বাংলা সাহিত্যে বর্ষা

বাংলা সাহিত্যে বর্ষা

বর্ষা! বৃষ্টিপ্রধান এই দেশে এই ঋতুর প্রভাব এদেশের মানুষের জীবন ও মননে অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যেও বর্ষার প্রবল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই বিষয়টিই অন্যদিন-এর বিশেষ রচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।

ভোর থেকেই অবিরল বর্ষণ। ঝরছে তো ঝরছেই। ‘কী বাজে, কী বিরক্তিকর!’ জানালায় বসে আনমনে আপনি হয়তো বিড়বিড় করে উঠলেন। হয়তো তখন আপনি ঘরবন্দি। হয়তো ভার্সিটি কিংবা অফিস অথবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান—কোথাও যেতে পারছেন না। আপনার আক্ষেপ—হোক না রাতভর বৃষ্টি, কাজের সময় কেন বাবা!

আপনার সংগ্রহে কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি রয়েছে ? বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখুন তো কী লেখা আছে : “এ জলের দেশ। বর্ষাকালে চারিদিকে জলে-জলময় হইয়া যায়। প্রত্যেক বছর কয়েকটা দিনের জন্য এই সময়ে মানুষের বাড়িঘর আর উঁচু জমিগুলো ছাড়া সারাটা শেষ জলে ডুবিয়া থাকে। জল যেবার বেশি থাকে মানুষের বাড়ির উঠানও সেবার রেহাই পায় না। পথঘাটের চিহ্নও থাকে না। একই গ্রামে এপাড়া হইতে ওপাড়ায় যাইতে প্রয়োজন হয় নৌকার। কয়েকদিন পর জল কমিয়া যায়। জলের ভিতর হইতে পথগুলো স্থানে স্থানে উঁকি উঁকি দিতে আরম্ভ করে, কিন্তু আরও এক মাসের মধ্যে পথগুলো ব্যবহার করা যায় না।”

হঠাৎ আপনার চোখে পড়লÑর‌্যাকের নিচের তাক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি উঁকি দিচ্ছে। হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেল : “বর্ষা ঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্য সমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নয়—ওটা আরণ্য প্রকৃতির বিশেষ উপযোগী।” এ কথা যে কতটা সত্যি—সেটি তো প্রতিদিনই আপনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ভাবছেন, আপনার ভাবনার সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়কের। আর আপনি কি জানেন, শেষের কথাটুকুও কত সত্যি! বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটির নায়ক অরণ্য মাঝে বর্ষার অপরূপ দেখে কী মুগ্ধই না হয়েছিলেন : “কী অপূর্ব বর্ষার দৃশ্য দেখিলাম সেই অরণ্য-প্রান্তরে। মেঘে মেঘে দিগন্তের শৈলমালা নীল, থমকানো কালো বিদুৎগর্ভ মেঘে আকাশ ছাইয়া আছে, ক্বচিৎ পথের পাশের খাল কী কেঁদ শাখায় ময়ূর পেখম মেলিয়া নৃত্যপরায়ণ, পাহাড়ি ঝরনার জলে গ্রাম্য বালক-বালিকা মহা উৎসাহে শাল-কাঠির ও বন্য বাঁশের ঘুনি পাতিয়া কুচো মাছ ধরিতেছে, ধূসর শিলাখণ্ড ভিজিয়া কালো দেখাইতেছে, তাহার ওপর মহিষের রাখাল কাঁচা শালপাতার লম্বা বিড়ি টানিতেছে।”

এবং আপনি ‘আরণ্যক’-এ আটকে না থেকে যদি সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ও পড়ে ফেলেন এই বৃষ্টির দিনে, যদি ঘরের বধূটির সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত হয়ে মনের কোণে কী এক অবোধ্য দোলা অনুভব করেন, বাইরের বৃষ্টি আপনার ভেতরে ঢুকে যায়—তাহলে আপনিও এই উপন্যাসের নায়কের মতোই বৃষ্টি-আচ্ছন্ন অলৌকিক জগতে প্রবেশ করতে চাইবেন : “কাহ্নুপাদ শবরীর হাত ধরে জোর করে ঘরের বাইরে টেনে আনে। শবরীর নিষেধ এবং চিৎকার শোনে না। ওকে টানতে টানতে পাহাড়ের গা বেয়ে সমতল ভূমিতে নামে। তারপর কার্পাস ক্ষেতে ঢোকে দুজনে। আর তখনই শবরীরও ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। অনেক দিন পর ভেসে যায় আশপাশ। চারদিক ধোঁয়ার মতো দেখায়। সে অলৌকিকে প্রবেশ করার বড় সাধ কাহ্নুপাদের।”

