নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২২ ও ২৩)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২২ ও ২৩)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ২২ ও ২৩তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২ 
পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯ পর্ব ২০ পর্ব ২১

ফাহিম শিকাগো ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পর সিমি নতুন একটা ইমেইল লিখল তাকে। শিরোনামে লিখল, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’

প্রিয় ফাহিম,
তোমাকে সত্যিকার অর্থেই শেষ যখন একটি ইমেইল লিখেছিলাম, তখন তুমি ছিলে আমেরিকায়। তখনকার আমি আর এখন এই মুহূর্তে যেই আমি তোমাকে এই ইমেইলটি লিখছি সেই আমি একেবারেই ভিন্ন একজন মানুষ। বিষয়টি আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু আমি অনুভব করতে পারি ঠিক। তুমি কি পার্থক্যটা বুঝতে পারো?

ইতিমধ্যেই আমি তোমাকে মিস করা শুরু করেছি- এটা নিশ্চয়ই পাগলামি। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি- কী অদ্ভুত! তোমাকে দেখে, এত কাছাকাছি থেকেও তোমাকে দেখার সাধ মিটে নি আমার। কেমন হাস্যকর। কিন্তু এসবের জন্য নিজেকে দায়ী করতে পারছি না। এসবের জন্য তুমিই দায়ী। কী করেছ তুমি আমার? তুমি কি বুঝতে পারো, ফাহিম? অথচ আমি জানি, এমন ভাবনার কোনো অধিকারই আমার নেই। আমি কিছুতেই কারও সংসার ভাঙার কারণ হতে পারি না।

মাত্র তিন দিন হলো তুমি ফিরে গেছ, অথচ মনে হচ্ছে এক যুগ চলে গেছে। বুঝতে পারছি না তোমার সাথে এই জীবনে আমার আর দেখা হবে কিনা।

আমি জানি আমার এমন অনুভূতি হওয়াটা একেবারেই ঠিক নয়। অথচ আমি শুধু এটা অনুভবই করছি তাই নয়, তোমার সঙ্গে শেয়ারও করছি। উন্মাদ! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। এই মুহূর্তে আমি ঠিক তাই। উন্মাদ হয়ে আছি- শুধু তোমার জন্য। তুমিই আমাকে পাগল বানিয়েছ- এর দায়ভার তোমাকেই নিতে হবে। আমি কোনো অনুযোগ করতে চাইছি না। কিন্তু এটাই সত্যি। এ তুমি কী করেছ আমার? কাজটি তুমি মোটেও ভালো করো নি ফাহিম।

আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তুমি শিকাগো পৌঁছে যাওয়ার আগেই তোমাকে একটি চিঠি লিখব। কিন্তু আমি পারি নি। ইচ্ছে করছিল না। বিষণ্নতায় ভুগছিলাম। কারও জন্যই কিছু লেখার মতো অবস্থা আমার ছিল না। তাছাড়া তোমার কাছে তো যেন তেন রকমের কোনো লেখা আমি লিখতে পারি না, তাই না? তাই দেরি হলো। এই সময়টুকু আমাকে নিতেই হলো। যেন আমি আমার অনুভূতিগুলো আমার মতো করে লিখতে পারি। আশা করি, এই দেরিটুকুর জন্য তুমি কিছু মনে করবে না। 

ফাহিম, আমারও অনেক কষ্ট হচ্ছে- কিন্তু কী আর করার। আমরা তো চাইলেই আর বাস্তবতা বদলে দিতে পারব না, তাই না? আমার একান্ত নিজস্ব কষ্টের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে অনুশোচনা। এক ধরনের অপরাধবোধ ভেতরে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি কী করতে পারি ফাহিম, আমাকে বলে দাও। আমি তো চাইলেই ওই দিনটি আমার জীবন থেকে ফিরিয়ে নিতে পারব না। পারব না ভুলে যেতে মধুর স্মৃতিও।

ফাহিম, তুমি কি জানো, একই সঙ্গে আমার এমনও মনে হচ্ছে, তোমার মতো একজন অসাধারণ মানুষ থাকবে না, এমন কিছু আমি ভাবতেই পারছি না। তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না, তুমি আমার জীবনে নেই- এমন কিছু আমি চিন্তাও করতে পারি না। আমি ভাবতে পারি নি, হঠাৎ করেই নাটকীয়ভাবে আমার জীবনের এই পরিবর্তন হবে। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ ফাহিম। আর কেউ এমনভাবে আমাকে বদলে দিতে পারত বলে আমার মনে হয় না। আমার পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। শুধু বুঝতে পারছি না, মানুষটা তোমাকেই কেন হতে হলো। কেন অন্যকেউ নয়। কেউ একজন যে মুক্ত স্বাধীন। হাত-পা বাঁধা নয়। পিছুটান নেই। 

আমি জানি না, এই চিঠি পড়ে তোমার অনুভূতি কী হচ্ছে, শুধু একটা অনুরোধ করব, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আর একটা কথা- আল্লার দোহাই লাগে, এটা পড়ে তুমি তোমার অনুভূতি লুকিয়ে রাখবে না। যা ইচ্ছে লিখবে। আমি তোমার সব কথা শুনতে চাই।

