সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তৌকীর আহমেদের সপ্তম কাহিনিচিত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে এই সময়ের তারুণ্যের চোখে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা, জানা ও অনুধাবনের প্রয়াস। তাদের সংকটের সঙ্গে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামকে মেলানো বা পার্থক্য চিহ্নিত করা। আর এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, পার্থ, তার ভাবনা এবং মানসভ্রমণের মাধ্যমে ঘটেছে। যেমন—
অ.
পার্থ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। সে ঘটনাচক্রে একটি ব্যান্ডদলে যোগ দেয় ভোকাল হিসেবে। প্রথম পারফরমেন্সেই বাজিমাত করে। তার দল বিজয় দিবসের কনসার্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। এ জন্য একটি গান রচনায় প্রয়াসী হয় পার্থ। প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের নানা বই পড়তে থাকে।
দৃশ্যান্তর...
১৯৭১-এর ৭ই মার্চ। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আ.
পার্থর প্রেমিকা দিবার বাবা কবি ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কথোপকথনে মগ্ন হয় পার্থ।
দৃশ্যান্তর...
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিভিন্ন স্থিরচিত্র।
ই.
১৯৭১। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেডিসিন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ Bangladesh Bangladesh গানটি গাইছে জর্জ হ্যারিসন এবং অন্যরা।
দৃশ্যান্তর...
এই সময়ে ঢাকার একটি কনসার্টে Bangladesh Bangladesh গাইছে পার্থ এবং অন্যরা।
ঈ.
গভীর রাত। ঢাকা। গাড়িতে পার্থ এবং তার বন্ধু। নিষিদ্ধ পানীয় বহন করছে তারা। পথে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ জেরা করে।
দৃশ্যান্তর...
১৯৭১। দিন। অন্যদের সঙ্গে একটি বাসের যাত্রী দুই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। গাড়ি থামিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের জিজ্ঞাসাবাদ।
উ.
ঢাকার সচিবালয়। পার্থ এবং তার বাবা হিসাবরক্ষকের সামনে বসে আছে। পার্থর বাবা এখানে এসেছেন তাঁর পেনশনের টাকার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। হিসাবরক্ষকের কণ্ঠে সেই পুরোনো বুলি; উৎকোচের চাহিদা। পার্থ খেপে যায়। হিসাবরক্ষকের গায়ে হাত তোলে, অন্যরা তাকে থামায়।
দৃশ্যান্তর...
পার্থ তার ঘরে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে।
দৃশ্যান্তর...
সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু। জনসাধারণের কল্যাণে কাজ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।
ঊ.
পুলিশি রিমান্ডে পার্থ। তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে, সে ‘আইরিনকে রেপ করেছে’ এই মর্মে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য।
পার্থ বলে, ‘আমি নির্দোষ’।
দৃশ্যান্তর...
১৯৭১। পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার সেলে বন্দি এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। সে সিদ্ধিরগঞ্জের অপারেশনে গিয়েছিল কিনা তা জানার জন্য নির্যাতন। তরুণ মুক্তিযোদ্ধার অস্বীকৃতি।
সময়ান্তর বোঝানোর জন্য এখানে ইমেজের রঙে ভিন্নতা আনা হয়েছে। অবশ্য মূল অভিনয়শিল্পীর পরিবর্তন হয় নি। উল্লেখ্য, ‘স্ফুলিঙ্গ’-এর আঙ্গিকে ভারতের রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ‘রং দে বাসন্তী’-র ছায়া আছে। তবে রাকেশের মতো তৌকীর আহমেদ পুরোপুরি সার্থক নন।
২.
গানের যদি সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে এটি চলচ্চিত্রের কাহিনিকে থমকে দেয়। চলচ্চিত্র তার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়।
‘স্ফুলিঙ্গ’-এ বেশ কয়েকটি গান ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘দিন থাকিতে দ্বীনের সাধন’ (লালন), ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ (শাহ আবদুল করিম), ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’ (হাছন রাজা), ‘তীর হারা এক ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’ (আপেল মাহমুদ)। Bangladesh Bangladesh গানটি দুবার দুভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয়বার নারীকণ্ঠে। এইসব গান অযৌক্তিক মনে হয় নি। যেহেতু একটি ব্যান্ড দলকে ঘিরে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে, সেহেতু বহু গান থাকতেই পারে।
এই চলচ্চিত্রে নতুন গান রয়েছে তিনটি ‘এই কুয়াশা তোমার নামে’, ‘হাজার বছরে একবারই আসে এক মুজিব’, ‘জানি না কখন’। তিনটি গানই শ্রুতি মধুর। হৃদয়স্পর্শী। তবে প্রথম দুটি গান গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তৃতীয় গানটি চলচ্চিত্রটিকে থমকে দিয়েছে। এটির চিত্রায়নও কিছুটা মূলধারার চলচ্চিত্রের মতো।
৩.
