ড্রাইভার খুব সাবধানে একটা মোষের গাড়িকে পাশ কাটিয়ে আবারো কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল। মাথা উঁচু করে সামনের কাদায় মাখামাখি কাঁচা রাস্তাকে ভালো করে দেখে বলল, ‘আপা, আর যাওয়া যাবে না।’
রূপা রাস্তাটা এক নজর দেখে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, এই রাস্তায় গাড়ি আটকে গেলে মহাবিপদ হয়ে যাবে।’
শাহরিয়ার বলল, ‘আমরা এখন তাহলে কী করব?’
রূপা মুখে একটা ড্যাম-কেয়ার ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘বাকি রাস্তা হেঁটে চলে যাব।’
শাহরিয়ার সুচালো মুখ করে বলল, ‘এ রকম কাদার মাঝে তোমার হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে?’
‘সবকিছুর অভ্যাস থাকতে হয় না, অভ্যাস হয়ে যায়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। বক্তৃতা থামিয়ে এখন গাড়ি থেকে নাম।’ রূপা তার হাত-ব্যাগটা তুলে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল, ‘আপনি এখানে ওয়েট করেন, আমরা আসছি।’
‘ঠিক আছে।’
‘আমাদের একটু দেরি হতে পারে, তাহলে কিছু খেয়ে নিবেন।’
ড্রাইভার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘সেইটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না আপা। এই গাঁও গেরামে কি আর খাওয়ার জায়গা আছে?’ ড্রাইভার ঢাকা শহরে গাড়ি চালায়, এ ধরনের অজ-পাড়াগ্রাম নিয়ে তার অবজ্ঞার সীমা নেই। শাহরিয়ার গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘রূপা, তুমি জানো যে তোমার আসলেই একটু মাথা খারাপ?’
রূপা শাড়িটা একটু উপরে তুলে সাবধানে কাদা বাঁচিয়ে পা ফেলে গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘সব মানুষেরই একটু মাথা খারাপ থাকে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আর যাদের একটু একটু মাথা খারাপ না, তারা আসলে খুব বোরিং। তাদের থেকে দূরে থাকতে হয়।’
‘কত দূরে?’
‘শ-খানেক কিলোমিটার হচ্ছে সেফ ডিস্টেন্স। দেখছ না তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছি।’
শাহরিয়ার ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তার মানে আমাকেও তুমি মাথা খারাপ ক্যাটাগরিতে ফেলছ?’
‘চেষ্টা করছি।’ রূপা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘দেখি সাকসেসফুল হই কি না। তোমার আশা আছে।’
শাহরিয়ার হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে মাথা ঝাঁকিয়ে পকেট থেকে সানগ্লাসটা বের করে চোখে পরে নিতেই গ্রামের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া একটা সড়ক, সড়কের দুইপাশে বড় বড় গাছ, এবং চারদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত— সবকিছু কেমন জানি একটা স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে নেয়। শাহরিয়ার একেবারে শতকরা একশ’ ভাগ শহরের ছেলে, অন্য দশজনের মতো ট্রেনের জানালা দিয়েও গ্রাম দেখেছে কি না সন্দেহ। আজকে রূপার পাল্লায় পড়ে তার সাথে এখানে চলে এসেছে। একটু হঠাৎ করেই এই মেয়েটার সাথে তার এক ধরনের আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রূপার মাঝে খানিকটা খামখেয়ালি, খানিকটা খ্যাপাটে একটা ভাব আছে। সারাজীবন রুটিন বাঁধা সময় কাটিয়ে এসেছে বলেই কি না কে জানে রূপার ভেতরকার এই অস্থির ছটফটে ভাবটা তাকে খুব আকর্ষণ করে। তার সাথে এসে গ্রামের এই সড়ক, গাছের ছায়া, ধানক্ষেত— সবকিছু ভালো লাগতে থাকে। শাহরিয়ার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উপরে তুলে শরীরের আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘এখন আমাকে কী করতে হবে?’
‘প্রথমে চৈতীকান্দা গ্রাম, তারপর সেই গ্রামে মাহতাব আলীকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘আমি সেটা জানি, কিন্তু কীভাবে সেটা করা হবে?’
‘সেটা যদি আমাকে বলে দিতে হয়, তাহলে তোমাকে ধরে এনেছি কেন?’
