[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন ১৩ তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২
ইন্সপেক্টর লাবণির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রফেসর জাহিদ ভাবলেন, ওমা, এ তো কোনো তুলতুলে জুঁইফুল না, এ যে দেখি খাপখোলা বাঁকা তলোয়াড়, চকচকে আর মণিমাণিক্য-খচিত। অমন ধারালো ফণা-তোলা শরীর কিন্তু চোখ দুটো কেমন ভাসা ভাসা, পাল উড়িয়ে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে।
প্রফেসরের হৃদয়ের কোথায় যেন একটা চিনচিনে ব্যথা বেজে উঠল। প্রফেসর জাহিদ নিজেই নিজের মনকে ধমক দিয়ে বললেন, রূপের মধুর মোহ সামলাও প্রফেসর, এমনিতেই তো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছো। তবে প্রফেসর বুঝতে পারেন না শিল্প-সাহিত্যের মানুষেরা তিন-চারটে প্রেম করলে কী এমন দোষ হয়: ধুরন্ধর মারুফ যদিও গাড়ির ব্যবসা করে, সে পড়েছে স্থাপত্যে। শম্পার ব্যাপারে সে সোজাসাপ্টা বলেছে, শোন প্রফেসর, তুই এত মিনমিনে কেন? ক্ষণিক-প্রেম করতে ইচ্ছে হয়েছে করেছিস, দ্যাটস অল। বউ কিছু জিজ্ঞেস করলে পাত্তাই দিবি না। জাস্ট ইগনোর। আমি তো তাই করি।
আমি শম্পার সঙ্গে প্রেম করি নাই।
আবার মিনমিন করছিস! এত হাইড করার কিছু নাই রে পাগলা, ইউ অ্যাক্ট লাইক অ্যা কাওয়ার্ড। এই যে এত সুন্দর সংসদ ভবন, পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য। কে করেছে জানিস?
নাহ।
লুই কান।
তো?
লুই কানের মৃত্যুর পর প্রথম জানা গেল বউ ছাড়াও ওই একই শহরে কয়েক মাইল দূরে দূরে তার আরও দুজন প্রায়-স্ত্রী ছিল। ওই দুই ঘরে তার সন্তানও ছিল। তাঁদের নিয়ম করে দেখতেও যেতেন। কিন্তু লুই কানের দুই কান ধরে কেউ কি টেনেছে? পৃথিবী শুধু মনে রেখেছে সংসদ ভবনের কথা। আর তুই রামছাগল একটা কর্লগালের সঙ্গে ইষ্টিকুটুম মিষ্টিকুটুম করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলি। তোকে বন্ধু বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হয়। ছিঃ! ধিক, ধিক।
এ কারণেই ইন্সপেক্টর লাবণির দিকে তাকিয়ে প্রফেসর ভাবছেন, আমার জীবনের বসন্ত বুঝি আজও ফুরায় নি, ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে যাব আমি জীবনের জয়গান।
কোনটা মুগ্ধ দৃষ্টি আর কোনটা লোলুপ দৃষ্টি মেয়েরা সহজে টের পায়। ইন্সপেক্টর লাবণি প্রফেসরের মুগ্ধ দৃষ্টির আঁচে সামান্য অস্বস্তি বোধ করছে কিন্তু ওর গাট ফিলিংস বলছে এই লোকটা সম্ভবত খারাপ না। তবে লোকটা মনের দিক থেকে বেশ নাজুক এবং ভঙ্গুর, কবিদের মতো।
আজ শুক্রবার। রোকসানার অনুরোধে পার্সোনাল ক্যাপাসিটিতে আজ ইন্সপেক্টর লাবণি জাহিদদের বাসায় এসেছে। ছুটির দিন, ইনফরমাল ব্যাপার, তাই লাবণি লাল-কালোর কাজ করা একটা জামদানি শাড়ি পরেছে, ঠোঁটে খুব হালকা করে লিপস্টিক লাগিয়েছে। রোকসানাদের ড্রইংরুমে চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে লাবণি বলল, বুঝতেই পারছেন আমি যা করব তা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে করতে হবে। রোকসানা আপা আমার বান্ধবীর বড় বোন বলেই আমি এই কেইস নিতে রাজি হয়েছি।
জি, এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
শম্পার সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে আপনি দাবি করছেন। সে ব্যাপারে পরে কথা বলব। উল্টোদিক থেকে আরম্ভ করি। আপনি কি শম্পার মৃতদেহ দেখেছেন?
