পোস্টমর্টেম।। শৈলজানন্দ রায়

পোস্টমর্টেম।। শৈলজানন্দ রায়

তখনো চিকনখালি গ্রামের মানুষেরা সারাদিনের কাজ শেষ করে মাঠ থেকে ঘরে ফেরে নি, শুধু সূর্যটা ডিমের কুসুমের মতো আকার নিয়ে রক্তিম আভায় পশ্চিম দিকটা লাল করে ফেলেছে অথবা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি তখনো শোনা যায় নি কিংবা ধরা যাক এই গ্রামের খাবারের সন্ধানে বের হওয়া পাখিকুল তখনো খাদ্য সংগ্রহ করে ঘরে ফেরে নি, ঠিক এমন একটা সঙ্গম সময় একখান ডিঙি নৌকায় করে কয়েকজন মানুষ মরিয়মের লাশ বাক্সবন্দি করে মকবুল হোসেনের ঘাটে এসে ভিড়ল।

সাথে সাথে তারা বাক্সটাকে ধরাধরি করে মকবুল হোসেনের উঠোনে নিয়ে রাখে। তখন দেখা যাবে এই ছোট্ট কৃষক বাড়িটা মানুষে মানুষে ভেঙে পড়বে এমন একটা হাহাকার নিয়ে যেন এই পরিবারকে সহানুভূতি জানানোর জন্য অথবা নিজের চোখে মেয়েটাকে শেষবার দেখে আসি এমন অভিপ্রায় নিয়ে। তখন এপাড়া-ওপাড়া দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যাবে—এমন দুঃসংবাদে শুধু পাড়ার কোন্দল মনে রেখে রাগের বশবর্তী হয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। মরিয়মের সাথে কোনো এক জাতি-বৈপরীত্য সম্পর্কের জেরে এই গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সম্পর্কের চিড় ধরেছিল তা আজ যেন মরিয়ম তার জীবন দিয়ে মিল ঘটিয়ে দিয়ে গেল।

পাশের বাড়ির চাচিরা বলাবলি করতে থাকবে এই তো সেদিন শুনলাম— মরিয়ম পোয়াতি। মনটা আনন্দে ভরে গেছিল। এরমধ্যে এমন কী হলো যে মেয়েটাকে লাশ হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসতি হলো? আহা-রে তোর এবাড়িতে সাদ খাইতে আসার কথা, আর আসলি কীভাবে লাশের বাক্সে! এই আসাটা তো সহ্য করার মতো নয়। একটু পরেই আমরা দেখতে পাব মরিয়মের শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা লোকজন লাশ দাফনের জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। এদিকে মকবুল মিয়া মাঠ থেকে এখনো ঘরে ফিরে নাই। তাকে খবর পাঠানো হয়েছে। আমরা দেখতে পাব কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বাড়িখানা লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে এবং সবাই মরিয়মের জন্য আফসোস করতে থাকবে। সবাই কৌতূহল বোধ করবে— কীভাবে মারা গেল এই অল্পবয়স্ক মিষ্টি মেয়েটা! যারা মরিয়মের শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে তারা একটা তরল বয়ান দিয়েছে। বয়ানটা এমন—মরিয়মের কঠিন পেটের অসুখ হয়েছিল। সেই অসুখে মরিয়ম মারা গেছে। বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হয় নি।

কিন্তু কী এক অজানা কারণে উপস্থিত প্রতিবেশীরা কেউ তা বিশ্বাস করতে পারে না। কী কারণে তারা অবিশ্বাস করতে পারছে না সেই কারণটা অনুসন্ধান করা হয় নি আর সেই অবকাশও ছিল না। একটা মৃত্যু-বাড়িতে এসব নিয়ে প্রশ্ন করে মানুষকে বিব্রত করাটা মুশকিল।