তবে বর্ষাকে ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদও। বৃষ্টি ও বর্ষার নান্দনিক বর্ণনা পাওয়া যায় ‘ফেরা’ ও ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ। প্রথম উপন্যাসটিতে হাওরে ঘেরা গ্রামে বর্ষা যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ‘ফেরা’ শুরুই হয়েছে প্রবল বৃষ্টির বর্ণনায়। এমন বৃষ্টি যে সোহাগী গ্রামের “জামগাছের ঘনপাতাতেও আর বৃষ্টি আটকাচ্ছে না, দমকা বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ”।...গ্রামে একসময়, উত্তর বন্দের সমস্ত ধান কাটা হওয়ার পর প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিও হয়। তখন সেখানে “ফিরাইল সাব-এর জন্য যে খড়ের ছাউনি” করা হয়েছিল তার চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না। শিলাবৃষ্টিতে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ দেখা যায় ঢাকা শহর থেকে সুখানপুকুর গ্রামের উদ্দেশে ট্রেনে রওনা দেয় দুই বোন—শাহানা ও নীতু। এক সময় ভরা বৃষ্টির মধ্যে ঠাকরোকোনা স্টেশনে নেমে পড়ে ওরা। বৃষ্টিতে ভেজে।... গ্রাম্য গায়ক মতি সারা রাত বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বরে ভোগে। অর্ধ-চেতন অবস্থা হয় তার। শীতে মতির শরীর কাঁপে। পানির তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়।... পরাণ ঢুলির স্ত্রীর যখন প্রসববেদনা ওঠে, তখন বৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়। পরাণ তখন উত্তেজনা বোধ করে। কেননা তার ধারণা “বৃষ্টির মধ্যে যে শিশুর জন্ম হয় সে হয় ভাগ্যবান”। বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। পরাণের ছেলে সুবল খামাখা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। ধাই খোদেজা মায়ের কথাতেও সে ঘরে যায় না।...আষাঢ় মাসের মুষল ধারার বৃষ্টিতে মতির গানের আসর ভেঙে যায়। সে মন খারাপ করে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরে।...উপন্যাস শেষও হয় বৃষ্টির মধ্যে, যেখানে বৃষ্টি ও মানুষের কান্না একাকার। মৃত্যুপথযাত্রী কুসুমের জন্য মতি ও সুরুজ মিয়ার শোক। ভালোবাসার অশ্রুপাত।

এছাড়া সমরেশ বসু (গঙ্গা), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (তিতাস একটি নদীর নাম), জহির রায়হান (হাজার বছর ধরে)সহ নানা ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে বর্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে।

শুধু উপন্যাস নয়, ছোট গল্পেও বর্ষা আপন মহিমায় ভাস্বর। ছোটগল্পের জাদুকর রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরুন না কেন, আর তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’-এর শেষাংশ—যেখানে মানব-হৃদয়ের বিচ্ছেদ বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে বর্ষা প্লাবিত নদী প্রবাহে—“যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষা বিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছ্বলিত অশ্রুরাশির মতো চারদিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন—একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি’ কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষায় স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়েছেÑএবং নদীপ্রবাহে ভাসমান  পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী! পৃথিবীতে কে কাহার!”

রবীন্দ্রনাথের মিনি গল্পেও বর্ষার গভীর অনুভূতির রেখাপাত। ‘মেঘলা দিনে’ কিংবা ‘মেঘদূত’ নয়—‘একটি দিন’-এর কথা বলছি : “মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। ক্ষণেক্ষণে বৃষ্টিধারা ক্লান্ত হয়ে আসে, আবার ধমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তোলে।

ঘন অন্ধকার, কাজে মন যায় না। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বর্ষার গানে মল্লারের সুর লাগালেম। পাশের ঘর থেকে একবার সে কেবল দুয়ার পর্যন্ত এল। আবার ফিরে গেল। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ভেতরে এসে বসল। হাতে তার সেলাইয়ের কাজ ছিল, মাথা নিচু করে সেলাই করতে লাগল। তার পরে সেলাই বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইল।

বৃষ্টি ধরে এল, আমার গান থামল। সে উঠে চুল বাঁধতে গেল।

এইটুকু ছাড়া আর কিছুই না। বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে আঁধারে জড়ানো কেবল সেই একটি দুপুরবেলা।

