টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়িকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই তথা geographical indication) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) মঙ্গলবার এ স্বীকৃতি দেয়।
৭ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আজ ৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হবে। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পেতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়।
৭ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম ই-মেইলের মাধ্যমে আবেদন ও প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাঠান। ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে এর হার্ড কপি জমা দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে ডিপিডিটি এই স্বীকৃতি দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত, সম্প্রতি বাংলাদেশের বিখ্যাত 'টাঙ্গাইল শাড়ি'কে নিজস্ব জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় এক পোস্টে বলে, '!টাঙ্গাইল শাড়ি' পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং ও সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।"
এরপর থেকে বাংলাদেশের নেটিজেনদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তারা জানান, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলা থেকেই টাঙ্গাইল শাড়ির নামটির উৎপত্তি। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়তো শাড়ির নাম ভুল লিখেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জিআই পণ্য। তাই কোনো একটি পণ্যকে এর তালিকাভুক্ত করতে মুখিয়ে থাকে দেশগুলো। কিন্তু জটিলতা বাঁধে যখন একই পণ্যকে একাধিক দেশ নিজেদের বলে দাবি করে। এমনটাই ঘটেছে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে।
শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে (ডাব্লিউআইপিও) সমস্যাটি সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে। সেখানে যাওয়ার আগে নিজেদেরকে পণ্যটিকে আগে জিআই হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায়, শিল্প মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিল।
টাঙ্গাইল শাড়ির রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস, এটি বাংলাদেশের প্রাচীন কুটির শিল্পের অন্যতম প্রতিনিধিত্বমূলক পণ্য। ব্রিটিশ আমলেও এর অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়। উনিশ শতকের শেষের দিকে এর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বাংলাদেশের একাধিক সম্প্রদায় টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদন করে, তাদের মধ্যে টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বসাক সম্প্রদায় প্রাচীনতম।
দেশভাগ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক তাঁত কারিগর ভারতে পাড়ি জমান। তারা পশ্চিমবঙ্গে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এরপর তারা সেখানে এই শাড়িকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
স্বীকৃতি মিলেছে ২১ বাংলাদেশি পণ্যের
২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে সেই আইন হলো। আর প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হলো জামদানি। বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই নথিভুক্ত হলো এই শাড়ি। ভারতও জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করল, তবে ‘উপাধা জামদানি’ নামে। বাংলাদেশে এরপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। আর সম্প্রতি জিআই স্বীকৃতি পেল টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল।
Leave a Reply
Your identity will not be published.