আমরা দেখতে পাব গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারসাহেব সবাই লাশের বাক্সের পাশে চেয়ার পেতে বসে আছে। তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে নানা প্রকার গল্প করতে থাকবে যা বাড়ির লোকদের কাছে চরম অপ্রীতিকর এবং অবাঞ্ছিত মনে হবে তথাপি বাড়ির মানুষ টুঁ শব্দটি করবে না। কারণ উনারা গ্রামের গণ্যমান্য মানুষ, চটে গেলে সমস্যা আছে। গরিবের সমস্যার অন্ত নেই! মাটির বারান্দার একপাশে মরিয়মের মায়ের শোকের মাতম হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং সেখানে পাশের বাড়ির রহিমুদ্দিনের বউ দুর্বল সান্ত¡নার বাক্য দিয়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করবে, যাতে সে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে মকবুলকে বাড়ি ঢুকতে দেখব যখন চিকনখালি গ্রামের প্রান্তীয় মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসবে, পাখিদের কলকাকলি শোনা যাবে। একমুহূর্তের জন্য মনে হবে এসবই মৃত মরিয়মের আত্মার শান্তির জন্য ঘটছে। সেটা প্রকৃতই ঘটুক বা না-ঘটুক এখানকার মানুষের মনে যে এরকম একটা অনুভূতি হতে থাকবে এটাই বড় কথা। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠবে, এই লাশের পোস্টমর্টেম করা উচিত। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা বা সত্যি সত্যি সে কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছে সেটা যাচাই করা উচিত। কে এই দাবি তুলল তা অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করা যায় না অথবা গেলেও তা নিয়ে কারও মন্তব্যের অবকাশ না দিয়ে তার সাথে সুর মিলিয়ে মেম্বারসাহেব চিৎকার করে বলে উঠবেন— হ’ ঠিকই কইছো। এই লাশের পোস্টমর্টেম করা দরকার। সত্যিটা জানা দরকার যে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি হত্যা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রস্তাবকারীর নাম নয় বরং মেম্বার সাহেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সবাই মেনে নিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করবে। একইসাথে দেখা যাবে মরিয়মের শ্বশুরবাড়ি থেকে আগত ব্যক্তিবর্গরা কানাঘুষা শুরু করবে এবং কিছুটা হলেও তারা কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এই সময় অন্য একজন বলে উঠবে— ওই বাড়ির লোকদের আমাদের কোনো বিশ্বাস নেই। ধনী লোকদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা টাকার গরমে চলে। টাকাই তাদের কাছে শেষকথা। টাকার সাথে ক্ষমতার যোগসূত্র নিবিড়। তারা কখনো গরিবের কষ্ট বোঝে না। এই বক্তব্যের পর কয়েকজনকে আমরা কানাঘুষা করতে শুনব— এত বড়লোকের ঘরে মকবুলের মেয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক হয় নি। সম্বন্ধ করতে হয় সমানে সমানে। তা না হলে আত্মীয় হিসাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা মুশকিল।

এই মুহূর্তে আমরা একটু পিছন ফিরে দেখতে চাই। একটা ধনী পরিবারের মাদকসেবক ডানপিটে বেহিসাবি ছেলের সাথে মরিয়মের বিয়ে হয়েছিল ঘটা করেই। তাদের ছেলের এই দুর্বলতার জন্যই মকবুলের মতো দরিদ্র পরিবার থেকে মেয়ে বাছাই করেছিল। আর মরিয়মকে দেখে কার পছন্দ না হয়! ইতিহাস সাক্ষী—গরিবের ধন সহজে কেড়ে নিতে পারে ধনীরা। অদৃষ্ট বলি আর পরিণতি বলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতি ধনীদের ধন সঠিক বা মহৎ কাজে ব্যয় হয় না। হয়তো বা ধনের ধর্মই এমন বিধর্মী। মরিয়মের শ্বশুরের অবস্থাও এই অধিকাংশের দলের মধ্যে। অবশ্য ধনের ব্যবহার নিয়ে কার্ল মার্কস যুগান্তকারী তত্ত্ব দিয়েছেন! তবে ধনতন্ত্রবাদিরাই জয়ী। তাদের দাপটে জয়জয়কার! আমরা