[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।]
শম্পা আমার বউয়ের পুরোই ব্রেইনওয়াশ করে ফেলেছে।
আমরা আরও দুদিন কক্সবাজার ছিলাম। শম্পা রোকসানাকে নিয়ে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়ালো আর কী কী ছবক দিল কে জানে! ঢাকায় ফেরার পর থেকে রোকসানা আমাদের গেস্টরুম নিয়ে উঠে পড়ে লাগল। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, রোকসানা একটু একটু করে গেস্টরুমটা সাজাচ্ছে। একদিন লোকজন এসে পুরোনো ওয়ারড্রবটা নিয়ে গেল। রোকসানা হাতিল থেকে কাঠের কাজ করা দামি একটা ওয়ারড্রব আনাল। আরেকদিন ও আমাকে নিয়ে নীলক্ষেতে গিয়ে তোষক আর বালিশের অর্ডার দিল। গেস্টরুমটা পশ্চিমে বলে জুন-জুলাইয়ে ভীষণ গরম হয়ে যায়। রোকসানা মিতসুবিশি কোম্পানির তিন টন এসি কিনে দেয়ালে বসাল।
শম্পাও কম খেল দেখাচ্ছে না। আমার অফিস টাইমে সে নাকি প্রায়ই বাড়িতে এসে রোকসানার সঙ্গে গল্প করে যায়। একদিন বিকেলে রোকসানা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল, দ্যাখো শম্পা আমার জন্য কী করেছে।
কী করল আবার?
রোকসানা আমার দিকে একটা শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল, নিজের হাতে পুরো শাড়িতে লখনৌ স্টিচ করে আমাকে উপহার দিয়েছে। দ্যাখো, কী সুন্দর! এই মেয়েটা মানুষ না, যেন একটা ফুলপরি।
শাড়িটা দেখে মেজাজ খিচড়ে গেল। লখনৌ স্টিচের এই শাড়িটা কদিন আগে শম্পা আমাকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়েছে। আরও অনেকগুলো কাপড় আর গহনা সে আমাকে দিয়ে কিনিয়েছে। কিন্তু সে কথা তো আমি রোকসানাকে বলতে পারি না। বেশ বুঝতে পারছি শম্পার মতো ঘোড়েল মেয়েকে কোনোভাবেই আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। এক সন্ধের ভুলের জন্য সে আমার সংসার এভাবে ধ্বংস করতে পারে না। আমি রোকসানাকে বললাম, বুঝলাম শম্পা একটা ফুলপরি। কিন্তু ওর মতো অনাত্মীয়া ইয়াং মেয়ে ঘরে থাকলে অন্যরা কী বলবে?
আহা, রক্তের সম্পর্ক থাকলেই কি আত্মীয়তা হয়? তা ছাড়া শম্পা তো মিলির সঙ্গেই পড়ছে। একসঙ্গে ভার্সিটি যাবে আসবে। গরিব মেয়েটার কত লাভ হবে। আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না।
কিন্তু লোকে কী বলবে?
উঁহ, আবার সেই এক কথা! শোন, তুমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ হলে আমিও চিন্তায় পড়তাম। তুমি যে মেয়েদের দিকে অন্য নজরে তাকাও না সেটা সবাই জানে।
বিয়ের পরপর আমি আর রোকসানা মগবাজারে একটা এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলাম। ওটা এখনো আছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে রোকসানাকে বললাম, এক কাজ করা যায় রুকুমণি।
কী কাজ?
আমাদের মগবাজারের ফ্ল্যাটটা তো আগামী মাসে খালি হচ্ছে।
তাই? তুমি বলো নি কেন আগে? শম্পা তো তাহলে ওখানেই থাকতে পারে।
হুম, সেটাই, আমি মাত্র কাল নোটিশ পেলাম।
আসলে আমি কোনো নোটিশ পাই নি। যে ভদ্রলোক ওখানে থাকেন উনি খুব অনিয়মিতভাবে ভাড়া দেন। তাকে ওখান থেকে বের করা কোনো সমস্যা হবে না।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি শম্পা আমাদের মগবাজারের ফ্ল্যাটে উঠে গেল। তারপর আমাকে ফোন করে বলল, চান্দু প্রফেসর, চালটা কেমন দিলাম?
