‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’— এ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিশ্বাসী একজন মানুষের মনের কথা। আর এইসব মানুষই কী ঈদ, কী দুর্গোৎসব, কী বড়দিন বা বুদ্ধপূর্ণিমা; সব উৎসবেই অংশগ্রহণ করে।
'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...
ঈদুল ফিতরের কথাই ধরা যাক। ঈদে মসজিদ কিংবা ঈদগাহে নামাজ আদায় করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। তারপর তাদের সারাদিনের কর্মসূচিতে কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশ নেয়। খাওয়া-দাওয়া করে, আড্ডা দেয়। ছোটরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। বড়রা যখন স্বধর্মের স্নেহভাজন কাউকে সালামি দেন, তখন সেই অর্থ থেকে অন্য ধর্মের স্নেহভাজনদেরও বঞ্চিত করেন না। এভাবে ঈদ উৎসব সর্বজনীন ঈদ উৎসবে পরিণত হয়। আবার এটাও সত্যি যে, ভিন্ন ধর্মের কোনো বিষয়ের প্রতিও কেউ কেউ আকৃষ্ট হয়। যেমন ভারতের বলিউডের জনৈক অভিনেত্রী রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত উপোস থাকেন। কারণ রোজা রাখার শারীরিক উপকারিতা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। আবার টালিউডের এ সময়ের জনপ্রিয় এক মুসলিম নায়িকা সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল। তারাই ভারতের অসাম্প্রদায়িক মানুষের প্রতিনিধি।
অসাম্প্রদায়িক মানুষ বাংলাদেশের শহর কিংবা গ্রাম, সর্বত্রই আছে। আবার একজন অশিক্ষিত মানুষও কিন্তু অসাম্প্রদায়িক হতে পারে। আমাদের গ্রাম-বাংলায় এমন অসংখ্য সহজ-সরল মানুষ ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে শিক্ষিত ছদ্মবেশী অসাম্প্রদায়িকের সংখ্যাও কম নয়। তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে; সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের দিকে ধাবিত করে। এ ক্ষেত্রে বই ও পত্র-পত্রিকার ভূমিকা কম নয়।
ঈদসংখ্যার কথাই ধরা যাক। অবিভক্ত ভারতে দৈনিক আজাদ বিশেষ ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেছিল। সেই সংখ্যায় উপন্যাস-গল্পও ছিল। পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘ঝিনুক’, ‘বেগম’সহ আরও কয়েকটি পত্রিকাও ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ‘বিচিত্রা’, ‘রোববার’, ‘চিত্রালী’, ‘পূর্বাণী’ নিয়মিত ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেছে। এইসবই ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরে পাক্ষিক ও দৈনিক পত্রিকাও ঈদসংখ্যা প্রকাশে এগিয়ে আসে।
এইসব ঈদসংখ্যা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ায় ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে। কীভাবে? ঈদসংখ্যায় নানা ধরনের লেখা থাকে। যেমন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এই ধরনের লেখায় মুক্তচিন্তার প্রকাশ থাকে। লেখকদের থাকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। তত্ত্ব-তথ্য, যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে কুসংস্কারের জালকে তাঁরা ছিন্ন করেন; এক সুন্দর ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান। প্রয়াত আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, আনিসুজ্জামান এবং হুমায়ুন আজাদের ভূমিকা এমনই ছিল। আহমদ রফিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন প্রাবন্ধিক-নিবন্ধকারের ভূমিকাও তেমনই ছিল, এখনো আছে।
ঈদসংখ্যায় থাকে কবিতাও। আর কবিরা তো চিরকালই অসাম্প্রদায়িক। আলাওল-আবদুল হাকিম থেকে শুরু করে আজকের তারিক সুজাত-পিয়াস মজিদরা সেই পথেরই পথিক।
ঈদসংখ্যার সিংহভাগজুড়ে থাকে গল্প-উপন্যাস। আর আমাদের সচেতন কথাসাহিত্যিকরা সবসময়ই উপাখ্যানের মাধ্যমে নানা চরিত্রের সমাবেশে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’— এটাই তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, হুমায়ূন আহমেদসহ বহু জনের কথাই বলা যায়।
এভাবেই বাংলাদেশের ঈদসংখ্যাগুলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং রেখে চলেছে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.