার একটা হিড়িক পড়েছিল। এখন যেমন উচ্চশিক্ষার জন্য সবাই আমেরিকা-কানাডাকে বেছে নেয়। সেই স্রোতে জয়াও একদিন হুট করেই চলে যায় রাশিয়াতে। সেখান থেকেও সে লিখত মাঝে মাঝে। তারপর আস্তে আস্তে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। এখন যে সে কোথায় আছে জানি না। তার একটা ছবি পর্যন্ত আমার কাছে নেই। তবুও তার কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।
তুমিও কি এভাবে একদিন না বলেই হারিয়ে যাবে? ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ কষ্টের হবে। দোহাই, এই কাজটি কোরো না কিন্তু। যেখানে যে পরিস্থিতিতেই থাকো না কেন, যোগাযোগটা যেন থাকে। একেবারেই যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাই আমরা।
দেখো তো কী লিখতে কী লিখছি! জানি না তুমি বিরক্ত হচ্ছো কি-না। হলেও এখন আর কিছু করার নেই।
অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছি। সেই সাথে যতই দিন ঘনিয়ে আসছে, আমার উত্তেজনার পারদ ততই ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। কেন তার কারণ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করতে হবে না।
তুমি বলেছ, দেশে যাচ্ছি আমাদের দেখা হবে সেই ভেবে যেন তোমাকে লেখা বন্ধ করে না দিই। আমি হয়তো সেটা চাইলেও পারব না। তুমিও কি পারবে আমাকে না লিখে থাকতে? তোমাকে মেইল লেখা এবং পাঠানো এখন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু যে ভালোলাগা থেকেই করছি তা না, অভ্যাসেই হচ্ছে কাজটি। কাজেই আমি নিশ্চিত, মেইল তুমি পাবে, সেটি দুই লাইনের হলেও। শুধু চিঠি লিখে কাউকে মুগ্ধ করতে পারাটাও তো ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। আমিই-বা সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে চাইব কেন?
ভালো থেকো। আর তো মাত্র দুদিন! অপেক্ষায় আমিও।
ফাহিম মেইলটি পাঠিয়ে দিয়ে ফাহিম ঘুমুতে যাবে আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। তার স্টাডিরুমের টেবিলের ঠিক সামনেই রয়েছে এক কাচের জানালা। সেই জানালার প্লাস্টিকের ব্লাইন্ড অর্ধেকটা ওঠানোই থাকে সব সময়। জানালা দিয়ে ফাহিম মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল বাইরে।আকাশ ভেঙে সাদা সাদা মেঘগুলো তুলোর মতো ঝরে পড়ছে।
ঘুম থেকে উঠে ফাহিম আবিষ্কার করল, প্রায় দুই ফুট বরফের চাদরে ঢেকে আছে বাসার সামনের ড্রাইভওয়ে। গাড়িটাও ডুবে গেছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে একবার ভাবল, আজ আর ঝামেলা করে অফিসে গিয়ে কাজ নেই। দেশে যাওয়ার আগে আজকেই তার শেষ দিন ছিল অফিসের। আগামীকাল সন্ধ্যায় ফ্লাইট। তার হাতে সময়ও বেশি নেই। সে সিদ্ধান্ত নিল, দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বরফ গলে গেলে রাস্তা গাড়ি চলাচলের উপযোগী হবে। না হলে চরম দুর্দশায় পড়তে হবে।
ফাহিম কিচেনে ঢুকে কফি বানিয়ে ঢুকল তার স্টাডিরুমে। গরম কফিতে চুমুক দিয়ে সে ল্যাপটপ খুলে বসল। হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো সিমিকে আর একটা মেইল লিখলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ, সে লিখতে বসল।
প্রিয় সিমি,
কাল রাতে হঠাৎ করেই এক চোট স্নো-স্টর্ম হয়ে গেছে এখানে। তোমাকে একটা মেইল পাঠিয়ে যখনই ঘুমুতে যাব, ঠিক তখনই লক্ষ করলাম বাইরে অঝোরে ঝরছে তুষার। তখনো বুঝি নি, এই তুষার ঝড়বে সারা রাত ধরেই।
সাধারণত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপক তুষারপাত হয় এখানে। তবে এবার নভেম্বরেই পুরু বরফের স্তর পড়ে গিয়েছে। এ বছরের প্রথম তুষারপাত। ইতিমধ্যেই সাদা বরফের চাদরে ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট। চারিদিকে যেন এক শ্বেত, শুভ্র সৌন্দর্য। এ যেন এক অন্য জগৎ। যতদূর চোখ যায় শুধুই শুভ্রতা। সারি সারি বাড়ি, রাস্তার দুধারে গাড়ি, সবকিছু সেই শুভ্রতায় ঢেকে গেছে। সেই জগতে কোনো কালো নেই।