কোন চাল?
তোমার বোকা মেয়ে মিলি আগেই বলেছিল তোমাদের মগবাজারে ফ্ল্যাট আছে। এই ফ্ল্যাটের জন্যই তোমাদের বাড়িতে থাকার চাল দিয়েছিলাম চান্দু। তোমার বোকা বউটার হাত দিয়েই তোমাদের ফ্ল্যাট হাতিয়ে নিলাম, হি হি হি।
আমি অবাক হলাম না। আসলে ধুনধুনা শম্পার কোনো কথাতেই এখন আর আমি অবাক হই না, শি ইজ আনপ্রেডিকেটেবল। শম্পার কাছে পদে পদে এত যে ধরা খাচ্ছি, তবু ক্লাসে এসে তন্বী মেয়েদের সঙ্গে রংঢং করার অভ্যাসটা আমার গেল না। একেই বোধহয় খাইসলত বলে। আজ বিকেলে লেকচার ছিল, শুরুতেই টগবগে সুন্দরী একটা ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললাম, ইউ আর বিউটিফুল।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, স্যার আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ। হ্যাঁ তোমাকেই বলছি, ইউ আর বিউটিফুল।
অন্য মেয়েরা তখন মুখ টিপে হাসছে। ওই মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, জি স্যার অনেকেই এ কথা বলে। কিন্তু আপনি এভাবে বলবেন...
‘ইউ আর বিউটিফুল’ কবিতাটা কার লেখা সেটা জানতে চাইছিলাম।
মনে হলো একটা বেলুন ফুলে ফেঁপে আবার ফুটো হয়ে চুপসে গেল। মেয়েটা এবার গম্ভীর মুখে বলল, না স্যার, ওই কবিতা কার লেখা আমি জানি না।
আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন ব্রিটেনের রাজকবি কে তোমরা জানো?
কী আশ্চর্য, ওরা কেউ জানে না। বললাম, তোমাদের জানা উচিত ছিল। সায়মন আরমিটেজ দু’ হাজার উনিশ সাল থেকে ইংল্যান্ডের রাজকবি। ওনার আগে ছিলেন ক্যারল অ্যান ডাফি। সায়মন আরমিটেজের একটা কবিতা হলো ইউ আর বিউটিফুল, শোন কবিতাটি,
You’re beautiful because
for you,
politeness is instinctive,
not a marketing campaign...
You are beautiful because
you do not see love
as a competition and
you know how to loose
‘তুমি সুন্দর কারণ
কমনীয়তা তোমার সহজাত গুণ,
কোনো লোক-দেখানো ভণিতা নয়...
তুমি সুন্দর কারণ
প্রেম তোমার কাছে
প্রিয়কে নিয়ে টানাহিঁচড়ে নয়
বরং
তুমি জানো কীভাবে হারাতে হয়।’
একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার একটা কথা বলি?
হ্যাঁ, বলো।
এটা তো লুজারদের কবিতা স্যার।
ওর কথা শুনে অনেকেই হেসে দিল। আমি কিছু একটা বলতে যাব ঠিক সেই সময় দেখলাম আমার জুনিয়র কলিগ ডক্টর সুদীপ্ত রায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাত ইশারা করে আমাকে ডাকছে। আমি সুদীপ্তকে অপেক্ষা করতে বললাম। লেকচার সংক্ষিপ্ত করে মিনিট বিশেক পর সুদীপ্তের কাছে এসে বললাম, কী হয়েছে সুদীপ্ত? অত হাত নাড়াচ্ছিলে কেন?
জাহিদ ভাই, সিরিয়াস সমস্যা হয়ে গেছে।
কী সমস্যা?
একটু আগে কারা যেন আপনার একটা আপত্তিকর ভিডিও ছেড়ে দিয়েছে।
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। বললাম, কোথায় ছেড়ে দিয়েছে?