ইতিহাসে রাজাবাদশার কথা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি, সস্তা হয়ে ছড়াছড়ি যায়। কিন্তু, একটি দুপুরবেলার ছোটো একটু কথার টুকরো দুর্লভ রত্নের মতো কালের কৌটোর মধ্যে লুকোনো রইল, দুটি লোক তার খবর জানে।”

মিনি গল্প প্রসঙ্গে আপনার হয়তো এ ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, বনফুল। তাঁর ‘শ্রাবণ নিশীথে’ গল্পের নায়ক বর্ষণমুখর শ্রাবণ রাতে ঘরের দরজা খোলা রেখে অপেক্ষা করছে প্রিয়ার জন্য—রাত এগারোটার ট্রেনে সে আসবে। হৃদয়ের অকথিত কামনার মূর্ত প্রতীক ফুলের একটি মালা নিয়ে সে তাই অন্ধকারে চুপটি করে বসে আছে। সমাজ ? আছে বৈকি। দৈত্যের মতোই তাদের দুজনের মাঝখানে তার অবস্থান।... স্টেশনের কাছেই তার বাড়ি। কিন্তু রাত এগারোটার ট্রেন এল, আবারও চলেও গেল, আকাক্সিক্ষত মানুষটি এল না। তারপর, বনফুল লিখেছেন: “সহসা শব্দ হইল, যেন চাপা আর্তনাদ। আমার মনের বেদনাই কি বাক্সময় হইল ? বেড সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিলাম। দেখিলাম একটি প্রকাণ্ড ব্যাঙ দ্বার দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। তাহার চোখ দুইটা যেন ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। ঘরের কোণে আর একটা ব্যাঙ।... না উহাদের সমাজ নাই। ফুলের মালাটা উহাদের দিকেই ছুড়িয়া দিলাম।”

অবিশ্রান্ত বর্ষণে আপনি বিরক্ত বোধ করছেন ? কিন্তু ভেবেছেন কি ওই বৃষ্টির ঝম-ঝমানি সুরের মধ্যে কারও কারও হৃদয়ের বেদনা বাঁধা। নজরুলের ‘বাদল-বরিষণে’ গল্পের নায়কের সেই দশা। শ্রাবণ মাস এলেই তার অন্তরে বরিষণের ব্যথাটুকু ঘনিয়ে আসে। মনে পড়ে সেই পাহাড়ি চঞ্চল মেয়ে—কাজল কালো কাজরির কথা। সে ছিল বড্ড বেশি চাপা অভিমানী। কালো বলে সে মনে করত, কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে না। পরদেশী নায়কের ভালোবাসাকে তাই সে বিশ্বাস করতে পারে নি। কিন্তু যখন সে ভালোবাসাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলÑতখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ভাদ্রের কৃষ্ণ-তৃতীয়াতে ভালোবাসার মানুষের কোলে শ্রান্ত মাথা রেখে সে চিরদিনের মতো এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। তারপর শ্রাবণ এলেই কাজরির কথা মনে পড়ে। আর বর্ষার ঘন-কালো রূপে সে হারানো প্রিয়াকে খুঁজে পায় : “এই তোমার টাটকা-ভাঙা রসাঞ্জনের মত উজ্জ্বল-নীল গাঢ় কান্তি! ওগো, এই তো তোমর কাজল-কালো স্নিগ্ধ-সজল রূপ আমার চোখে অঞ্জন বুলিয়ে গেল! ওগো আমার বারেবারে হারানো মেঘের দেশের চপল প্রিয়! এবার তোমায় অশ্রুর ডোরে বেঁধেছি! এবার তুমি যাবে কোথা ? লোহার শিকল বারে-বারে কেটেছ তুমি মুক্ত-বনের দুষ্ট পাখি, তাই এবার তোমায় অশ্রুর বাঁধনে বেঁধেছি, তাকে ছেদন করা যায় না। ওই ঘন নীল মেঘের বুকে, অই সবুজ কচি দূর্বায়, ভেজা ধানের রঙে তোমায় পেয়েছি।”