আর একটি রাত্রিকে বিশেষভাবে দেখতে চাই যেখানে মরিয়মের কুমারী জীবনের লালন করা সব স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়েছিল। মরিয়ম স্বপ্ন দেখেছিল— একজন বলিষ্ঠ পুরুষ তার স্বামী হবে। সে ধনী হতে পারে, মধ্যবিত্তও হতে পারে এমনকি দরিদ্রও হতে পারে। কিন্তু তার ভালোবাসা থাকবে কানায় কানায়। ফুলশয্যার রাতে সে এসে তার ঘোমটা উন্মোচন করবে, ফুলেল শয্যায় তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে। এরকম একটা স্বপ্ন তার মাথায় কীভাবে গেঁথে গিয়েছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে এমনও হতে পারে কোনো সিনেমার দৃশ্য অথবা কোনো বান্ধবীর গল্প তার মাথায় এমন স্বপ্ন গেঁথে দিতে পারে, কিংবা বয়সের ধর্মে সে নিজেও এমন স্বপ্নের প্রণেতা হতে পারে। আবার সব সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে অমল নামক একটি ছেলের চিঠিও তার স্বপ্নকে উস্কে দিতে ভূমিকা রাখলেও রাখতে পারে। তবে উৎপত্তি যেখানেই হোক বাস্তবে মরিয়মের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল যে রাতে সেই রাতে সে চরম মুষড়ে পড়েছিল আর সেই মুহূর্তে তার শাশুড়ির একটা আন্তরিক পরামর্শ তাকে থিতু করেছিল। আর তা হলো—বউ, তাড়াতাড়ি একটা কোলজুড়ানো বাচ্চা নিস যাতে এবাড়ির কেউ তোকে অমর্যাদা না করতে পারে। তখন দেখবি তোকে সুনজরে রাখবে। আমি কোনো মতে চাই না আমি যা সহ্য করেছি তা তুই বিন্দুমাত্র সহ্য করিস। এই পরিবারের মানুষ মেয়েদের মানুষ মনে করে না। মরিয়ম এই প্রৌঢ়ার স্বামী-সন্তান সম্পর্কে জীবনপোড়ানো অভিজ্ঞতা শুনে অভিভূত হয় এবং কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে— আম্মা আমাকে দোয়া করেন যেন আমি এই বাড়ির যোগ্য ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী দিতে পারি। চরম হতাশার বাসররাত কাটানোর পর মরিয়মের এই দৃঢ়তা ও প্রত্যয় প্রশংসার দাবি রাখে, কারণ এতদিনের লালন করা তার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়াই শুধু নয় বরং এক হতাশার ভবিষ্যৎ সে লক্ষ করেছিল। আমরা আবার সেই রাতে ফিরে যেতে চাই যেখানে একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানার খাটের ওপর মরিয়মকে সেজেগুজে অপেক্ষায় শেষরাত পর্যন্ত বসে থাকতে দেখব, তার হাতভর্তি মেহেদির আলপনা আর গা ভর্তি সোনার মূল্যবান গহনা। তখন সে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বার উপক্রম হলেও জোর করে সোজা হয়ে বসে। মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে। কারণ পাছে সে নিজেই নিজের স্বপ্ন ভঙ্গ করে ফেলে। অবশেষে প্রায় শেষরাতে শ্যামলা শীর্ণাকায় স্বামী পাশের বাজার থেকে নেশা করে ঘরে ঢুকলে মরিয়ম পরম মমতায় তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তখন তার নেতিয়ে পড়া শরীরের কোনো কিছু জাহির করার পর্যায়ে ছিল না এবং মুখ দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত লালা ঝরছিল। মরিয়ম তাকে পরিষ্কার করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এরপর আমরা দেখব মরিয়ম কান্নাকাটি করেই বাকি রাতটা পার করে দিবে। অবশ্য মরিয়মের সেই কান্নার নিচু আওয়াজ কারও কান পর্যন্ত না পৌঁছালেও অনুমান করা যাবে যে শ্বাশুড়ি আম্মা আঁচ করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি অভিজ্ঞ। তিনি জানেন এ বাড়ির পুরুষের আচরণগত নিকৃষ্ট ধারাপাত।