জি, গতকাল পুলিশ আমাকে আইডেন্টিফিকেশনের জন্য নিয়েছিল।
প্রথমেই যেই প্রশ্ন মনে আসে, ওই ডেডবডি কি শম্পার?
মুখের কিছু অংশ থেঁতলে গেছে কিন্তু ওটা শম্পাই মনে হয়েছে।
মনে হয়েছে?
চুল ছোটো করে কাটা ছিল। শম্পার চুল হাঁটু পর্যন্ত লম্বা।
কেউ চুল কেটে ফেলতেই পারে ইচ্ছে করে। ছোট চুল হঠাৎ লম্বা হয়ে গেলে চিন্তার ব্যাপার হতো আপনার সঙ্গে শম্পার যেই পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাতে আশা করছিলাম আপনি এক শ’ ভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন মৃত মেয়েটি শম্পা কি-না।
আপনারা সবাই আমাকে যত খারাপ ভাবছেন আমি অত খারাপ না। বারবার বলছি আমাকে ভিক্টিমাইজ করা হচ্ছে। আমার সঙ্গে শম্পার কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল কি-না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। উল্টো, শি ওয়াজ স্টকিং মি।
জি আমি রহিপনল ড্রাগের কথা শুনেছি, যদিও কোনো প্রমাণ নেই সেটা প্রতিবার আপনি মিশিয়েছেন না শম্পা মিশিয়েছে!
মানে, কী বলছেন আপনি?
মানে এমন তো হতেই পারে আপনি ওকে রহিপনল খাইয়ে শেষে নিজেও খেয়েছেন যেন মনে হয় আপনিই ভিক্টিম।
প্রফেসর জাহিদ এবার সামান্য উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনি এরকম উদ্ভট একটা চিন্তা কীভাবে মাথায় আনলেন?
আমি ডেভিলস অ্যাডভোকেট হিসেবে কথাটা বললাম, মানে সরকারি আইনজীবী আদালতে এই কথাটা বলে আপনাকে আটকে দেবে। আই অ্যাম ট্রাইং টু হেল্প ইউ।
তাহলে উপায় কী? আমি কী জবাব দেব?
আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে। শম্পার রক্তের স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়েছে জানি। আমি অলরেডি মগবাজার থানার ওসিকে ইনফরমালি রিকোয়েস্ট করেছি রক্তের স্যাম্পলে রহিপনল আছে কি-না আবার দেখতে। লেটস সি কী হয়। আরেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছি।
কী কাজ?
আপনার বন্ধু মারুফের ব্যাপারে আমি খোঁজ নিয়েছি। এ রকম একজন নিম্নমানের লোক আপনার বন্ধু হয় কীভাবে বুঝলাম না। মেয়েদের পেছনে ইনি প্রচুর টাকা ওড়ান। আর সে জন্য প্রচুর লোন করেন।
আপনি কীভাবে জানেন? ওর কাছে তো আমিই দু’ লাখ টাকা পাই।
আমরা ওর টেক্সট মেসেজ চেক করেছি।
আপনারা কি আমার টেক্সট মেসেজও চেক করেছেন?
হুম করতে তো হবেই, তাই না? আচ্ছা বলুন তো, শম্পা আপনাকে চান্দু বলত কেন? টেক্সট মেসেজ জুড়ে শুধু চান্দু, চান্দু আর চান্দু।
আই হ্যাভ নো আইডিয়া। আমি চান্দু না।
ভালোই ঘোল খাইয়েছে শম্পা আপনাকে। অনেকে ভাববে সেটাই মার্ডারের মোটিভ।
প্রফেসর জাহিদ কোনো উত্তর দিলেন না। লাবণি বলল, আপনার মেয়ে মিলি তো শম্পার সঙ্গে পড়ত?
জি, অ্যাপারেন্টলি, শম্পা সম্ভবত ইলিগালি ক্লাস করত। মিলির কথা কেন বলছেন?
মিলি তো ডেডবডি দেখে নি?