‘সৌরভ’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। এক বাবা, আজহার খাঁ, মেয়ের আকাক্সিক্ষত সেন্টের সন্ধানে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ান। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয় তার শরীর। গাল বেয়ে বৃষ্টির পানির স্রোত বইতে থাকে। কিন্তু যখন একটি দোকানে সেই সেন্টটি খুঁজে পান, তখন আবিষ্কার করেন পকেটে মেয়ের দেওয়া টাকা নেই। আজহার খাঁ স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বৃষ্টির মধ্যেই পথে নামেন। তখন তার চশমার কাচে ফোঁটা জমে চারদিক ঝাপসা দেখাচ্ছে। এই অবস্থায়ই তিনি নীরবে পথ হাঁটেন। রিকশা, গাড়ি, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ময়লার স্রোত—কোনো কিছুই তার নজরে পড়ে না। মেয়ের শখের জিনিস কেনার জন্য বন্ধু রফিকের কাছে যান। তার কাছ থেকে টাকা ধার নেন। তারপর সেই টাকা দিয়ে গভীর রাতে দোকান থেকে সেন্টের শিশিটি কিনে রিকশায় চড়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু তাড়াহুড়ায় রিকশা থেকে নামতে গিয়ে আজহার উল্টে পড়ে যান। সেন্টের শিশি ভেঙে যায় । আজহার ধরা গলায় মেয়ের দিকে চেয়ে বলে ওঠেন, “লিলি তোর শিশিটা ভেঙে গেছে রে।” লিলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, “আমার শিশি লাগবে না । তোমার কী হয়েছে বাবা ?” অথচ এই সেন্টের জন্য তার কী ব্যাকুলতাই না ছিল! এখন সে বাবার জন্য ব্যাকুল, উদ্বিগ্ন।

হুমায়ূন আহমেদের ‘বান’ গল্পে বৃষ্টি দুঃখ-কষ্টের প্রতীক। সে সঙ্গে বন্যাকে নিয়ে আসে। রহমানদের মতো দরিদ্র মানুষদের ঘর-বাড়ি ডুবে যেতে থাকে, বানের জলে ভেসে যেতে থাকে জিনিসপত্র। তাদের দুর্দশার সীমা থাকে না।

অন্যদিকে ‘কবি’ ‘রূপা’, ‘শবযাত্রা’, ‘ওইজা বোর্ড’সহ আরও কয়েকটি গল্পে হুমায়ূন নান্দনিকভাবে ব্যবহার করেছেন বৃষ্টিকে।

এছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (নিরুদ্দেশ যাত্রা)সহ আরও কয়েকজন গল্পকারের গল্পে বর্ষার প্রবল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

 

...কী ব্যাপার, বর্ষণমুখর প্রকৃতি আপনাকে উদাস করে দিচ্ছে ? নস্টালিজিয়ায় আক্রান্ত করছে ? এবার তাহলে সুর করে কবি বিদ্যাপতি রাধিকার সুরেলা পদ তুলে নিন কণ্ঠে—“এ সখি হামারী দুখের নাহি ওর/ এ ভরা ভাদর/ মহা ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর।” অথবা জ্ঞানদাস—“রজনী শাওন ঘন/ঘন দেয়া গরজন/রিমিঝিমি শব্দে বরিষে/পালংকে শয়ান রঙ্গে/বিগলিত চীর অঙ্গে/নিদ যাই মনের হরিষে।”

কিংবা মেঘদূতে ফিরে চলুন, মনে করুন, অজ্ঞাত যুগের এক চিরন্তন কবি আপনি অথবা নির্বাসিত যক্ষ—প্রিয়তমার বিরহে কাতর। আষাঢ়ের প্রথম দিনে দেখতে পেলেন পূর্বদিগন্ত স্নিগ্ধ নবমেঘভারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মেঘকেই আপনি অলকাপুরীতে আপনার প্রিয়ার কাছে হৃদয়ের আর্তি বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। বন্ধুরূপী মেঘ আপনার হৃদয়বেদনা নিয়ে নদ-নদী নগরীর ওপর দিয়ে অলকা অভিমুখে যাত্রা করল। দেখুন আপনার প্রিয়া, বিরহী উদাসিনী আলুলায়িতা কুন্তলা উত্তর মেঘের দিকে চেয়ে আছে। আর সেই মেঘ তাকে আপনার “এতস্মান্মাং কুশলিনমভিজ্ঞানদানাদ বিদিত্বা/মা কৌলীনাদমিত নয়নে ময্যাবিশ্বাসিনী ভুঃ।” (হে অসিত-নয়নে, এই পরিচয় চিহ্ন  পেয়ে আমার কুশল জেনো এবং লোকাপবাদ শুনে আমাকে অবিশ্বাস করো না) এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।

চণ্ডীদাসের কবিতায় বর্ষার পরিবেশ ফুটে উঠেছে বিরহের কথা : “এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/ কেমনে আইল বাটে/ আঙিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে/ দেখিয়া পরাণ ফাটে।”