শাহরিয়ার মাথা চুলকে বলল, ‘কাজটা বুদ্ধিমানের মতো হয় নি। ঢাকা শহরে কম পয়সায় ভালো ফাস্টফুড কোথায় পাওয়া যায় আমি বলে দিতে পারব। কিন্তু…’
রূপা শাহরিয়ারকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না। ঐ লোকগুলোকে জিজ্ঞেস কর।’
শাহরিয়ার মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, খানিকটা দূরে একটা বটগাছ, তার নিচে একটা চালাঘর- সম্ভবত এটি একটি দোকান। সেই দোকানের সামনে একটি বেঞ্চে কয়েকজন মানুষ অলস ভঙ্গিতে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামের মানুষজন এখনো বাইরের মানুষদের খুব কৌতূহল নিয়ে দেখে, বিশেষ করে তারা যদি গাড়ি করে আসে এবং সেখানে রূপার মতো একজন শহুরে মেয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। শাহরিয়ার বলল, ‘চল।’
দু’জন দোকানটার কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথে মানুষগুলো বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল, দোকানের ভেতরে বসে থাকা মানুষটি মাথা বের করে কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে তাকাল। দোকানটি একই সাথে মুদির দোকান এবং মনোহারী দোকান। একপাশে একটা মাটির চুলায় কালিঝুলি মাখা তোবড়ানো দুটো কেটলি, একটা গামলায় নোংরা পানিতে ডোবানো ছোট ছোট কয়েকটা কাপ, দেখে মনে হয় একই সাথে এটি একটি চায়ের দোকান। শাহরিয়ার কাছাকাছি এসে ঠিক নির্দিষ্টভাবে কাউকে উদ্দেশ না করে জিজ্ঞেস করল, ‘চৈতীকান্দা গ্রাম এখান থেকে কতদূর?’
বুড়োমতন একজন মানুষ শাহরিয়ারের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘চৈতীকান্দায় কার বাড়ি যাবেন?’
এবার রূপা প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, ‘আমরা মাহতাব আলী নামে একটা মানুষকে খুঁজছি।’
‘মাহতাব আলী?’ বুড়ো মানুষটি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চৈতীকান্দায় মাহতাব আলীটা আবার কে?’
অন্য মানুষগুলো চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল, তারাও মাহতাব আলীকে চিনতে পারছে না। দোকানের ভেতরে বসে থাকা মানুষটি মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে মাহতাব আলী?’
রূপা বলল, ‘এখন কী করে সেটা তো জানি না। সেভেন্টি ওয়ানে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। খুব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা- কমলপুরের ফাইটে একবার একা একটা প্লাটুন আর্মিকে আটকে রেখেছিলেন।’
বুড়ো মানুষটা এমনভাবে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল যেন ঠিক বুঝতে পারছে না রূপা কী বলছে। এখন একটি মানুষকে খোঁজা হচ্ছে, ত্রিশ বছর আগে সে কী করত সেই তথ্যটা কী কাজে লাগবে মানুষটা বুঝতে পারছে না।
শাহরিয়ার বলল, ‘এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কারা আছে?’
