কৌতুকের নায়কেরা

কৌতুকের নায়কেরা

কৌতুক হচ্ছে সেই হাস্যরস—যা জীবনেরই অন্তর্গত। বাংলা চলচ্চিত্রে কমেডি তথা কৌতুক রয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এই মাধ্যমের কৌতুকাভিনয়ের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে দর্শকদের আনন্দ দেওয়া।

এবার কৌতুকাভিনেতাদের প্রসঙ্গ। শুরুতেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রশিল্পের স্মরণীয় কৌতুকাভিনেতাদের কথা উল্লেখ করা হলো।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি কৌতুকাভিনেতা। অবশ্য কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি নায়কও ছিলেন। পার্শ্ব চরিত্রেও কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: নতুন ইহুদি, সাড়ে চুয়াত্তর, পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট, বধূ, দাদাঠাকুর, ৮০'-তে আসিও না ইত্যাদি। অন্য আরেক বিখ্যাত অভিনেতা জহর রায়ের সঙ্গে তাঁর জুটি গড়ে উঠেছিল।

তিনি ভাঁড়ামি করতেন না। তাঁর অভিনয় ছিল সংযত ও পরিমিত। আরেকটি কথা, সংলাপ উচ্চারণ ও প্রক্ষেপণে তিনি ব্যবহার করতেন ঢাকাইয়া ভাষা ও ভঙ্গি। এ প্রসঙ্গে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির একটি বিখ্যাত সংলাপ উল্লেখ করা যেতে পারে: "মাসিমা মালপো খামু।" এটিই ছিল তাঁর নিজস্ব স্টাইল ও স্বাতন্ত্র্য।

জহর রায়

আরেক কিংবদন্তি কৌতুকাভিনেতা। তিনি চলচ্চিত্রে সিরিয়াস কমেডি যুক্ত করেছেন, যা ছিল সেই সময়ের পরিচালকদের খু¡ই পছন্দ। প্রথম চলচ্চিত্র অর্দ্ধেন্দু মুখার্জী পরিচালিত 'পূর্বরাগ'। জীবনে তিন শটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, মর্জিনা আবদুল্লা, সাড়ে চুয়াত্তর, নিশিপদ্ম, ছদ্মবেশী, উপহার, উল্কা, পরশ পাথর, বাড়ি থেকে পালিয়ে, অঞ্জনগড়, ধন্যি মেয়ে, পলাতক ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবিতে হাল্লা রাজার কুটিল যুদ্ধপ্রিয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অভিনয় সমালোচকদেরও প্রশংসা অর্জন করে।

জহর রায়ের অভিনয়ে শুধু হাস্যরসই ছিল না, চরিত্রের মধ্যে গভীরতা ও ট্রাজেডি মিশে থাকত, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। চার্লি চ্যাপলিনের ভক্ত এই মানুষটি চ্যাপলিনের মতোই শারীরিক ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দর্শকদের হাসাতে পারতেন।

চিন্ময় রায়

বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা। অভিষেক চলচ্চিত্র তপন সিংহ পরিচালিত ‘গল্প হলেও সত্যি’। দেড়শ ছবিতে কাজ করেছেন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র: নৃপেন (আপনজন), জং বাহাদুর (সাগিনা মাহাতো), অমল (এখনই), উকিল (ধন্যি মেয়ে), ননীগোপাল (ননীগোপালের বিয়ে), সিধু (বসন্ত বিলাপ), সোনার দোকানের মালিক (ঠগিনী)। উল্লেখ্য, ভানু ও জহরের মতো জনপ্রিয় না হলেও রবি ঘোষের সঙ্গে চিন্ময় রায়ের একটি জুটি গড়ে উঠেছিল। আরেকটি বিষয়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত চরিত্র 'টেনিদা'-র ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সেকালের দর্শকদের খু¡ই আমোদ জুগিয়েছিল।

চিন্ময় রায়ের অভিনয় ছিল খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। সহজ-সরল মুখভঙ্গি ও বিশেষ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তিনি দর্শকদের আনন্দ দিতে পারতেন, যা অন্যদের থেকে ছিল আলাদা।

