সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (সপ্তম পর্ব)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (সপ্তম পর্ব)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।] 

হুররামের প্রদর্শনীকেন্দ্র

‘ইনি কি হুররাম সুলতান? জনপ্রিয় টার্কিস সিরিয়াল সুলতান সুলেমানের নায়িকা?’

এটা শোনার পর চোখ বড়ো হয়ে যায় ক্রিভোর।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন ভেতরে ঢুকি, কজন কর্মকর্তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই আর্টিস্ট। উনিই এই প্রদর্শনীকেন্দ্র সম্পর্কে ব্রিফ করেন। সঙ্গে করে ঘুরে দেখান প্রদর্শনীকেন্দ্রের সব।

ক্রিভোর জানাশোনার জগতে অপরিচিত ‘সুলতান সুলেমান’। যদিও তুর্কি এই সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশের শহরে, গ্রামের দর্শকদের অনেকেরই পছন্দ। এই সিরিয়ালের জনপ্রিয় নায়িকা ‘হুররাম সুলতান’। এর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাবলীল অভিনয় কেড়েছে কোটি মানুষের মন। সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা আর ষড়যন্ত্র দিয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু নিজের করে নেওয়া এক রহস্যময়ী নারী হুররাম। মেরিয়েম তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান অভিনেত্রী, আসল নাম মেরিয়েম সারাহ ইউজারলি। ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই অভিনেত্রী বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। অভিনয় আর মডেলিং করে পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। ছোটখাটো চরিত্র দিয়েই জার্মানিতে শুরু করেছিলেন তার অভিনয় ক্যারিয়ার। ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কে এসে সুলতান সুলেমানের শুটিং করেন তিনি।

এবার দুষ্টুমির হাসি আসে ক্রিভোকাপিচের ঠোঁটে, ভুরুনাচিয়ে বলে, ‘আমার চেয়েও সুন্দর তোমার হুররম?’

আমি তখন ক্রিভোতে অন্ধ। ঐশ্বরিয়া রাই হোক আর সুলতান সুলেমান হোক, সব বিশ্বসুন্দরীই ক্রিভোকাপিচের কাছে নস্যি। মাথা নাড়াই দ্রুত, ‘মোটেও না। তোমার তুলনা তুমিই।’

মেয়েটির মাথায় তখন শয়তানি বুদ্ধি! সেই আর্টিস্টের কানে ফিসফিস করে কী বলে দেয়। আমার দিকে ঘুরে তাকায় সে, মুখে মিষ্টি হাসি। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে, পাশে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজও দেয়। ফেসবুকে ছবিটা আপলোড করি। মুহূর্তেই বন্ধু-সুহৃদদের মন্তব্যে ওয়াল ভরে যায়, হুররামের দেশে কবে গেলাম! ফিরতি মন্তব্যে আমার বুঝিয়ে দিতে হয়, ‘টার্কিতে না, আছি সার্বিয়াতে।’

‘সার্বিয়াতে হুররামকে কোথায় পেলাম?’

কমেন্টে-পালটা কমেন্টে চলতে থাকে আলাপন।

যুগোস্লাভিয়া থেকে সার্বিয়া আর আজকের বেলগ্রেড, রূপান্তরের এই ধারাক্রম তুলে ধরতেই এই আয়োজন। কম সময়ে বোঝানোর জন্য বেলগ্রেড সিটি মিউজিয়ামের স্থায়ী এই প্রদর্শনীকেন্দ্রটি ট্যুর প্ল্যানে রাখা হয়। প্রদর্শনী কেন্দ্রটির নাম ‘দ্য ইন্টেরিয়রস অব নাইনটিনথ সেঞ্চুরি-হোমস ইন বেলগ্রেড।’ ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রদর্শনীকেন্দ্রটি চালু হয়।

যুগোস্লাভিয়া থেকে আজকের সার্বিয়া- এই সময়ের বিবর্তন ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ৪৫০টির মতো ছবি, আর্ট ও পেইন্টিং রয়েছে। ফলিত কলা, ফোকলোর, চারুকলার নানা পারদর্শিতায় এই ছবিগুলোকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেশটির বদলে যাওয়ার ধারাক্রম বর্ণনা হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, পোশাক-আশাক, সংস্কৃতির বিবর্তন- সহজেই চোখে ধরা দেয়। অটোমান সাম্রাজ্যের চোখ রাঙানি, আধুনিকতার স্রোতে ইউরোপিয়ান শিল্পায়ন, সার্বিয়ান বুর্জোয়া ঐতিহ্যের নিদর্শন- চোখের সামনে জীবন্ত হয়েছে প্রদর্শনীর আসবাবপত্র, দেওয়ালের রং, গৃহস্থালি জিনিসপত্রে। সেই আমলে হাতে তৈরি কুটিরশিল্পের জিনিস যেমন আছে, শিল্পায়নের আশীর্বাদে সবশেষ আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির উপস্থিতিও রয়েছে এখানে। আমাদের দেওয়া হলো তিলের নাড়ু, মুড়কি, তিন রকম অপ্রচলিত মিষ্টি, সঙ্গে চা আর কফি। খেতে সুস্বাদু, কিন্তু এই সময়ে ঐতিহ্যবাহী এসব খাবারের দেখা মেলা ভার।

কম সময় নিয়ে সার্বিয়াতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য এই প্রদর্শনীকেন্দ্রটি দারুন সহায়ক। একটি দেশকে জানার জন্য যেসব তথ্য দরকার, তার সবগুলোই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

ঢাকার আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমে একটা প্রদর্শনী আছে। নওগাঁর পাহাড়পুর, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, রংপুরের তাজহাট রাজবাড়ি, শহিদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বাংলাদেশের নানা স্থাপনার ছোটো ছোটো রেপ্লিকা দিয়ে ভরা ওই প্রদর্শনীকেন্দ্রটি। এগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি উঠালে ভালো লাগে। দুধ চেয়ে না পেয়ে ঘোল খাওয়ার মতো ঘটনা।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.