চেয়ারম্যান সাহেব, কাশেম চাচা আর রহমত মাস্টার। কাশেম চাচা গত ইলেকশনে খুন হইল, এখন বাকি আছে দুইজন।
মাঝবয়সী একজন বলল, ‘মোফাজ্জলের একটা ভাইও ছিল কিন্তু সে তো আর সংগ্রামের পর ফিরে আসে নাই।’
দোকানের ভেতর বসে থাকা মানুষটা বলল, ‘সে রকম তো অনেক মানুষই আছে।’
বুড়োমতন মানুষটা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, রূপা বাধা দিয়ে বলল, ‘আসলে এই মাহতাব আলী এই গ্রামের না। তার বাড়িঘর নদীর পাড় ভেঙে ডুবে গেছে। তখন এদিকে এসেছে। আমরা অনেকদিন থেকে খোঁজ করার চেষ্টা করছি…’
বুড়োমতন মানুষটা অন্য মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় কথা বলল এবং সবাই কিছু একটা বুঝে ফেলেছে এ রকম ভাব করে মাথা নাড়তে লাগল। মাঝবয়সী মানুষটা বলল, ‘বুঝেছি। দুই বছর আগে বানের মওশুমে খাসজমিতে কিছু মানুষ উঠেছে। সেখানে থাকতে পারে। আমরা তাদের ভালো চিনি না।’
অন্যেরা মাথা নাড়ল, একজন বলল, ‘খারাপ অবস্থা, খুব খারাপ অবস্থা। গ্রামের মানুষের সাথে তাদের সদ্ভাব নাই।’
বুড়ো মানুষটি দার্শনিকের মতো বলল, ‘কেমন করে থাকবে? অভাবে স্বভাব নষ্ট। গ্রামে চুরি চামারি করে…’
এই ছোট দলটির মাঝে তুলনামূলকভাবে কম বয়স্ক মানুষটি তখন গত বছর কার্তিক মাসে কীভাবে একজন গরুচুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল এবং গ্রামের মানুষেরা কীভাবে শাস্তি হিসেবে তার দুটি পা ভেঙে জন্মের মতো লুলা করে দিয়েছিল— সেই ঘটনাটি বেশ বিষদভাবে বর্ণনা করল। শাহরিয়ার এবং রূপাকে ধৈর্য ধরে সেই গল্পটি শুনতে হলো এবং গল্প শেষ হবার পর শাহরিয়ার জানতে চাইল, ‘সেখানে কি মাহতাব আলী নামে কেউ থাকে?’
মানুষগুলো না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল, একজন বলল, ‘সেটা তো জানি না। গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।’
শাহরিয়ার জানতে চাইল, ‘যাবার ব্যবস্থা কী? রিকশা যায়?’
বুড়ো মানুষটা বলল, ‘জে যায়। তবে রাস্তা ভালো না।’
‘কত দূর?’
‘এই মনে করেন রিকশা করে গেলে আধা ঘণ্টা লাগবে।’
মাঝবয়সী মানুষটা বলল, ‘কী বললেন আধা ঘণ্টা? পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না।’
কমবয়সী মানুষটা প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘কী বলেন আপনি? রাস্তার কি মা-বাপ আছে? কমপক্ষে একঘণ্টা!’
কাজেই রূপা আর শাহরিয়ার যখন একটা রিকশাওয়ালাকে চৈতীকান্দা গ্রামে নিয়ে যাবার জন্যে রাজি করিয়ে রওনা দিয়েছে তখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে তাদের কতক্ষণ লাগবে সে বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই!
চৈতীকান্দা গ্রামটি বেশ বড়। সেই গ্রামে পৌঁছে মজে যাওয়া নদীর তীরে খাস জমিতে বানের জলে ভেসে আসা মানুষগুলোর আস্তানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে শাহরিয়ার আর রূপার দুইঘণ্টা সময় লেগে গেল।
তারা সেখানে উপস্থিত হতেই তাদেরকে ঘিরে একটা ছোটখাট ভিড় জমে যায়। পুরুষ মানুষেরা প্রায় সবাই কাজে বের হয়ে গেছে, যারা আছে তাদের বেশিরভাগই শিশু আর মহিলা। মানুষগুলো হতদরিদ্র; চাটাই, পলিথিন, কার্ডবোর্ডের বাক্স- এ ধরনের জিনিস ব্যবহার করে কিছু ঘর তুলেছে। বাড়ির পেছনে কেউ কেউ লাউগাছ লাগিয়েছে, ঘরদুয়ারে আবর্জনা, শুকনো হাড় জিরজিরে কিছু মুরগি সেই আবর্জনা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। যে বয়সে বাচ্চাদের কাপড় পরে থাকার কথা- অনেক বাচ্চাই তার থেকে বেশ বড় হয়েও পুরোপুরি উদোম গায়ে এসে ভিড় করেছে। এত কাছাকাছি থেকে এ রকম হতদরিদ্র মানুষ দেখে রূপা কিংবা শাহরিয়ারের অভ্যাস নেই, দু’জনেই কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। রূপা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘এখানে মাহতাব আলী নামে কেউ থাকে?’
উপস্থিত যারা ছিল তারা কেউ সাথে সাথে উত্তর দিল না। একজন আরেকজনের সাথে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করল। এই মানুষগুলো ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে না, কী বলতে গিয়ে কোন বিপদে ফেলে দেবে কে জানে। শেষ পর্যন্ত তোবড়ানো গাল, পাকা চুলের একজন বুড়ো মানুষ জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? মাহতাব আলী কী করেছে?’
