না-ফেরার দেশে চলে গেলেন কবরী। সারাহ বেগম কবরী। যিনি সাধারণ দর্শকের কাছে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কারণ তাঁর হাসিটি ছিল ভীষণ মিষ্টি।
সম্প্রতি কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ৫ এপ্রিল তাঁর করোনার রিপোর্ট পজেটিভ আসে। তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে ঢাকার গ্যাস্ট্রো লিভার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আর গত ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার, গভীর রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবরীর প্রকৃত নাম মিনা পাল। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল। মা লাবণ্য প্রভা পাল।
চলচ্চিত্র জগতে কবরী প্রবেশ করেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার-অভিনেতা সুভাষ দত্তের হাত ধরে, ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, ১৯৬৪ সালে। বলাই বাহুল্য, তখন কবরী অভিনয়ের কিছুই জানতেন না। তাই সুভাষ দত্তকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এ সম্পর্কে অন্যদিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুভাষ দত্ত বলেছিলেন: ‘কররীকে নায়িকা করতে গিয়ে আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। ওর কথায় উচ্চারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান ছিল, আরও নানা ব্যাপার-স্যাপার ছিল। পাঁচ মাস সময় ব্যয় করতে হয়েছে ওকে তৈরি করতে। অবশ্য কবরীর একটি গুণ ছিল। ওকে যা বলা হতো ও তা চুপচাপ শুনত এবং চট করে তা শিখে নিত পারত। সে ভালো নাচও জানত। তার পরেও আমি মরহুম জি এ মান্নাকে অনুরোধ করি কবরীকে নাচ শেখানোর জন্য। তিনি আমার অনুরোধ রাখেন।’
‘সুতরাং’ মুক্তি পাওয়ার পরে দারুণভাবে ব্যবসাসফল হয়। এর পরে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
কবরী বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রকর্মসমূহ হলো: বাহানা, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, সাত ভাই চম্পা, আবির্ভাব, ময়নামতি, নীল আকাশের নীচে, কখগঘঙ, আঁকাবাঁকা, দর্পচূর্ণ, বিনিময়, রংবাজ. বলাকা মন, তিতাস একটি নদীর নাম, মাসুদ রানা, সুজন সখী, গোপন কথা, বধূ বিদায়, সারেং বউ, দেবদাস, দিন যায় কথা থাকে, ছোট মা, আরাধনা, লাল সবুজের পাল, আরশীনগর, দুই জীবন। এর মধ্যে ‘সারেং বউ’ চলচ্চিত্রে চমৎকার অভিনয়ের সূত্রে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আর ঢাকায় যখন মুম্বাইয়ের কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার আসেন, তিনি ‘দেবদাস’ দেখে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর দেখা সেরা পার্বতী হলো কবরী।
চলচ্চিত্রে কবরী রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুক, বুলবুল আহমেদসহ বহু নায়কের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তবে রাজ্জকের সঙ্গে তাঁর যে জুটি গড়ে উঠেছিল, সেটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে উত্তম-সুচিত্রার পরেই অবস্থান নিয়েছিল।...রাজ্জাক-কবরীর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার অনেক কারণই ছিল। যেমন শারীরিক দিক থেকে তাঁরা মানানসই ছিলেন। দুজনই দীর্ঘাকৃতির নন। দুজনেরই চেহারাতেই বাঙালি রমণী বা পুরুষের এমন ছায়া রয়েছে, যার সঙ্গে দর্শকরা সহজেই একাত্ম হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কবরী-রাজ্জাকের মধ্যে বেশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। একজন আরেকজনকে ভালো বুঝতে পারতেন। ফলে রোমান্টিক দৃশ্যে তাঁদের অভিনয় হতো দারুণ আবেদনময়। তা ছাড়া কবরীর সুন্দর চোখ, বিশেষত বিমুগ্ধ হাসি দর্শকদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল।
কবরী কয়েকটি টিভি নাটকেও অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতার আগে প্রথম তিনি এক পর্বের একটি নাটকে আভিনয় করেন। তবে তিনি প্রশংসিত হন আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ধারাবাহিকটি আর শেষ হয় নি। অবশ্য গত শতকের আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত ‘মাটির কোলে’ ধারাবাহিকে কেন্দ্রীয় চরিতে তাঁর অভিনয় দর্শক-সমালোচকসহ সবারই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ...রবীন্দ্র সাহিত্যের নাট্যরূপ ‘মালঞ্চ’তেও কবরীর অভিনয় দর্শক-নন্দিত হয়েছিল। এ ছাড়া নিজের পরিচালিত টিভি ধারাবাহিক ‘নীল কণ্ঠে কন্যা’য়ও তিনি অভিনয় করেছিলেন সুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক অভিনেত্রীর চরিত্রে।