আমি সত্যিই কৃতার্থ ফাহিম, এই জীবনে তোমার মতো একজন বন্ধু আছে আমার- যে কিনা অসম্ভব যতœশীল, আপসকামী একই সঙ্গে ত্যাগী। এভাবেই আমার পাশে থেকো ফাহিম। তোমার মতো একজন শুভাকাক্সক্ষী বন্ধুকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারব না।

ভালোবাসা নিরন্তর।
তোমারই বর্ষা

(এই নামটি আমার প্রিয়। আমি যদি কোনো দিন একটা উপন্যাস লিখি, তবে আমার সেই উপন্যাসে নায়িকার নাম হবে বর্ষা।)    

পুনশ্চ: পৃথিবীতে অনেকই আনন্দ আছে। তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় তেমনি এক আনন্দের বিষয়। কিছু আনন্দের গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। সেইসব গভীর আনন্দ শুধু অনুভবের। সুখ-স্মৃতির। সব আনন্দের কথা লিখে ব্যক্ত করা যায় না। সে ভাষাও আমার জানা নেই। সাহসও নেই। সাহস করাটা বিপজ্জনকও। দুর্লভ আতরের গন্ধের মতো সেইসব মুহূর্তের স্মৃতি বুকে বয়ে বেড়াতে হয়। আজীবন।

সিমি জানে শিকাগো ফিরে গিয়েই ফাহিম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অফিস এবং পারিবারিক কাজ নিয়ে।

ফাহিমের সাময়িক নীরবতাকে তার ব্যস্ততার কারণ হিসেবে ধরে নিয়ে সিমি অপেক্ষা করতে থাকল। ইতিমধ্যেই সে কয়েকটি ইমেইল পাঠিয়েছে। আজ হঠাৎ করেই একটা পুরোনো ছবি পেয়ে কিছু না ভেবেই পাঠিয়ে দিল ফাহিমকে। সাথে লিখে দিল কয়েকটা লাইন-

ফাহিম,
এই ছবিটি আমার ননদ আমাদের বিয়ের দ্বিতীয় দিনে তুলেছিল। ছবিটি এর আগে আমি কখনো দেখি নি। তার কারণ, আমার ননদ আমাদের বিয়ের তৃতীয় দিনেই চলে যায়। আমার এক ভাগ্নি, এই ছবিটি আমাকে দেখায়। মেয়েটি আমার আর রাশেদের ছবি কেটে একটা ভিউকার্ডের মধ্যে আঠা দিয়ে পেস্ট করে কার্ডটি আমার কাছে পাঠিয়েছে। আইডিয়াটা দারুণ না? বিবাহ বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা পাঠানোর এর চেয়ে ভালো বিষয় আর কী হতে পারে? আমি আসল ছবিটা আজই পেলাম। মনে হলো তোমার সাথে শেয়ার করি। আশা করি তোমার পছন্দ হবে। ছবিতে যেই সিমিকে দেখছ, তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর।   

ভালো থেকো।

ভালোবাসা।
বর্ষা

পর্ব ২৩

বেশ কিছুদিন পর, অবশেষে ফাহিম কিছুটা ফুরসুৎ পেল।

প্রথম সুযোগেই সে ল্যাপটপ খুলে বসে গেল। সিমির ইমেইলগুলোর অন্তত একটা উত্তর দেয়া দরকার। সে লিখল-

প্রিয়তমা বর্ষা,

তোমার পাঠানো কয়েকটি ইমেইল পেলাম পর পর। তারমধ্যে একটি অসাধারণ ইমেইল রয়েছে। অসংখ্য ধন্যবাদ, মেইলটি পাঠানোর জন্য- যার জন্য আমি অপেক্ষায় থেকেছি দীর্ঘদিন। এক বসাতেই কয়েকবার পড়ে ফেললাম এবং তখনই মনে হলো তোমাকে কিছু লিখি। আমি জানি, তুমিও আমার উত্তরের অপেক্ষাতেই থাকো- আছো। ঘুম থেকে উঠেই যেন তোমার ইনবক্সে এটি পৌঁছে যায়- তাই লিখতে বসে গেলাম এখনই।

একটি ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমিও একমত- আমাদের দেখা হওয়ার পর থেকেই আমরা দুজনেই অনেকটা বদলে গিয়েছি। তোমার মতো আমিও বুঝতে পারছি ঠিক। আমি জানি, তোমার জীবনে আমি যেভাবে জড়িয়ে গেছি, এটি ঠিক হওয়ার কথা নয়, কাম্যও নয়। আমার কোনো অধিকারও নেই। প্রাপ্যও নয়। এসবে আমার লোভও নেই, শুধু আমি তোমার সারাজীবনের বন্ধু হয়েই থাকতে চাই- একথা সত্যি।