‘কিছু করে নাই।’ রূপা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, ‘মাহতাব আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
‘মুক্তিযোদ্ধা’ কথাটা মানুষগুলো কেউ জানে বলে মনে হলো না, একজন আরেকজনের কাছে সেটা বোঝার চেষ্টা করল। ফোকলা দাঁতের একজন বুড়ি শেষপর্যন্ত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘বুঝেছি। সংগ্রামের সময় যুদ্ধ করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
বুড়ি তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে মাথা নেড়ে বলল, ‘না। আমাগো মাহতাব আলী সাদাসিধা কিছিমের বুড়া মানুষ! সে যুদ্ধ করে নাই।’
তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা কিশোর হি-হি করে হেসে বলল, ‘মাহতাব চাচা সোজা হয়ে খাড়াইতেই পারে না, সে যুদ্ধ করবি কেমন করে?’
শাহরিয়ার তখন মাহতাব আলীর সাহায্যে এগিয়ে এলো, বলল, ‘সংগ্রাম হয়েছে অনেক আগে। মাহতাব আলী তখন জোয়ান মানুষ ছিলেন। তখন যুদ্ধ করেছেন।’
বুড়িটি তার ফোঁকলা দাঁতে হাসতে হাসতে খুব মজার কথা শুনেছে এ রকম ভান করে মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, ‘আমাগো মাহতাব আলী সোজাসিদা মানুষ। কিছু বুঝে সুঝে না। হে রাজনীতি করে নাই।’
রূপা বলল, ‘রাজনীতি তো বলি নাই। মুক্তিযুদ্ধ বলেছি।’
বুড়ি বলল, ‘ঐ একই কথা।’
রূপা বলল, ‘না, এক কথা না। কোনো রাজনীতি করে নাই কোনো দল করে নাই এ রকম অনেক মানুষ যুদ্ধ করেছে।’
বুড়ি যুক্তি-তর্কের দিকে অগ্রসর হলো না, ফোকলা দাঁত বের করে হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়তে লাগল। সে গত দুই বছর মাহতাব আলীকে খুব ভালোভাবে দেখেছে। তাকে সে কোনোভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করতে পারে না- ত্রিশ বছর আগে হলেও না।
রূপা আর এই বিতর্কে অগ্রসর হলো না। জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আছে মাহতাব আলী?’
তোবড়ানো গাল আর পাকা চুলের বুড়ো মানুষটা বলল, ‘মনে হয় মাটি কাটার কাজে বের হয়েছে।’
‘কোথায় মাটি কাটার কাজ?’
বুড়ো মানুষটা উপস্থিত মানুষজনের সাথে কথা বলল, তারপর হাত দিয়ে অনির্দিষ্ট একটি দিক দেখিয়ে বলল, ‘নয়া সড়কের কাছে। সরকারি খাল কাটার কাজ।’
জায়গাটা কোথায় জেনে নিয়ে রূপা আর শাহরিয়ার বের হয়ে এলো। তাদের পিছু পিছু উদোম গায়ের ছেলেমেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে গেল। হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর জীবনে নতুন কিছু ঘটে না। শহরের এই সাহেব এবং এই মেয়েলোক চলে এসেছে তাদের মাহতাব চাচার খোঁজ করার জন্য এটা তাদের কাছে অনেক বড় ঘটনা।
নয়া সড়কের কাছে খাল কাটার কাছাকাছি গিয়ে তারা একটা জটলা এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ এবং হাতাহাতির মাঝে পড়ে গেল। শুকনো একজন মানুষ একজন বুড়ো মতন মানুষের সাথে চিৎকার করে ঝগড়া করছে, বুড়ো মানুষটিও তার বয়সের তুলনায় আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে কোমরে গামছা বেঁধে শুকনো মানুষটির দিকে এগিয়ে গেল। শুকনো মানুষটি হঠাৎ বুড়ো মানুষটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, বুড়ো মানুষটি প্রস্তুত ছিল না এবং হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। অন্য মানুষেরা তখন হৈ-হৈ করে এগিয়ে আসে এবং ঝগড়া মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করতে থাকে। এদের ভেতরে একজন নিশ্চয়ই সর্দার, সে অশ্রাব্য ভাষায় সবাইকে গালিগালাজ করতে থাকে, দুই একজনকে কিল-ঘুসিও মেরে বসে। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া বুড়ো মানুষটি দুর্বলভাবে তার অভিযোগটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু সর্দার শুনতে রাজি হলো না, ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে শাহরিয়ার আর রূপার দিকে এগিয়ে এলো।