রবি ঘোষ

প্রকৃত নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। হতে চেয়েছিলেন বডি বিল্ডার, সিক্স প্যাক দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করার জন্য। কিন্ত নিয়তির ইচ্ছায় হয়ে গেলেন অভিনেতা। কৌতুক অভিনয়ে তিনি অদ্বিতীয়। বলা যায়, তাঁর মুখ দেখলেই হাসি পায়।

রবি ঘোষের অভিষেক চলচ্চিত্র 'কিছুক্ষণ' (১৯৫৯)।  অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের এই ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্ত সেই অভিনয় ছিল এমন দুর্দান্ত যে সবাই বুঝে গিয়েছিলেন, রবি ঘোষ এক অদ্ভুত প্রতিভা।

১৯৬২ সালটি ছিল রবি ঘোষের জন্য এক টার্নিং পয়েন্ট। সেই বছর তিনি তিনজন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের ছবিতে অভিনয় করেন। ছবি তিনটি হলো, সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’, তপন সিংহের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, অসিত সেনের ‘আগুন’। এর পর রবি ঘোষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।

চলচ্চিত্র জীবনে রবি ঘোষ দুশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চরিত্র হলো: রামা (অভিযান), বাবু (একটুকু বাসা), ধনঞ্জয় (গল্প হলেও সত্যি), গোবিন্দ (দোল গোবিন্দের কড়চা), বঙ্কু (বাঘিনী), তোতলা ভট্টাচার্য (ধন্যি মেয়ে), গুপ্ত (বসন্ত বিলাপ), বঙ্কু (ঠগিনী), নটবর মিত্র (জনঅরণ্য)। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘বাঘা’ চরিত্রটি। সত্যজিৎ রায়ের 'গুপী গাইন বাঘা বাইন', 'হীরক রাজার দেশে' এবং সন্দীপ রায়ের 'গুপী বাঘা ফিরে এলো'-তে রবি ঘোষ অমর হয়ে থাকবেন। আরেকটি কথা, চিন্ময় রায়ের সঙ্গে কৌতুকাভিনেতা হিসেবে তাঁর একটি জুটি গড়ে উঠেছিল।

আর কৌতুকাভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন কোন গুণে ? এ প্রসঙ্গে একটি বাক্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে: মুখের অভিব্যক্তি, শরীরী ভাষা আর নিখুঁত কমেডি টাইমিং-এর গুণেই রবি ঘোষ অনন্য কৌতুকাভিনেতা।

অনুপ কুমার

প্রকৃত নাম সত্যেন দাস। বহুমাত্রিক অভিনেতা। ১৯৩৮ থেকে ১৯৯৭, ঊনষাট বছরের চলচ্চিত্র জীবন, নানা বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁকে নায়ক, প্রতিনায়ক, খলনায়ক, কৌতুকাভিনেতা, পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা, নানা ভূমিকায় দেখেছে দর্শক। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: কেশব (বাঁশের কেল্লা), গবা (নীল শাড়ি), রাজেন (টনসিল), শেখর (কাঁচামিঠে), কেষ্ট (অর্ঘ্য), বসন্ত (পলাতক), অমর (জীবন কাহিনী), সোহনলাল ( আলোর পিপাসা), অভিরাম (ফুলেশ্বরী), শঙ্করের বন্ধু (রাগ অনুরাগ), ভোম্বল (দাদার কীর্তি)...।

এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। এদেশের কৌতুকাভিনেতারা কখনোই এমন পর্যায়ে যেতে পারেন নি, যাকে আমরা অত্যন্ত উঁচু মানের বলতে পারি। তারপরেও কয়েকজন গুণী কৌতুকাভিনেতার কথা উল্লেখ করা যায়।