আমরা এখন মরিয়মকে এক মুহূর্ত অমলের কথা ভাবতে দেখব, মন তো ঘটনাকে অনুসরণ করে তার আর কিবা দোষ দেই! অমলের চিঠির উত্তরে সে যে লজ্জিত হাসি দিয়েছিল সেটা কি অমল বুঝেছিল? সে কি আবিষ্কার করতে পেরেছিল তার জগতজোড়া সম্মতির মানে? যে বোঝে বুঝুক, না বুঝলে মরিয়মের কী আসে যায়! সে এত কিছু ভেঙেচুরে বলতে পারবে না। আমরা এই মুহূর্তে মরিয়মের বাসররাত থেকে আরও একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই—যেখানে অমল নামের একটি ছেলের সাথে মরিয়মের একটি সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল যেটা জাতিগত বাধায় ঠাসা ছিল। আমরা দেখতে পাব একটা ঝকঝকে বিকালে কলেজের মাঠে ফুটবল খেলা চলছে। মরিয়ম তার বান্ধবীদের সাথে স্কুল থেকে শেষ ঘণ্টা ছুটি নিয়ে খেলা দেখতে গিয়েছে। খেলা শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগে প্রতিপক্ষের বুটের আঘাতে একটি খেলোয়াড়ের নাকের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তীর্যকভাবে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাকে ধরাধরি করে যখন বাইরে নিয়ে আসছে তখন সে নিজেই বাম হাত দিয়ে ক্ষত স্থান চেপে আছে কিন্তু কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। বদলি খেলোয়াড় দিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন রেফারি। মাঠের বাইরে আসার পর সে তার খেলোয়াড়ি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নাক চেপে মাটিতে শুয়ে পড়লে মরিয়মের বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠে— আহা! মরিয়ম ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আহত খেলোয়াড়ের কাছে গিয়ে নিজেই রুমাল চেপে ধরে। মাথায় পানি দিয়ে দেয়। মরিয়ম দেখে, রুমালটা ভিজে গিয়ে রক্ত শোষণের ক্ষমতা হারিয়েছে। সে মাথার সুতি কাপড়ের স্কার্ফ দিয়ে তার নাক বেঁধে দেয়। রক্ত প্রবাহ থিতু হলে মরিয়ম স্কার্ফ আর রুমালটা নিয়ে বলে, রুমালটা আমি বাড়ি থেকে ধুয়ে আপনাকে দিয়ে দিব। এরপর ওই রুমালটা আর ফেরত দেওয়া হয় নি তার সিংহভাগ দায় দায়িত্ব অমলের। সে-ই চেয়েছিল রুমালটা মরিয়মের কাছে থাকুক—কী জানি কী সম্পদের মালিক করে দিল মরিয়মকে। কিংবা এটাও কি একধরনের রক্তের ঋণ? আরও কিছুদিন পর আমরা দেখতে পাব মরিয়ম স্কুল থেকে একা ফেরার সময় অমল তার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দেবে। মরিয়মের হাত, পা বুক থরথর করে কেঁপে উঠবে। একটা কাগজের ছোট চিঠির এত ক্ষমতা হয়! ছোট সেই চিঠিখানা মরিয়ম বাড়িতে এনে কয়েকবার পড়েছে। এত সুন্দর লেখা! হয়তো এই বর্ণমালা আগেও পড়েছে, তবে সেই একই বর্ণমালায় আহ্লাদিত লেখাগুলো আলাদা রকমের মায়াময়। আবেগে, ভয়ে মরিয়ম আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ার অবস্থা। হয়তো তখনো তার মাথায় স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ সেট হয়ে যেতে পারে। আবার হতেও তো পারে অমল কখনো তার মাথার মধ্যে একটা স্বপ্নের বিচি পুঁতে দিয়েছে। সেটা যাই হোক আমরা কয়েকদিন পর অমলকে পথে অপেক্ষা করতে দেখব যে পথে মরিয়ম নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল থেকে ঘরে ফিরে আসে। পুরুষেরা প্রেমে পড়লে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, নারী কোনোকালেই সেই দহন বুঝে উঠতে পারে না, যেমন সন্তান জন্মদানের প্রসব বেদনা পুরুষ শত চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারে না। সংসারে দশ টাকা আয়ের মধ্য দিয়ে চালানোর উদ্দেশ্য থাকলেও পরিবারকে আর একটু ভালো রাখার প্রত্যয়ে কীভাবে পনেরো টাকা খরচ হয় তা নারী বুঝে উঠতে পারে না, যেমন পুরুষ বুঝে উঠতে পারে না সারা দিন নারী ঘরে লাগাতার কাজের মধ্যে থাকার পরেও জিনিসপত্র অগোছালো থাকে কীভাবে? হয়তো এই বোঝা না-বোঝার কোনো এক দর্শনের ফাঁদে পড়ে গেছে অমল আর মরিয়ম। দু’চোখ ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে অমল তার দিকে তাকালে মরিয়ম শুধু একটা নরম সর্বনাশা মুচকি হাসি দিয়েছিল যার মধ্যে যে-কোনো পুরুষ ডুবে মরতেই পারে। যে-কোনো পুরুষ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে পারে অথবা যে-কোনো পুরুষ খোলা মাঠেও জীবন গড়া নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে। এরপর আমরা আরও কিছুদিন পর অমলকে দেখা করতে দেখব সেটা ওই দেখার মধ্যেই আটকে থাকে মুখ ফুটে কথা অবধি পৌঁছায় না। অথবা আমরা কীভাবে এতটা নিশ্চিত হচ্ছি যে নৈঃশব্দ্য-ভাষা ব্যবহার করে তারা অজস্র কথা বলে নি! বলতেও তো পারে। কথা বলার জন্য সর্বদা মুখই যথেষ্ট নয় বরং চোখ, কান, নাক, মন, স্পর্শ এগুলো দিয়েও তুমুল কথা বলা যায়! সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের এত যে কথা তা তো আমরা মন দিয়েই বলি। অসুস্থ রোগীর কপালে হাতের স্পর্শ দিয়ে কি আমরা অনেক কথা বলি না? সে রকম অমলও দূর থেকে চোখ বা মন ব্যবহার করে কী সব বলেছে তা তো বলা মুশকিল! ভালোবাসার ভাষাগুলো কেমন যেন একটা! অনেকক্ষেত্রেই বর্ণাশ্রয়ী নয়! এভাবে তাদের দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল নৈঃশব্দ্য আর বাক্যহীন। একবার অমল সাহস করে মরিয়মকে তাদের বাড়ির একটা পেয়ারা এনে দিয়েছিল, যেটা শুধু একটা ফলই নয় বরং ফলের অভ্যন্তরে লুকানো বিশাল মিষ্টি এক সুস্বাদু ভালোবাসা। আরও কিছুদিন পর আমরা দেখতে পাব অমল সমস্ত সহনশীলতাকে অতিক্রম করে পুড়ে ছাই হওয়ার পর একটা চিঠি মরিয়েমের হাতে ধরিয়ে দেয়। এই চিঠির একটা বিষয় এখানে ফাঁস করে দিতে চাই। একজন নারীর প্রতি পুরুষের যে পরিণত এবং সম্মানজনক প্রস্তাব সেটা এই চিঠির মধ্যে বর্ণিত ছিল। আমরা আর একটু এই বিপদজনক ভালোবাসাকে বা সম্পর্ককে ব্যবচ্ছেদ করতে চাই। পাত্র-পাত্রীর নাম শুনে বোঝা যাচ্ছে এটি দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা যা কোনো গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। তাদের এই দুঃসাহসিক আকাঙ্খার বাস্তবায়ন সামান্যতম সম্ভাবনা ছিল না। আগুনের প্রতাপ খুব বেশিদিন ছাইচাপা দিয়ে লুকানো যায় না— জ্বলে সে উঠবেই! যখন বিষয়টা ছোট এই চিকনখালি গ্রামের প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল তখন গ্রামটা প্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। লম্বা একটা রাস্তার দু’পাশে বসতি এবং বসতির দু’পাশে আবাদি জমি। এই ভৌগোলিক কারণে এই গ্রামের নাম চিকনখালি কিনা বা তার আলাদা কোনো মাজেজা আছে কিনা তা