তুমি আর আমি অবিশ্বাস্য এক সম্পর্কের ভ্রমণে একই নৌকায় ভেসে চলেছি। যা কিছু ঘটেছে, উচিত ছিল না, তবুও ঘটেছে। যা ঘটেছে তার জন্য কোনো অনুশোচনা করতে চাই না আবার মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। উভয়সংকট বোধহয় একেই বলে।

তোমাকে কিছু বিষয় পরিষ্কার করতে চাই- তোমাকে কারও সংসার ভাঙার কারণ হতে হবে না। যদি কোনোদিন কোনো কারণে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙেও যায়, আমি কখনোই তোমার কাছে গিয়ে বলব না, আমাকে বিয়ে করো। কারণ আমি জানি, আমি তোমার কাপ অফ টি নই। আমি তোমার পাশে বরং ছায়া হয়েই থাকতে চাই। তোমার দুর্বল সময়ে শক্তি জোগাতে চাই। স্বস্তি দিতে চাই। আমি এমন একজন হয়ে থাকতে চাই, যাকে বিশ্বাস করা যায়, যার সঙ্গে ভালোলাগার আনন্দ এবং মন্দলাগার কষ্ট ভাগ করে নেয়া যায়।

বর্ষা, তোমাকে দেখার পর থেকে, আমিও কেমন উন্মত্ত হয়ে থাকি তোমার জন্য। অথচ, আমি জানি আমার সীমাবদ্ধতার কথা। তোমারও। যতই কৃপণ থাকতে চাই, দূরে সরিয়ে রাখতে চাই নিজেকে, ততই ক্ষুধার্ত হয়ে যাই, একটু ভালোবাসার জন্য। কিছু বিশেষ মুহূর্তের জন্য। যার জন্য অপেক্ষা করে আছি আমি দীর্ঘ সময়। মাঝে মাঝে বড় বেশি লোভী হয়ে যাই। কী করব বলো, মানুষ তো! আমি তো কোনো রোবট নই। সন্ন্যাসীও নই।

তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। তোমার চিঠিটি আমার হৃদয় ছুঁয়েছে, অনুভবে। 

বর্ষা, আমার কারণে তোমার অনেক কষ্ট হলো। ঝামেলাও। এমনিতেই যথেষ্ট পেইন এন্ড সাফারিং-এর মধ্যে দিয়ে তোমাকে যেতে হয়, তার ওপরে যুক্ত হয়েছি আমি। আমার কারণেই তোমাকে এখন নতুন করে অনুশোচনায় ভুগতে হচ্ছে। আমি ঠিক জানি না এখন তোমাকে কী বলা উচিত। আমি বুঝতে পারি না এখন আমি কী করলে এই গিল্ট ফিলিংটা তোমার মাথা থেকে বের করে দেয়া যাবে। আমি সত্যিই জানি না।

তুমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলেছ, আমার অনুভূতির কথা জানাতে- কোনো রকম সেন্সর না করেই আমার অনুভূতি জানালাম। তুমি কীভাবে নেবে জানি না। তোমার ভালো লাগবে না জানি, কিছু বিষয় কোনো রকম আলোচনায় না আসাই ভালো। জীবনে অনেক কিছুই ঘটে যায়, কিন্তু সেই এমন কিছু আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। বেমালুম ভুলে যেতে চাই। কখনো ভুল করেও মনে করতে চাই না। কিন্তু চাইলেই কি সবকিছু ভুলে থাকা যায়? নিজের সঙ্গে হিপোক্রেসি করতে ইচ্ছে হলো না। আমায় ক্ষমা কোরো।

তোমাকে সেভাবে কখনো বলা হয় নি- অসাধারণ একটা মেয়ে তুমি, বর্ষা। তুমি সৎ, অমায়িক, ভদ্র, এবং অত্যন্ত দুর্লভ প্রজাতির একটা মেয়ে। আমি তোমার অনুভূতিকে অভিবাদন জানাই। শুধু এটুকুই বলব, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাকে কোনোভাবেই বিব্রত কিংবা আঘাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। ছিল না কোনোদিনও। তারপরেও, আমার ব্যবহারের যদি নেতিবাচক কিছু খুঁজে পাও- নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়ো।

তুমি আমাকে নিয়ে এত এত প্রশংসার বানি দিলে- আমাকে নিয়ে তোমার মূল্যায়ন, আমি কি সত্যিই তার যোগ্য? সে দাবি কি আমি করতে পারি? আবারও কৃতজ্ঞতা।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। পাতাবিহীন গাছপালাগুলো এলোমেলো হচ্ছে ভিজে হাওয়াতে। শিকাগো- দ্য উইন্ডি সিটি অফ আমেরিকা। শীতের সময়ে এই শহরে বিকেল চারটা বাজতেই দিনের আলো ফুরিয়ে যায়। আজকের মতো বিদায় নিতে চাই। বাসায় যেতে হবে। বাকিরা সবাই কখন চলে গেছে।

খুব শীঘ্রই কথা হবে। অফুরান ভালোবাসা।

তোমার ফাহিম।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.