এই পুরো ব্যাপারটিতে শাহরিয়ার আর রূপা কেমন যেন নিজেদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করতে থাকে। বয়স্ক মানুষের ঝগড়াঝাঁটি বা হাতাহাতি খুব অসুন্দর দৃশ্য এবং হঠাৎ করে হাজির হয়ে এ রকম একটা অসুন্দর দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে তাদের কেমন যেন অপরাধী মনে হতে থাকে।
মাটি কাটার মানুষগুলো দেখতে দেখতে কাজ শুরু করে দেয়। তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে, কেউ মাটি কাটছে, কেউ মাথায় করে নিচ্ছে, কেউ নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে ফেলে আসছে। মানুষগুলোর ভাবলেশহীন মুখ দেখে মনে হয় যেন মানুষ নয়, যন্ত্র কাজ করছে।
সর্দার শাহরিয়ার আর রূপার কাছাকাছি এসে তাদেরকে একটা সালাম দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
শাহরিয়ার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আমরা আসলে একজন মানুষকে খুঁজতে এসেছি।’
‘কোন মানুষ?’
‘মানুষটার নাম হচ্ছে মাহতাব আলী।’
সর্দার মানুষটি সন্দেহের চোখে তাদের দিকে তাকাল, তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, ‘কেন?’
এবারে রূপা সর্দারের প্রশ্নের উত্তর দিল, বলল, ‘আমার ছোট মামা আর মাহতাব আলী সেভেন্টিওয়ানে এক সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট মাহতাব আলী আমার মামার জীবন বাঁচিয়েছিলেন।’
সর্দার রূপাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘কে জীবন বাঁচিয়েছিল?’
‘মাহতাব আলী।’
‘আমাদের মাহতাব আলী?’
রূপা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘আপনাদের এখানে মাহতাব আলী আছেন? কোনজন?’
সর্দার সরু চোখে কিছুক্ষণ রূপার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলে সড়কের পাশে খালের নিচে মাটি কাটা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘মাহতাব!’
কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে কাটতে একজন মানুষ হঠাৎ করে থেমে গিয়ে উপরের দিকে তাকাল। শাহরিয়ার আর রূপা দুজনেই মানুষটাকে চিনতে পারে, একটু আগে চিৎকার, হৈচৈ হাতাহাতি করার সময়ে এই মানুষটিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল। মানুষটি, যার নাম মাহতাব আলী এবং যাকে রূপা নানাভাবে গত ছয়মাস থেকে খুঁজে আসছে, উপরে তাকাল, বলল, ‘জে।’
‘উপরে আয়। এই স্যারেরা তোরে খুঁজে।’
মাহতাব আলী কয়েকমুহূর্ত কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কোদালটা রেখে উপরে উঠে আসতে থাকে। উঠে আসতে আসতে সে কোমরের গামছাটা খুলে মুখ মুছে নিল। তারপর গামছাটা কোমরে না বেঁধে সে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিল, একজন ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করার জন্যে তার এর চাইতে বেশি কিছু ভদ্রতা করার ক্ষমতা নেই।
মাহতাব আলী শাহরিয়ার আর রূপার সামনে এসে দাঁড়াল, তার মুখে এক ধরনের শঙ্কা। ভালো পোশাক পরা কোনো মানুষ যখন তাদের খোঁজ করতে আসে সেটি কখনো ভালো খবর হতে পারে না। রূপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম মাহতাব আলী?’
মাহতাব আলী কথা না বলে মাথা নাড়ল।
‘সেভেন্টিওয়ানে আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?’
হঠাৎ করে মানুষটি কেমন জানি কেঁপে উঠল। রূপা অবাক হয়ে দেখল মানুষটি কেমন যেন সিঁটিয়ে গেছে, মুখে বিস্ময়ের একটা ছাপ পড়েছে। মানুষটিকে দেখে মনে হয় সে যেন রূপার কথা বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, ‘কী বললেন?’
‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা না? কমলপুরে আপনি যুদ্ধ করেছিলেন না? আমার মামার নাম আকরাম হোসেন। মামার কাছে আপনার গল্প শুনেছি।’
মাহতাব আলী খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘জে না। আমি মুক্তিযোদ্ধা না।’
রূপা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব আলী না?’
‘না।’
‘কিন্তু কিন্তু’- রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু আমি অনেক খোঁজ করে এসেছি, আমি জানি।’
মাহতাব আলী দুর্বলভাবে হাসল। হেসে বলল, ‘আমি অন্য মানুষ। ভুল মানুষ।’
তারপর রূপাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ঘাড় থেকে গামছাটা নিয়ে একবার মুখ মুছল, তারপর সেটা কোমরে বেঁধে খাল কাটার জন্যে হেঁটে ফিরে যেতে শুরু করে।
রূপা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর মাহতাব আলীর কাছে গিয়ে ডেকে বলল, ‘শুনেন, শুনেন আপনি।’
মাহতাব আলী ঘুরে দাঁড়াল, কোনো কথা না বলে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
রূপা কাতর গলায় বলল, ‘আপনি কেন স্বীকার করছেন না? আমি আমার মামার কাছে আপনার সব গল্প শুনেছি।’
মাহতাব আলী কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
রূপা বলল, ‘আপনার বুকের ভেতর কোনো ভয়ডর ছিল না। গ্রেনেডের পিন খুলে হাতে চেপে আপনি বাংকারের ভেতরে ফেলে আসতেন। গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে আপনি রাতের পর রাত হেঁটে যেতেন আপনি।’
মাহতাব আলী হঠাৎ মাথা তুলে রূপার দিকে তাকাল, মনে হলো কিছু একটা বলবে। কিন্তু সে কিছু বলল না, কেমন যেন হতচকিত চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল।
রূপা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার মামা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন, আপনি ছিলেন চাষী। আপনারা দুইজন অন্ধকারে এমবুশ করার জন্যে অপেক্ষা করতেন; একটা সিগারেট দুইজন ভাগ করে খেতেন। সিগারেটের আগুন হাত দিয়ে আড়াল করে রাখতেন যেন মিলিটারি দেখতে না পায়। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ত, তার মাঝে দুইজন মেশিনগান বুকে চেপে শুয়ে থাকতেন!’
মাহতাব আলী কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। রূপা হঠাৎ কেমন জানি হিংস্র গলায় বলল, ‘কেন আপনি স্বীকার করছেন না?’
মাহতাব আলী মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমি অন্য মাহতাব আলী।’
রূপা প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘না! আপনি সেই মাহতাব আলী! আমি জানি। কমলপুরের ফাইটে আপনি একা একটা মেশিনগান নিয়ে এক প্লাটুন আর্মিকে আটকে রাখলেন। তারপর অন্ধকার হলে আমার গুলি খাওয়া মামাকে পিঠে নিয়ে তিন মাইল ছুটে গেলেন! মনে নাই?’
‘না।’ মাহতাব আলী শক্ত মুখে বলল, ‘আমি এইসব জানি না।’
‘মনে নাই? আপনার কোলে মাথা রেখে আক্কাস আলী মারা গেল? আপনি চিৎকার করে কাঁদলেন বাচ্চা মানুষের মতো। মনে নাই?’
‘না।’ মাহতাব আলী বলল, ‘আমার কোলে মাথা রেখে কেউ মারা যায় নাই।’
মাহতাব আলী হঠাৎ করে ঘুরে হেঁটে যেতে শুরু করল, রূপা পেছন পেছন ছুটে যেতে চেষ্টা করল কিন্তু শাহরিয়ার খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। ফিসফিস করে বলল, ‘রূপা! প্লিজ ওনাকে যেতে দাও।’
হঠাৎ করে রূপার চোখে পানি এসে যায়, সে ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে চোখের পানি আটকে রাখার চেষ্টা করে। ঝাপসা চোখে দেখতে পায় একজন বৃদ্ধ মানুষ দুর্বল পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। নিচে গিয়ে সে মাটি কাটবে।
অভিমানের অশ্রুতে ভিজে নরম হয়ে থাকা বাংলাদেশের মাটি।
Leave a Reply
Your identity will not be published.