নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (সপ্তম পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (সপ্তম পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।]

হারিয়ে গেছি।

ভোরবেলা নিউইয়র্কের বিখ্যাত ‘ওয়ালডর্ফ এস্টোরিয়া’ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কাজে এসেছি ভোর সাড়ে চারটার দিকে। আকাশ তখনো অন্ধকার। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কম ঘুমানোর কারণে আমার চোখে রাজ্যের জ্বালাপোড়া। এত ভোরবেলা আমার জীবনে খুব কমই উঠেছি। একটা কফি কিনলাম যাতে ঘুম কাটে। যাত্রী পাওয়ার আশায় এদিক ওদিক অনেকক্ষণ ঘুরলাম। লাভের লাভ কিছুই হলো না। গাড়ির অনেকখানি তেল জ্বলল আর এই ভোরবেলায় রাস্তাঘাটে মানুষজন আশা করাটাও বোকামি। ওদিকে আমি নতুন! এবেবারেই নবিস।  ট্যাক্সি ব্যবসার ধারা ফারা এখনো বুঝে উঠতে পারি নি। আর এত তাড়াতাড়ি বুঝে ওঠার কথাও না। কারণ সেদিন ছিল আমার ট্যাক্সিজীবনের তৃতীয় দিবস। প্রতি সপ্তায় একদিন ট্যাক্সি চালাই আর সেটাও রবিবারে।

শনি-রবিবার এ দেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মানুষজন আরাম করে ঘুমাচ্ছে। উইকেন্ডে সাধারণত এই শহরটা দশটার আগে জাগে না। লোকজন ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট+লাঞ্চ) খাবার উদ্দেশ্যে বেলা করে বাসা থেকে বের হয়। রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকে উপচেপড়া ভিড়। নিরাশ আমি অনেকক্ষণ যাত্রীর আশায় ঘুরাঘুরি করে মোটামুটি হতাশ হয়ে ‘ওয়ালডর্ফ এস্টোরিয়া’ হোটেলের সামনের লম্বা ট্যাক্সি লাইনে গাড়িটি ঢুকিয়ে দিলাম। ভোরবেলা হোটেলের লোকজন এয়ারপোর্টে যায়। লাইনে আমি একা না আরও অনেক ট্যাক্সি আছে। ড্রাইভাররা এক কোনায় জট পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার বিষয়বস্তু কী তা সহজেই অনুমেয়! অমুক যাত্রী ভালো টিপস দেয় নি, তমুক যাত্রী বমি করে গাড়ি ভাসিয়ে দিয়েছে, কালো প্যাসেঞ্জার ভাড়া না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেছে, যন্ত্রণাদায়ক সাদা বুড়ি কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। আমিও আড্ডায় যোগ দিলাম। আমি আড্ডাপ্রিয় মানুষ। জটলা পছন্দ করি। আমেরিকায় আসার পর সবচাইতে বেশি যে জিনিসটা মিস করি তা হচ্ছে আড্ডা। এখানে আড্ডার সুযোগ কম। শুধু কাজ আর কাজ! সেই আড্ডায় বাংলাদেশি ড্রাইভার ছিলেন বেশ কয়েকজন তাছাড়া মিশরীয়, স্প্যানিশ, ইন্ডিয়ান শিখ, পাকিস্তানি, ঘানাসহ আরও নানা দেশের লোকজন।

বাবার বয়সী বাংলাদেশি এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। নাম মাহবুব আহমেদ। দেশে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বর্তমানে ট্যাক্সি ড্রাইভার। বেশ রসিক মানুষ। আমি নতুন কাজে নেমেছি শুনে আমাকে নানান উপদেশ দিলেন। যেমন কীভাবে কাজ করতে হয়। কোথায় প্যাসেঞ্জার থাকে? আমি অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে কোনো প্যাসেঞ্জার পাই নি শুনে আমাকে বললেন, রবিবার ভোরবেলা রাস্তাঘাটে না ঘুরে সোজা কোনো হোটেলে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে যাবেন। কারণ রবিবারে প্রচুর লোকজন এয়ারপোর্টে যায়। রাস্তায় কাজ করবেন দশটার পর। ভাগ্য ভালো থাকলে ভোর পাঁচটা থেকে দশটার ভেতর দুই-তিনটা এয়ারপোর্টের ট্রিপ করতে পারবেন। তারপর উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সব এয়ারপোর্ট কি চেনেন?

বললাম, জেএফকে আর লা গুয়ার্ডিয়া চিনি, তবে নিউওয়ার্ক এয়ারপোর্ট চিনি না। কখনো যাওয়া হয় নি। 

মাহবুব ভাই বললেন, যাওয়া খুব সহজ। লিংকন টানেল ধরবেন তারপর নিউ জার্সি টার্ন পাইক সাউথ। এক এক করে একসময় আমার সামনে দাঁড়ানো সবগুলো ট্যাক্সি প্যাসেঞ্জার উঠিয়ে চলে গেল। মাহবুব ভাইও চলে গেলেন। এবার আমার পালা।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.