কোনো পুরুষান্তর শ্রুতি বা পুস্তকে লিপিবদ্ধতা কোনোটাই পাওয়া যায় না। সেই চিকনখালি গ্রামের বসতির মাঝ বরাবর রাস্তাটা একটা সুইচগেট দিয়ে বিভক্ত যা এই এলাকার ফসল ফলানোর ব্যাপারে বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। একই সাথে এই গেটটি দিনশেষে হিন্দু-মুসলমান সবার বিশ্রাম ও আড্ডার স্থানও বটে। গ্রামের উন্নতির জন্য অনেক বড় পরিকল্পনার সূত্রপাত সম্মিলিভাবে এখান থেকেই। এই গ্রামের মানুষ একে অপরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠানে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একে অপরকে সহযোগিতা করে। কিন্তু সেই সম্পর্ক পরম্পরা আজ মলিনতার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে। আমরা দেখতে পাব অমল ও মরিয়মের এই সম্পর্ক সেই সেতুবন্ধ সুইচগেটের দু’পাশের মানুষের মধ্যে চরম এক অসম্পর্ক তৈরি করেছে। পাড়ার লোক এই সুইচগেটে, মাঠে, ঘাটে, রাস্তায় এমন এক সম্পর্ক বিন্যাস করছে যে শেষপর্যন্ত তারা এটাকে চরম এক কূ-সম্পর্কে এনে দাঁড়া করাচ্ছে। সেই সূত্রে ছি-ছিটা এমন এক উপসংহারে রাখছে যে—শেষপর্যন্ত মরিয়ম এমন কাজ করল! কেন আর কোনো যোগ্য ছেলে কি মুসলমান পাড়ায় নেই? আবার হিন্দুপাড়া থেকে কেউ বলল, অমল এটা কী করল এখন আমরা মকবুল ভাইকে মুখ দেখাব কেমন করে? অথচ জীবন এক আজব কারিগর যে মানুষকে দিয়ে অনেককিছু করিয়ে নেয়। মানুষ তা নৃত্যরত পুতুলের মতো সম্পন্ন করে যেখানে সুতো ধরা থাকে অন্য কারও হাতে! আমরা লক্ষ করব এমন এক যাচ্ছেতাই অসামাজিক পরিবেশে মরিয়মের সাথে পাশের তারও পাশের গাঁয়ের নাম করা ধনীর ছেলে বিল্লালের সাথে বিয়ে স্থির হয়েছে। ছেলে এইচএসসি ফেল। ছেলের লেখাপড়া দিয়ে এত কী হবে যে টাকা-পয়সা আছে মরিয়মের সাত পুরুষ বসে খেতে পারবে। আর মরিয়ম তো রাজরানি হয়ে থাকবে। আর তাছাড়া... পর্যন্ত বলে থেমে গেলে কারও আর বুঝতে বাকি থাকে না এরপরে কী ছিল। মাতব্বররা মরিয়মের বাবা মকবুলকে এই ছেলে হাতছাড়া না করার পরামর্শ দিলে ঘটা করেই বিয়েটা হয়ে গেল— যে ঘটার জন্য ছেলেপক্ষের বিরাট ভূমিকা ছিল।

আমরা তারপর অমলের আর কোনো ভূমিকা দেখতে পাব না। যা কিছু দেখতে পাব তা মরিয়মের। আমরা মরিয়মকে ওই পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখব। দেখব তার ভালোবাসা জলাঞ্জলি, তার শিক্ষা জলাঞ্জলি, তার সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি, তার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যকে অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে সুখী করার প্রাণান্ত চেষ্টা। আমরা কোনো প্রকারে জানতে পারব না অমলের সেই রক্তভেজা রুমাল যেটা মরিয়ম ধুয়ে সাফ করেছিল সেটা কোথায় আছে বা আদৌ তার কাছে আছে কি না। কিংবা অমলের জন্য লুকিয়ে রাখা যে ভালোবাসা তা-কি মুছে গেছে— তাও অনুক্ত থাকবে। এরকম একটা ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দেখতে পাব মকবুল হোসেনের ছোট্ট বাড়িখানা আনন্দে থৈ-থৈ করছে— ঝুম ঝুম করে নাচছে। কারণ তাদের মেয়ে মরিয়ম মা হতে যাচ্ছে। এটা মকবুলের পরিবারে শুধুই একটা খবর নয় বরং এই খবরের মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও অনেকগুলো টুকরো খবর। যেমন তাদের স্বামী-স্ত্রীতে মিল মহব্বত হয়েছে, যেমন হয়তো সে