নাহ।
আপনি বলছেন আপনার সঙ্গে শম্পার কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল না?
আবার আপনি একই কথা বলছেন!
শেষ করতে দিন। ধরুন শম্পার পিঠে কিম্বা কোমরের কাছে একটা টাটু কিম্বা জন্মদাগ আছে, সেটা তো আপনি জানবেন না, কিন্তু অনেক সময় এক মেয়ে আরেক মেয়েকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে জানতেই পারে, ছেলেরা যেমন ছেলেদেরকে।
আমি তো ওভাবে ভাবি নি, একটার পর একটা শকিং ঘটনা ঘটছে, আমি অলরেডি ওভারহয়েল্মড।
মিলিকে কি ডাকা যায়?
রোকসানা ইছে ঘরেই ড্রইংরুমে আসে নি, জাহিদ যেন মন খুলে কথা বলতে পারে। প্রফেসর জাহিদ পাশের ঘরে গিয়ে রোকসানাকে বললেন মিলিকে বুঝিয়ে ওখানে আনতে। শম্পা যতক্ষণ নিখোঁজ ছিল ততক্ষন এক কথা, একটা কিছু আশা রয়ে যায়। কিন্তু শম্পার ডেডবডি পাওয়া গেছে শোনার পর থেকে মিলি আবার মুষড়ে পড়েছে। একটু পরপর ডুকরে কাঁদছে। মিলি ঘরের গাউন পরেই চলে এল, বোধ হয় চুলও আঁচড়ায় নি। লাবণি বলল, তুমি নিশ্চয় জানো আমি গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর লাবণি।
মিলি কিছু বলল না, মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
জানি তুমি প্রচণ্ড শকে আছো। কিন্তু তুমি নিশ্চয় চাও না তোমার বাবা অপরাধ না করে দোষী সাব্যস্ত হোক? এ রকম কেইসে যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসি হয়ে যেতে পারে।
মিলি এবার মুখ খুলল, না, আমি চাই না।
তাহলে তোমাকে এক কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
এটা যদিও আমার কেইস না, কিন্তু আমি রিকোয়েস্ট করলে ওরা তোমাকে শম্পার ডেডবডি আইডেন্টিফাই করতে দেবে।
ঠিক আছে আমি যাব।
থ্যাঙ্ক ইউ মিলি। আমি চেষ্টা করব পারলে আজ বিকেলেই ব্যবস্থা করতে। আজ আমাকে উঠতে হচ্ছে।
লাবণি বাইরে এসে ওর মারুতি গাড়িতে উঠতেই অলাতচক্র গোয়েন্দা গ্রুপের আরেক সদস্য সফটওয়্যার স্পেশালিস্ট তন্বীর ফোন এল। লাবণি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, কি তন্বী, কোনো সিসিটিভি ফুটেজ টুটেজ পেলে?
আপা, তোমাদের প্রফেসরের বাসার সামনে একটা তেহারির দোকান আছে, তোমার না আজ ও বাসায় যাওয়ার কথা?
হুম, এখনো আছি, সিসিটিভির কথা বলো।
ওই তেহারিওয়ালার দোকানে একটা ক্যামেরা আছে, যা হোক ওখান থেকে তেহারি নিয়ে আসবা।
উফ, আনব, কিছু পেলে নাকি তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে মগবাজার থানায় যেতে হবে।
স্টিল ওয়ার্কিং অন সিসিটিভি ফুটেজ। তবে আপাতত একটা লিড পেয়েছি।
কী লিড?
গত ক’দিন ধরে তোমাদের চান্দু প্রফেসরকে আরেকটা লোক গাড়িতে ফলো করছে বলেই মনে হলো। দুই বাসার বাইরেই ওই লোককে দেখেছি।
আইডেন্টিফাই করতে পেরেছ কে?
হুম, ওটার জন্য আরটিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স লাগে নি।
কেন?
কারণ ক’দিন আগে এনার ছবিতে পত্রপত্রিকা সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। অর্থ কেলেঙ্কারী না কী যেন।
কে উনি?
প্রোভাইস চ্যান্সেলর মাহতাব হাবিব, ওই যে রিসাইন করতে বাধ্য হলো যে লোকটা।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.