ভার্সিটি আর ডিপার্টমেন্টের ফেসবুক গ্রুপে, ইন্সটাগ্রামে আর টুইটারে। তাছাড়া এক মিনিটের একটা শর্ট ভার্সন ছেড়েছে টিকটকে, ব্যাকগ্রাইন্ড মিউজিক দিয়ে।
কী বলছ এসব?
জি, এই নিয়ে তুলকালাম বেঁধে গেছে। ভিসি সাহেব আপনাকে খুঁজছে। সিনেট ইলেকশনের আগে এ রকম ভিডিও নাকি ইউনিভার্সিটির মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।
এই মুহূর্তে আয়নায় তাকালে দেখতাম আমার মুখ সাদা পাংশুটে হয়ে গেছে। শম্পা মেয়েটা কীভাবে এত নিমকহারাম হতে পারল? আমি তো ওর সব দাবিই পূরণ করেছি। তারপরও সে আমাকে এভাবে অপদস্থ করল? মানুষ এত খারাপ হয় কীভাবে? আমার গলা দিয়ে দলা পাকিয়ে কান্না চলে এল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে বললাম, ভিডিওতে আমার চেহারা দেখা যাচ্ছে?
আপনার চেহারা একদম ক্লিয়ার জাহিদ ভাই। কিন্তু মেয়েটার চেহারা চালাকি করে ঝাপসা করা।
শুধু মেয়েটা ঝাপসা করা?
জি। তবে জাহিদ ভাই, আমি এই ভিডিও বিশ্বাস করি না। আজকাল সবকিছু এডিট করা যায়। আমার ছেলেই তো ক্লাস প্রজেক্টের জন্য আভেঞ্জারের ভিডিও ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে এডিট করল। আর আমি তো জানি এসব খারাপ অভ্যেস কেল্টু ভাইয়ের থাকতে পারে, আপনার নাই।
সুদীপ্ত চলে যেতেই আমি শম্পার মোবাইলে ফোন দিলাম। শম্পা ইচ্ছে করে মোবাইল সুইচ অফ করে রেখেছে। এখন অবশ্য ওকে ধরেই-বা কী লাভ, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। একটু আগে আমার ছাত্রী যে লুজারের কথা বলেছে সেটা তো এখন আমি। শম্পা আমাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে, লুজার বানিয়ে শেষ করে দিল।
কীভাবে এখন আমি রোকসানার সামনে মুখ দেখাব? আর আমার মেয়ে মিলিকেই-বা কী বলব? কালকে স্টুডেন্টদের সামনে বসে ইংরেজি কবিতা পড়ব কীভাবে?
আর কি কখনো তন্বী মেয়েদের সঙ্গে আমার ফ্লার্ট করা হবে? এই স্খলনের ভিডিও চাউর হওয়ার পর আমার কি আদৌ চাকুরি থাকবে?
সুদীপ্তের ভাষ্যমতে, আধঘণ্টার ভেতরেই আমার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাবে। কুলেস্ট প্রফেসর থেকে আমি কদর্যতম প্রফেসরে পরিণত হব। পত্রপত্রিকা আর টিভির সাংবাদিকেরা আমাকে আর আমার ফ্যামিলিকে মৌমাছির মতো ঘিরে ধরবে, বিষাক্ত প্রশ্নের হুল ফোটাবে।
আই ক্যান্ট লেট ইট হ্যাপেন।
আমি তাড়াতাড়ি বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়ে এলাম। পার্কিংয়ে গিয়ে আমার লাল মারুতি গাড়িটা স্টার্ট দিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা লাগল মেঘনা ব্রিজে পৌঁছুতে। এর মাঝে বেশ কয়েকবার রোকসানার ফোন এল, আমি ফোন ধরলাম না।
একটু পর যা ঘটতে যাচ্ছে তার জন্য আমার অবচেতন মন বোধহয় অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ কারণে একটা ইলেক্ট্রিক পিলার ধরে যখন মেঘনা ব্রিজের রেলিংয়ের ওপর উঠে দাঁড়ালাম, আমি কোনো পিছুটান অনুভব করলাম না।
(চলবে...)
Leave a Reply
Your identity will not be published.