নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৪)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (পর্ব ১৪)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ১৪তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব 

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩

ভোর আটটা। জানুয়ারি মাস। এই সময় নিউইয়র্কে প্রচণ্ড শীত পড়ে। তাপমাত্রা থাকে শূন্যের কোঠায়। আমি জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের ট্যাক্সি হল্ডে দাঁড়িয়ে প্লেনের উঠানামা দেখছি আর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। অথচ এতটা শীত লাগার কথা নয়। আমার মাথায় উলের টুপি, হাতে গ্লাভস, গলায় মাফলার, গায়ে ভারী জ্যাকেট, পুরু কাপড়ের প্যান্ট তারপরও প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালা। শরীরের অভ্যন্তরীণ কলকব্জাকে উষ্ণ রাখার প্রয়োজন আছে। আমি চাইলেই গাড়ির ভেতর বসে সিগারেট টানতে পারি কিন্তু কেন জানি বসতে ইচ্ছে করছে না। দিনের বারো ঘণ্টা তো সেখানে বসেই কাটাই!  

ট্যাক্সি হল্ড হচ্ছে যেখানে খালি ট্যাক্সিগুলো যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করে। সেখানে ডিসপ্যাচারের অফিস, বাথরুম, ক্যান্টিন সবই আছে। এছাড়াও বিশাল দুটো ঘর আছে, যেখানে অনেক ট্যাক্সিড্রাইভার অবসর সময়ে তাস পেটায়, ক্যারামবোর্ড খেলে, খাওয়াদাওয়া সারে। আমার ট্যাক্সিটি যেখানে পার্ক করা, সেখান থেকে ক্যান্টিন আর বাথরুমের দূরত্ব খুব বেশি না। চাইলেই ক্যান্টিন থেকে এক কাপ কফি কিনে আনতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করছে না। কফি খেলেই ছোটো বাথরুম পাবে। শীতের দিনে কোনো এক বিচিত্র কারণে ঘনঘন বাথরুম পায়। এই ভয়ে কফি কিনলাম না। গাড়িতে প্যাসেঞ্জার ওঠানোর পর বাথরুম পেলে বিরাট সমস্যা।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লক্ষ করলাম আমি যে লাইনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছি সেই লাইনের ট্যাক্সিগুলো চলতে শুরু করছে অর্থাৎ আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। আজকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি। এমনও অনেক দিন গেছে আমাকে এই ট্যাক্সি হল্ডে দুই-তিন ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে।

গাড়িতে উঠে বসলাম। ট্যাক্সি হল্ডের গেটের মাথায় ছোটো ছোটো বুথ আছে। সেখানে ডিসপ্যাচাররা বসে থাকে। বুথ পেরোনোর সময় হাতে হলুদ রঙের একখানা কাগজ ধরিয়ে দেয়। সেই কাগজে টার্মিনালের নম্বর লিখা থাকে। আমাদের সেই টার্মিনাল থেকেই প্যাসেঞ্জার ওঠাতে হয়। আমার ভাগ্যে পড়ল টার্মিনাল ওয়ান। কেনেডি বিমানবন্দরে মোট নটি টার্মিনাল আছে। 

ট্যাক্সি নিয়ে টার্মিনালে পৌঁছাতে তিন-চার মিনিট সময় লাগল। এবার যাত্রীর জন্য অপেক্ষার পালা। টার্মিনালের মূল দরজা দিয়ে একে একে যাত্রীরা বের হচ্ছে। দেখে মনে হলো মানুষগুলো ক্লান্ত। লম্বা বিমান ভ্রমণের কারণে তাদের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট! লক্ষ করে দেখলাম বেশিরভাগই চ্যাপ্টা নাকের যাত্রী। উচ্চতা দেখে মনে হল জাপানিজ। জাপানিজরা সাধারণত লম্বা হয়, চাইনিজরা হয় খাটো, তাছাড়া ট্যাক্সি হল্ডে অপেক্ষা করার সময় জাপান এয়ারলাইন্সের প্লেনকে নামতে দেখছি। যদিও এই টার্মিনালে এয়ার চায়নার প্লেনও নামে। জাপানিজরা ভালো বকশিস দেয়, চাইনিজরা বকশিস দেয় না। আর দিলেও তা না দেওয়ার মতনই।

আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়ালাম। ট্যাক্সির পেছনের ট্রাঙ্কটা খুলে দিলাম। মনে মনে ভাবছি কেমন যাত্রী পাব? ম্যানহাটানের হওয়ার সম্ভাবনা নব্বই পারসেন্ট। ইশ, যদি একটা নিউ জার্সির বা লংআইল্যান্ড যাত্রী পাই কিংবা কানেটিকাটের। এক ট্রিপেই কেল্লা ফতে। ট্যাক্সি ব্যবসাটা আসলে অনেকটা লটারির মতন। কখন ভাগ্যে কেমন প্যাসেঞ্জার পড়বে কেউ জানে না। তবে দীর্ঘদিন চালালে অনেকসময় আঁচ করা যায়! এই টার্মিনাল থেকে একবার আমি প্রায় চার শ’ ডলারের ট্রিপ পেয়েছিলাম। এসব আকাশ-পাতাল ভাবছি, ঠিক তখনই ডিসপ্যাচার আমার গাড়িতে চার জাপানিজকে উঠিয়ে দিল। চারজনেরই পরনে স্যুট। সাথে ছোট চারটা স্যুটকেস।

মালপত্র গাড়ির ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে তারা গাড়িতে উঠে বসল। তিনজন বসল পেছনের সিটে আর একজন সামনে আমার পাশের সিটে। পেছনের সিটে বসা তিনজনেরই বয়স কম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। তবে সামনে যে লোকটি বসেছে সে বয়স্ক। দেখে মনে হলো সে-ই টিম লিডার!

আমি আমার পাশে বসা বয়স্ক লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে?

সে পকেট থেকে কাগজ বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল তবে মুখে কিছু বলল না। হয়তোবা ভালো ইংরেজি বলতে পারে না। কাগজে লেখা ৪০৫ ল্যাক্সিংটন এভিনিউ, নিউইয়র্ক ১০১৭৪, বুঝতে পারলাম ক্রাইসলার বিল্ডিংয়ে যাবে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ন’টা বাজে। লং আইল্যান্ড একপ্রেসওয়েতে প্রচুর ট্রাফিক। হভ (হাই অকুপেন্সি ভেহিকল লেন) লেনেও মনে হচ্ছে কোনো সমস্যা হয়েছে। গাড়ি এগুচ্ছে শম্ভুকের গতিতে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাঁদেরকে ক্রাইসলার বিল্ডিংয়ে নামিয়ে দিলাম। ওই আমলে কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে ম্যানহাটানের ভাড়া ছিল পঁয়ত্রিশ ডলার, টোল ছিল চার ডলার। বুড়ো জাপানিজ লোকটি ষাট ডলার দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.