কবরী একজন প্রযোজকও ছিলেন। তাঁর প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘শীতবসন্ত’। পরে তিনি আরও তিনটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন। চলচ্চিত্র তিনটি হলো: বলাকা মন, গুণ্ডা, সিদ্ধান্ত।
একজন চলচ্চিত্রকারও ছিলেন কবরী। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো, ‘একাত্তরের মিছিল’। স্বল্পদৈর্ঘ্যের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি ছিল শিশুতোষ।...কবরী পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র হলো, ‘আয়না’। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত আরেকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র পরিচালনা করছিলেন তিনি। ছবিটির কাজ অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল। ...টিভি নাটকও পরিচালনা করেছেন কবরী। রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘রাসমণির ছেলে’ তাঁর পরিচালিত প্রথম নাটক। এ ছাড়া তিনি ‘নীল কণ্ঠে কন্যা’ নামে একটি ধারাবাহিকও পরিচালনা করেছেন। এটি নাসরীন জাহানের ‘ক্রুশকাঠে কন্যা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ।
মুক্তিযুদ্ধেও কবরীর অবদান রয়েছে। তিনি তখন ভারতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’তে অভিনয় করেছেন।
সমাজের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, এ বিষয়েও কবরী সচেতন ছিলেন। তাই তো তিনি ইউনিসেফের হয়ে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ওপর কাজ করেছেন। বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে কাজ করেছেন নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য। এসিড সারভাইবাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কবরী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে শুরুতে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন নি। তবে ২০০৮ সালে তিনি সংসদ নিবার্চনে অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের পক্ষে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে। সাংসদ হয়ে নানা জনকল্যাণমূলক কাজও করেন।
কবরী সম্পর্কে অভিনেতা-পরিচালক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরীর মতো মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি আর কেউ যেতে পারেন নি।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সাংবাদিক মাহমুদা খাতুনের ভাষ্য হচ্ছে, সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশের সাধারণ মেয়ে হিসেবে কবরীকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ বা শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের চরিত্রটা ঠিক এরকমই ছিল। অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজস্বতা ও সহজাত প্রকৃতি কবরীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান দিয়েছে।
কবরী প্রথম ঘর বাঁধেন চলচ্চিত্র প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। সেই সংসারে তাঁর দুটি সন্তানও রয়েছে। পরে তিনি বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী শফিউদ্দিন সারওয়ারকে। তখন তিনি কবরী সারওয়ার নামে পরিচিতি পান। ২০০৮ সালে তাঁদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়।
কবরীর সঙ্গে অন্যদিন-এর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এই পাক্ষিকে বহুবার তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে; তাঁর অভিনীত-পরিচালিত ছবির খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৯ এবং ২০১৪ সালের ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মকথন। বেক্সিফেব্রিক্স-অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘আবেদন’ কবিতা অবলম্বনে তৈরি নৃত্যনাট্যে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি সেজেছিলেন রানী আর শিবলী ভৃত্য। শিবলীর ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’ এই আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন কবরী।
এখন কবরী শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানের ঘাসের নিচে। তাঁর এই নিদ্রা আর কখনোই ভাঙবে না। তবে তিনি অগণিত দর্শক-হৃদয়ে চিরকাল জেগে থাকবেন; বেঁচে থাকবেন।
তাঁর প্রতি অন্যদিন-এর অপরিসীম শ্রদ্ধা।
Leave a Reply
Your identity will not be published.