শামসুর রাহমান: যাঁর কবিতার সর্বাঙ্গে আধুনিকতা

শামসুর রাহমান: যাঁর কবিতার সর্বাঙ্গে আধুনিকতা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। ১৭ আগস্ট ছিল তাঁর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। নাগরিক কষ্ট, সুখ-দুঃখ রাহমানের কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। বিদ্রোহ থেকে শুরু করে প্রেমের অনুভূতি- শব্দকে হাতিয়ার করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অনায়াস বিচরণ করেছেন বাংলা সাহিত্যের এই মহীরুহ। এখানে তুলে ধরা হলো শামসুর রাহমানের জীবন ও পৈতৃক ভূমিকে।

আবার পথে নেমেছি। এবার যাচ্ছি কবি শামসুর রহমানের শেড়কের সন্ধানে, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রামে। তাঁর পৈতৃক ভিটাতে। অবশ্য জন্মেছিলেন ঢাকার ৪৬ নম্বর মাহুতটুলিতে। বেড়ে ওঠা এবং জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকাতেই।

এবারের যাত্রায় আমার সঙ্গী ওয়াসিক। অন্যদিন-এর ফটোগ্রাফার। কথা অনুযায়ী সে রামপুরা থেকে এসেছিল গুলিস্তানে। সেখানে দুজন মিলিত হই এবং নরসিংদীগামী বাস ‘মেঘালয়’-এ উঠে পড়ি। এখন সেই বাসেই বসে আছি।

বাস নরসিংদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। আমি জানালা দিয়ে চেয়ে আছি বাইরে। ভাবছি শামসুর রাহমানের কথা। তিনি জন্মেছিলেন ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯ সালে। তিনি বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, যাঁর স্থান তিরিশের পাঁচ মহৎ আধুনিক কবির (জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু এবং বিষ্ণু দে) পরেই। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য এ ক্ষেত্রে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামটিও চলে আসবে।

শামসুর রাহমান প্রথম লিখেন একটি গদ্য রচনা, বসন্ত রোগে ছোট বোন নেহারের মৃত্যু হওয়ার পরে। ওই রচনায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্ন মুকুল’-এর ছায়া ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধও শিক্ষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ফলে তিনি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েছিলেন। ...তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি, ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। পরে কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘কবিতা’, ‘পূর্বাশা’, ‘পরিচয়’, ‘দেশ’ এবং ঢাকার ‘সংবাদ’ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বিখ্যাত সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’তে ঠাঁই পায় ‘আর যেন না দেখি’ কবিতাটি। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০)। যদিও এর আগে তিনি ‘মেধাবী রাতের নদী’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু পছন্দ না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’-এর জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। মোট কাব্যগ্রন্থ ৬৩। এ ছাড়া রয়েছে রবার্ট ফ্রস্টের অনুবাদ, খাজা ফরিদের কবিতা, একাধিক ছড়ার বই ও শিশুপাঠ্য গ্রন্থ। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত কাব্যগ্রন্থ আর কারও নেই। ...শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয় হলো— নাগরিক চেতনা, নৈঃসঙ্গ চেতনা এবং প্রেম।

শামসুর রাহমানের বেশ কয়েকটি কবিতায় গণচেতনা, রাজনৈতিক বিষয়-আশয় ভাস্বর। যেমন ‘হাতির শুঁড়’। এটি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’-এ ছাপা হয়েছিল। এখানে রাহমান তৎকালীন রাষ্ট্রীয় শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের হঠাৎ পাকিস্তানের শাসনভার করায়ত্ত করার বিষয়টি রূপকথার আড়ালে ব্যক্ত করেছেন। আরেকটি কবিতা হলো ‘টেলিমেকাস’। গ্রীক পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে রাহমান এখানে এদেশের তৎকালীন (ষাট দশক) অবস্থা এবং জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলেছেন। ...রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লিখেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। …ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে আসাদ শহিদ হলে লিখেন ‘আসাদের শার্ট’। সেই কবিতার তিনটি উজ্জ্বল পংক্তি হচ্ছে— ‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা /সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক। /আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ সত্তরে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এদেশে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা আসেন নি, তাদের ধিক্কার দিয়ে মওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় এক অসামান্য বক্তৃতা দেন। আর সেটি শুনে রাহমান লিখেন তাঁর অসাধারণ কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’।

‘নরসিংদী ... নরসিংদী ...’। কন্ডাক্টরের চিৎকারে আমার সংবিত ফিরে। হ্যাঁ, আমরা গন্তব্যের একটি মোড়ে পৌঁছে গেছি।

গাড়ি থেকে নেমে সিএনজিতে উঠি, ব্যাটারি চালিত, যেটিকে প্রতিদিন চার্জ দিতে হয়। যাব আরশীনগরে। ... কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাই। ভাড়া চুকিয়ে আমি ও ওয়াসিক নেমে পড়ি। লক্ষ করি, রেললাইনের ওপারে সিএনজির সারি। সেগুলোর একটিতে উঠে পড়ি, যা যাবে রায়পুরায়।

আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম, রায়পুরার মেথিকান্দা রেলগেইটে। সেখান থেকে আবার অন্য সিএনজিতে উঠি। পৌঁছি পান্থশালা ঘাটে। নৌকায় পাড়ি দিই মেঘনা। নামি বাল্লাকান্দির বাজারে। পাড়াতলীর উদ্দেশে যাত্রা করি।