রবীন্দ্রনাথ একান্তভাবে বর্ষার কবি। ‘মেঘদূত’-এ : “কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত বরষে/কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত/ মেঘমন্দ্র শ্লোক/বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক/রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে/ সঘন সঙ্গীত মাঝে পুঞ্জীভূত করে।”... ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায়... : “সে কথা শুনিবে না কেহ আর/নিভৃত নির্জন চারিধার/দুজনে মুখোমুখি/গভীর দুখে দুখি/আকাশে জল ঝরে অনিবার—/জগতে কেহ যেন নাহি আর/” অন্যত্র—“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আপনি পাবেন—“ঐ দেখগো আজকে আবার পাগলি জেগেছে,/ছাইমাখা তার মাথার জটায় আকাশ ঢেকেছে,/মলিন হাতে সে ছুঁয়েছে সব ঠাঁই/পাগলি মেয়ের জ্বালায় পরিচ্ছন্ন কিছুই নাই।”...পাশের বাড়ির সাত বছরের মেয়েটি বৃষ্টির জলে ভাসিয়েছে কাগজের নৌকা। বন্দরহীন, পণ্যহীন, লক্ষ্যহীন, অজ্ঞাত পৃথিবীতে ভাসিয়েছে নৌকা। প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘কাগজের নৌকা’-কে পাঠিয়েছেন সুদূরলোকে—“তবু কাগজের নৌকা আজও ভাসে নালায় ডোবায়/নর্দমাতে ডুবি হয়ে ঝাঁঝরিতে বাড়ায় জঞ্জাল।”

বাড়াক, কিন্তু বৃষ্টি তো চলেছে সমান তালে। আর জড়িয়ে ধরছে মনকে।

বর্ষা কাউকে ছাড়ে নাÑবস্তুবাদী বিপ্লবী কবি সুকান্তকেও দিয়েছিল নাড়া—“এই নিবিড় বাদল দিনে/কে নেবে আমায় চিনে/জানি নে তো।”

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকেই কি ছেড়েছিল ?—“ওগো বাদলের পরী/যাবে কোন দূরে—ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী...।” কিংবা “বর্ষা ওই এল বর্ষা/ অঝোর ধারায় জল ঝরঝরি অবিরল/ধূসর নীরস ধরা হ’ল সরসা।” গোলাম মোস্তফার কবিতায়—“আবার আসিল বরষা/অশ্রু-সলিল সরসা/ঘনাইয়া এল কাজল মায়া/ তরু...পল্লব পরশা।”

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা যেন ভিন্ন সুরে কথা কয়ে ওঠে : “শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে/ ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায়/ কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে ?/... বর্ষণ অনেকক্ষণ হয় থেমে গেছে,/ যত দূর চোখ যায় কালো আকাশ/মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে করে চুপ করে রয়েছে যেন;/ নিস্তব্ধ হয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।” বুদ্ধদেব বসুর পঙ্ক্তিমালাও আপনাকে দেবে নাড়া—“সকাল থেকেই বৃষ্টির পালা শুরু/ আকাশ হারানো আঁধার জড়ানো দিন।/ আজকেই যেন শ্রাবণ করেছে পণ,/ শোধ করে দেবে বৈশাখী সব ঋণ।” এমনকি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও আপনাকে আলোড়িত করবে—“বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠান পানে একা/দৌড়ে গিয়ে, ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা/ হয়তো মেঘে বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে/ আজানু কেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ ছেঁচা জলে/ কিন্তু তুমি নেই বাহিরে—অন্তরে মেঘ করে/ তারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।”

অন্যদিকে বর্ষাকে ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করেছে মুহম্মদ নূরুল হুদা : “বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/ মনে মনে বৃষ্টি পড়ে/ বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/ বনে বনে বৃষ্টি পড়ে/ মনের ঘরে চরের বনে/ নিখিল নিঝুম গাও গেরামে/ বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/ বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।”

 

শেষ কথা

হ্যাঁ, বর্ষা শুধু আমাদের যাপিত জীবনে নয়Ñমননেও ফেলে ছায়া। আমরা বৃষ্টিমুখর দিনে যেমন বৃষ্টিস্নান উপভোগ করি, তেমনি ঘরবন্দি থেকেও বর্ষাকে অনুভব করি প্রবলভাবে। তখন গল্প-উপন্যাস-কবিতা আমাদের সঙ্গী হয়। এমনিভাবে বর্ষায় বসবাস আমাদের দেহ আর মনে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.