সুভাষ দত্ত

তিনি প্রথম অভিনয় করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ (১৯৫৯) ছবিতে।  ছোটখাট আকৃতির এই অভিনেতাটির বিশেষত্ব ছিল—তীর্যকভাবে সংলাপ প্রক্ষেপণ, শুদ্ধ উচ্চারণ। সুভাষ দত্ত অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে: রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, সূর্যস্নান, চান্দা, নতুন সুর, তালাক, দুই দিগন্ত, মিলন, পয়সে, কাজল, সাগর, নদী ও নারী, কার বউ, ভাইয়া ইত্যাদি।

খান জয়নুল

খান জয়নুলের কৌতুকাভিনয়ে সূক্ষ্ম কৌতুক বলতে যা বোঝায় তা-ই ফুটে উঠত। শরীরের জোরে কিংবা নতুন কুর্দন করে তিনি দর্শক হাসাবার অপচেষ্টা করতেন না। চালাক চতুর চরিত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। কাজী জহির পরিচালিত ‘ময়নামতি’ ছবির সেই সিকোয়েন্সটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য—যেখানে ‘মাছি’ নামের আড়ালে এক গ্রাম্য মিষ্টির দোকানির সহজ-সরল ছেলেকে বোকা বানান। তিন মাধ্যমের জনপ্রিয় এই কৌতুকাভিনেতার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : কাঁচ কাটা হীরে, সন্তান, দর্পচূর্ণ, ময়নামতি, যে আগুনে পুড়ি, স্মৃতি তুমি বেদনা ইত্যাদি।

রবিউল

তাঁর অভিনীত ছবি, ‘আকাশ আর মাটি’ (১৯৫৯)। তাঁর শারীরিক অবয়বই তাদের হাস্যরসের খোরাক জোগাত। এমন হ্যাংলা পাতলা ছিলেন যে সমস্ত হাড় গোনা যেত, বাংলা সাতের মতো মুখ, দাঁতের সংখ্যা সামান্য। তাঁর একটি বিশেষ বিশেষত্ব ছিল—কানের নড়াচড়া। স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল এই কৌতুকাভিনেতার উল্লেখযোগ্য ছবি: নাচঘর, জোয়ার এলো, রাজা সন্ন্যাসী, কাঞ্চনমালা, সাত ভাই চম্পা, মুক্তি, অঙ্গীকার, পরিচয়, ডাকপিয়ন, রাতের পর দিন, কে তুমি, অনেক দিন আগে ইত্যাদি।

আশীষ কুমার লোহ

তিন মাধ্যমের এই কৌতুকাভিনেতা প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ‘হারানো দিন’ (১৯৬১) ছবিতে! চালাক চতুর মানুষের চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল অসামান্য। কৌতুকাভিনয়ে তিনি অঙ্গভঙ্গির চেয়ে সংলাপ প্রক্ষেপণ আর অভিব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : ভাওয়াল সন্ন্যাসী, নদী ও নারী, অচেনা অতিথি, রূপালি সৈকত, কার বউ, আপন দুলাল, নয়ন তারা, জন্ম থেকে জ্বলছি, পাগলা রাজা, মধুমালতী, শান্তি,  পরিণীতা।

টেলি সামাদ

টিভি থেকে চলচ্চিত্রে এসেছিলেন বলে তাঁর নামের আগে ‘টেলি’ যুক্ত। হ্যাংলা পাতলা গড়ন, কোঁকড়া চুলের অধিকারী এই অভিনেতা  কৌতুকাভিনয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল গড়ে তোলেন। সেই স্টাইলটি হচ্ছে দ্রুত সংলাপ বলা আর ইংরেজি ভাষা যুক্ত একটি মিশ্র ভাষা। নির্মাতা কাজী হায়াৎ টেলি সামাদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেন নির্মাণ করে ‘দিলদার আলী’ ছবিটি। এখানে নায়ক চরিত্রে টেলি সামাদ নিজেই অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: অবাক পৃথিবী, সোহাগ, নয়নের মণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, ফকির মজনু শাহ, পাগলা রাজা, মধুমিতা, দিন যায় কথা থাকে, নদের চাঁদ, কথা দিলাম, শেষ উত্তর, এতিম, মনা পাগলা, ভাত দে, সখিনার যুদ্ধ ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.