সামান্যই পথ, এক ভদ্রলোক জানায় আমাদের। তাই হাঁটতে থাকি আমরা। পাঁচ মিনিট পরেই গ্রামটির চৌহদ্দিতে পা পড়ে আমাদের। চারদিকের সবুজ শ্যামলিমা দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ওই অপরূপ প্রকৃতি ভালো লাগত কবি শামসুর রাহমানেরও। কেননা ‘সর্ষে খেতে প্রজাপতির নাচ, গাছপালার সমারোহ, দিঘির টলটলে, ঢলঢলে রূপ, স্বাস্থ্যবান খালে নৌকোয় বেড়ানো, বাঁশবনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাখির ডাক শোনা, রাতের নানা জায়গায় ঝোপঝাড়ে জোনাকির জ্বলা আর নেভা দেখার খালিশ আনন্দ লুট করার সুযোগ ঢাকা শহরে কোথায় ?’(কালের ধুলোয় লেখা, শামসুর রাহমান, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ৬৩)।

পাড়াতলীর পৈতৃক বাড়িতে রাহমান মাঝে মাঝে আসতেন। একাত্তরে অবশ্য দীর্ঘদিন ছিলেন। দেড়-দু’মাস। মার্চের শেষ পর্যায়ে আসেন, ফিরেন মে-তে। লিখেন একটি কবিতা, যেখানে আবার পাড়াতলীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। ...পাড়াতলী অবশ্য শামসুর রাহমানের এক উপন্যাসেও মূর্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালের পটভূমিতে লেখা ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ নামে সেই উপন্যাসে অবশ্য তার নাম পলাশতলী। এখানে রাহমান, তাঁর বাবা, মা, স্ত্রীসহ অনেকেই বাঙ্ময়। বলাই বাহুল্য, ভিন্ন নামে।

কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মুন্সীবাড়ি অর্থাৎ শামসুর রাহমানের পৈতৃক ভিটায়। বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। দূর থেকে সেটিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওপাড়ে মুন্সীবাড়ি তৎসঙ্গে একটি মসজিদ।

মুন্সীবাড়িতে ঢুকি। একতলা একটি পাকা দালান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই দালানের একটি ঘরেই শামসুর রাহমান থাকতেন, যখন তিনি এখানে আসতেন। আর হ্যাঁ, বাড়িটির নাম ‘বায়তুল আমান’। নামফলকে লেখা নির্মাণকাল ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।

জামানুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি শামসুর রাহমানের জেঠা মুন্সী ফজলুর রহমানের ছেলে। তিনি জানালেন, শামসুর রাহমান ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে-তে যখন এখানে ছিলেন, তখন একদিন দুটি কবিতা লিখেন পুকুরের আম গাছতলার নিচে বসে। এখন সেই আমগাছ ও কৃষ্ণচূড়া গাছটি নেই, তবে বকুল গাছটি রয়েছে। হ্যাঁ, আত্মজীবনীতে রাহমান জানিয়েছেন, ১৯৭১-এর ৭ অথবা ৮ এপ্রিল তিনি প্রায় আধঘণ্টা কিংবা কিছু বেশি সময়ে পর পর লিখে ফেলেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’। আর এই দুটি কবিতা তিনি লিখেছিলেন মেজ চাচার চতুর্থ শ্রেণি পড়–য়া ছেলের সরবরাহ করা একটি রুলটানা খাতায়, একটি কাঠপেন্সিলের মাধ্যমে।

দুটি কবিতার উজ্জ্বল পঙ্ক্তিমালা আমার মনে পড়ে, ‘স্বাধীনতা তুমি / রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। /স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ কিংবা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’ উল্লেখ্য, শামসুর রাহমানের প্রবাদপ্রতিম খ্যাতির পেছনে এই দুটি কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আমি বললাম, রাহমান ভাইয়ের ছোট ছেলে মতিন তো এই পুকুরেই ডুবে মারা গিয়েছিল, তাই নয় কি?...তৌফিকুর রহমান মাথা ঝাঁকিয়ে আমার কথায় সায় জানালেন। বললেন, আপনি তো অনেক কিছু জানেন।

ওয়াহিদুল রাহমান ওরফে মতিনকে ভুলেন নি শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতায়ও সে অমর হয়ে আছে। শামসুর রাহমান মৃত ছোট ছেলেকে নিয়ে লিখেছেন ‘একটি ফটোগ্রাফ’ নামের কবিতা।

এ ছাড়া ইকারুস এবং ডেডালাস চরিত্র দুটি রাহমানের কবিতায় রিপিটেড হয়েছে। সন্তানের মৃত্যু এবং সন্তান হারানোর বেদনাবোধ রাহমানকে দিয়ে দুটি আলাদা কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। পাড়াতলীতে আমরা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আরেকটি উচ্চ বিদ্যালয় ঘুরে দেখি, যে দুটো বহন করছে যথাক্রমে শামসুর রাহমানের পিতা ও পিতামহের নাম। দেখা গেল, উচ্চ বিদ্যালয়টিতে শামসুর রাহমানের নামে একটি পাঠাগারও রয়েছে।

চারদিকে কনে দেখা আলো। সূর্য মামা বিদায় নিচ্ছে। আমরাও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার পথে নামি। পেছনে পড়ে থাকে পাড়াতলী গ্রাম, শামসুর রাহমানের পৈতৃক ভিটা, মুন্সীবাড়ি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.