চলচ্চিত্রটিতে গতি আছে। এর জন্য সম্পাদক অমিত দেবনাথের প্রশংসা প্রাপ্য। এই সময় এবং একাত্তর- এই দুই সময়ের ফারাকটি ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য কৌশিক রায়ও ধন্যবাদ পেতে পারেন।
অভিনয়ে পুরোনোদের প্রায় সবাই চরিত্রানুগ পারফরম করেছেন। কেউ কেউ উতরে গেছেন। কারও কারও বডি লেঙ্গুয়েজ এবং ডায়লগ ডেলিভারিতে প্রবলেম ছিল। তবে নতুনরা ভালো করেছেন। বিশেষত শ্যামল মাওলা। চলচ্চিত্রে এই প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন তিনি এবং সেই সুযোগটি ভালোভাবেই কাজ লাগিয়েছেন।
সম্পর্কে অশনি সংকেতের আভাস পেয়ে পার্থ ও দিবা এক বিকেলে অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে। কাট টু- শ্রমিকেরা লোহা ঝালাইয়ের কাজ করছে। চারদিকে আগুনের কণা ছিটকে পড়ছে। এ পার্থর যন্ত্রণাকাতর হৃদয়কে মূর্ত করে। এইসব মন্টাজ সহজ এবং নান্দনিক।
৪.
সংলাপ সুন্দর। বিভিন্ন চরিত্রকে পর্দায় যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তবে কোর্টের দৃশ্যের সংলাপে দুর্বলতা রয়েছে।
দুর্বলতা রয়েছে কাহিনি বিন্যাস এবং চিত্রনাট্যেও। তাই শুরুতে দর্শকদের মনে হবে, বড়পর্দায় তারা জীবন এবং একটি জাতির গল্প দেখছেন। কিন্তু শেষে তাদের এই ভাবনায় পরিবর্তন আসবে। তারা বোধ করবেন, ‘স্ফুলিঙ্গ’ আসলে সত্যিকারের চলচ্চিত্র ও ফর্মুলাভিত্তিক চলচ্চিত্রের মিশেল।
‘স্ফুলিঙ্গ’-এর পোস্টারে দেখা যায়, একদিকে একদল মুক্তিযোদ্ধা, হাতে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। অন্যদিকে এক ব্যান্ড দল, তাদের হাতে গিটার। মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। দেশকে স্বাধীন করেছে; দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছে। আর এ সময়ের সংস্কৃতিপ্রেমী তরুণদের অস্ত্র গান। এর মাধ্যমেই তারা দেশপ্রেমকে প্রকাশ করে। এ বিষয়টির প্রতিই যদি চলচ্চিত্রকারের ফোকাস ঠিক থাকত, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু তা হয় নি।
চলচ্চিত্রটি পার্থর ব্যক্তিগত সমস্যাকে ঘিরেই ঘুরপাক খেয়েছে। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত সমস্যার সঙ্গে অবশ্য জাতীয় সমস্যাও বিজড়িত। তবে তা চলচ্চিত্রকার-চিত্রনাট্যকার ছুঁতে পেরেছেন সামান্যই (যেমন- সরকারি কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের প্রবণতা, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র)। তাহলে একাত্তরের সঙ্গে এই সময়কে মেলানোর প্রয়াস কেন? এতে কি সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে না? ফলে এই চলচ্চিত্রটি দর্শকদের আলোড়িত করতে পারে না; পারে না তাদের চেতনাকে প্রজ্বলিত করতে।
আমরা সার্থক ‘স্ফুলিঙ্গ’ দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
Leave a Reply
Your identity will not be published.