অমলকে ভুলতে পেরেছে, যেমন সে শ্বশুরবাড়িতে সুখী আছে, মরিয়ম সব দুর্যোগ কাটিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে ইত্যাদি। সেইসব ধারণার জন্মদেওয়া মরিয়ম অজস্ত্র নতুন ধারণার জন্ম দিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এসেছে যেখানে সব পূর্ব ধারণা ধুলোয় মিশিয়ে গেছে। এরকম একটা জটিল অবস্থায় উপস্থিত প্রায় সকল প্রতিবেশীরা চিৎকার করে বলছে— মরিয়মের লাশের পোস্টমর্টেম দরকার। পুলিশে খবর দেওয়া হোক। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে মরিয়মের শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন পুরুষমানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রায় সন্ধ্যার প্রাক্কালে লাশ নিয়ে হাজির হয়েছে এবং যেনতেন প্রকারে এই দরিদ্র কৃষক পরিবারের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পদদলিত করে রাতের মধ্যে কবর দেওয়ার চরম নির্দেশনা নিয়ে এসেছে। লাশটা তাদের বাড়িতেই কবর দিতে চেয়েছিল কিন্তু মরিয়মের শাশুড়ির জন্য সেটা সম্ভব হয় নি। মরিয়মের শাশুড়ির ঐকান্তিক ইচ্ছা মেয়েটা অন্তত মৃত্যুর পর তার বাবা-মায়ের কাছে শান্তিতে ঘুমাক। মরিয়মের শ্বশুর এটা নিয়ে স্ত্রীর সাথে বিবাদে গিয়ে জল ঘোলা করতে চায় নি। এরকম অন্ধকার শোরগোল এবং ধোঁয়াশার মধ্যে আমরা শুনতে পাব সেই তরুণকণ্ঠ আবারও চিৎকার করে উঠবে—মরিয়মের লাশের পোস্টমর্টেম করা হোক। পুলিশে খবর দেওয়া হোক। মানুষ সত্যিটা জানুক যে মরিয়মের কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। আর মেম্বারসাহেব তাতে সমর্থন দিলেন। আমরা অপেশাদার গোয়েন্দাদের মতো সন্দেহ করব—সেই তরুণ কণ্ঠটা কার হতে পারে। সে যেই হোক-না কেন তার দাবি ন্যায়সঙ্গত। অন্তত এই প্রায় অন্ধকার সভার অধিকাংশ মানুষই তার কথায় সম্মতি দিয়ে কণ্ঠ মেলালো— ঠিকই কইছো। মেয়ের লাশ কবর দেওয়ার জন্য মকবুল হোসেনের আর কি-বা আলাদা মতামত থাকতে পারে, যেখানে বাড়িভর্তি মানুষ সবাই ওই তরুণের পক্ষে সম্মতি দিচ্ছে। আমরা দেখতে পাব অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট্ট কৃষক বাড়িটি একটা ছোটখাট আন্দোলন ক্ষেত্রে পরিণত হবে। আর ওই তরুণ কণ্ঠ যে দাবি তুলছে তা যৌক্তিকভাবে ধ্বনি সমর্থনে জয়যুক্ত হচ্ছে। আর তখন আমরা দেখতে পাব মেম্বার সাহেব থানায় যোগাযোগ করছেন।

আরও কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দেখতে পাব মরিয়মের লাশটি পোস্টমর্টেমের জন্য গঞ্জের হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশি হেফাজতে এবং সেই সময় একটা স্বস্তিদায়ক শোরগোল শুনতে পাব। আমরা অন্ধকারেও দেখতে পাব দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে এমন এক দৃঢ় প্রতিবাদ যেন এই ধনীদের দরিদ্র কৃষকদের ওপর যাচ্ছেতাই অত্যাচার করার আর সুযোগ দেওয়া যায় না। তা না হলে ভবিষ্যতে এমন অনেক মরিয়মকে আমাদের মূল্য দিতে হবে। সেটা হতে পারে না।

আমরা আরও কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পাব বাড়িটা চরম শূন্যতায় আর কন্যা হারানোর হাহাকারে নতুন এক নৈঃশব্দ্যময় হাওয়ায় ভরে উঠেছে, যেখানে বাড়ির মানুষ, গাছপালা, পোষাপ্রাণী সবাই শোকে কাতর এবং বিষন্ন।  

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.