আমি শিকাগোতে যেদিন প্রথম পা রাখলাম, সেদিনও তুষারপাত হচ্ছিল। বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা-লন্ডন-নিউইয়র্ক তারপর ডমেস্টিক প্লেনে নিউইয়র্ক থেকে শিকাগো যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ১০টা। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাওয়ার পথে দেখেছিলাম ঝিরিঝিরি তুষারপাত। দেশে যখন ছিলাম, তখন মনে হতো প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ দান বৃষ্টি আর জোছনা। ওই রাতের অপার্থিব সৌন্দর্য আমার তালিকায় তুষারকে যোগ করেছিল।
ঘুম থেকে উঠে যখন ঘরের বাইরে এলাম, সেই শুভ্রতায় প্রথম পা ফেললামÑকী আনন্দ, কী উত্তেজনা! সৌন্দর্য যে মনের হাহাকারও কমিয়ে দিতে পারে, সেটা বুঝেছিলাম সেদিন।
আমাদের সংস্কৃতিতে বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার একটা ব্যাপার আছে। আমেরিকানরাও তাদের বছরের প্রথম তুষারপাত ব্যাপারটা উৎসবের মতো পালন করে। অন্যান্য দিন তুষারপাতে কাজকর্মের কোনো সমস্যা না থাকলেও, এদিন প্রথম দিন যেন তাদের বাসায় বসে থাকতে হয়। রেস্টুরেন্টে ডেলিভারি অর্ডার দিয়ে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে সবাই মিলে মুভি দেখার আয়োজন। কারও কারও হাতে থাকে ওয়াইনের গ্লাস অথবা ব্রান্ডি। সবার মধ্যে একটা পিকনিক ভাব চলে আসে।
বাচ্চাদের দল রাস্তায় নেমে একজন আরেকজনের দিকে বল বানিয়ে ছুঁড়ে মারে। কেউ বানায় স্নো-ম্যান। আর যেসব জায়গা একটু ঢালু সেখানে স্লাইড বানিয়ে ধুপ করে পড়ে কেউ। তারপর শুরু হয় হাসাহাসি আর বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি। প্রথম তুষারপাতের পরের সময়টা পরিবারের আনন্দের সময়। প্রকৃতি কতভাবেই না আনন্দ ছড়িয়ে রাখে এ পৃথিবীতে!
একটানা তুষারপাতের বর্ণনা লিখে এ পর্যায়ে ফাহিম বিরতি নিল। সে কফিতে চুমুক দিয়ে বুঝতে পারল কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার মানে সে কফিতে চুমুক দিতেও ভুলে ছিল এতক্ষণ। তাকে লেখায় পেয়ে বসেছে, নতুন আর এক কাপ কফি বানিয়ে আনার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহবোধ করল না। কিছুক্ষণ ভেবে সে আবার লিখল-
ও তোমাকে তো বলা হয় নি, বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী ওয়াশিংটন, ডিসিতে পাসপোর্ট পাঠিয়েছিলাম ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ স্ট্যাম্পের জন্য। গতকাল পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি। এখন আর আমার দেশে যেতে ভিসাজনিত কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। দু’ বছর আগে যখন দেশে গিয়েছিলাম, ঢাকা এয়ারপোর্টে এরাইভাল ভিসা পেতে আমাকে যে কত সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, পঞ্চাশ ডলার ব্যাংক ড্রাফ করতে হবে, সেই কাজটি যিনি করেন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে তোলা হলো। সে আমার কাছ থেকে দুইশ ডলার নিল। আমাকে কোনো রিসিট দিলো না। রিসিট চাইতেই বলল, আমরা রিসিট দিই না। প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল শুধু ব্যাংক ড্রাফট করতে। তারপর দীর্ঘ লাইন শেষে যখন বের হয়ে এলাম, মনে হলো, আমি ভুল করে সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রহে এসেছি। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যখন বুক ভরে শ্বাস নিলাম, তখন সব কষ্ট ভুলে গেলাম। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এই দেশটাকে তখন বড় বেশি মায়াবী মনে হয় আমার।
হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ফাহিম। যেভাবে তুষারপাত হচ্ছে, ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে যায় কি-না কে জানে। গতবারের তুষার ঝড়ে প্রায় দেড় হাজার ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছিল। বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচলও। তার অবচেতন মন বলছে, এই তুষারপাত সহজে বন্ধ হবে না। সে উঠে গিয়ে নতুন এক কাপ কফি বানাল। তারপর বসার ঘরে টিভি সেটের সামনে গিয়ে ওয়েদার চ্যানেল অন করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইল।
এত আগ্রহ করে সিমির জন্য দ্বিতীয় যেই মেইলটি এতক্ষণ ধরে সে লিখল, সেটা বেমালুম ভুলে গেল পাঠাতে।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.