অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ থাকছেন কবি বন্দে আলী মিয়া।
পাবনার মাটিতে জন্মেছিলেন এ দেশের স্মরণীয় কয়েকজন সাহিত্যিক। যেমন, পাবনার সুজানগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবদুল গনি হাজারী, পাবনা শহরের লাগোয়া গোবিন্দা গ্রামে কবি আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, রাধানগর তথা নারায়ণপুরে সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া, সুজানগর উপজেলাধীন মুরারীপুর গ্রামে মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন এবং কামারহাটি গ্রামে জন্মেছিলেন সরদার জয়েন উদ্দীন।
তবে এবারের যাত্রায় আমরা পাবনার দুজন আলোকিত সন্তান—বন্দে আলী মিয়ার পৈতৃক ভিটা দর্শন করব।
রাধানগর তথা নারয়ণপুরের উদ্দেশে চলেছি আমরা। আমাদের রিকশা পেরিয়ে যাচ্ছে পাবনা শহরের নানা পথ, এডওয়ার্ড কলেজ। এক সময় ওয়াবদা গেট, নুর মসজিদ পেরিয়ে সোজা পথে আমরা উপস্থিত হই রাধানগরে তথা নারায়ণপুরে। এখানেই কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি।
নারায়ণপুরের পথে একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাদের বাড়িটি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন। এমনকি একজন কিশোরকেও নির্দেশ দেন যেন সে বন্দে আলী মিয়ার বাড়িটি আমাদের চিনিয়ে দেয়।
রিকশাঅলাকে বিদায় দিয়ে আমরা কিশোরটিকে অনুসরণ করি। কিছুক্ষণ পরে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই বন্দে আলী মিয়ার বাড়ির সামনে। বিরাট বাড়ি। পরে আমরা জানতে পারি, ছয় বিঘা জমির ওপরে এখানে-ওখানে বাস করেন বন্দে আলী মিয়ার পাঁচ ছেলে। এক ছেলে ঢাকায় থাকেন। ছেলেদের ছেলেমেয়ের সংখ্যাও কম নয়। তাদেরও সংসার রয়েছে। বাড়িতে একটি পুকুর রয়েছে। চারদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাছ। পাশেই একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এটি কবি বন্দে আলী মিয়ার নাম বহন করছে। এবং সেই স্কুলের পাশেই একটি জায়গায় বন্দে আলী মিয়ার বাঁধানো কবর।
বিশ্বজিৎ তার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করতে থাকে বন্দে আলী মিয়ার বাড়ির নানা অংশ। আমি ভাবতে থাকি, হ্যাঁ, পাবনার শহরতলীর রাধানগরে এই বাড়িটিতেই তাহলে জন্মেছিলেন বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর)। যাকে আমরা জানি একজন কবি হিসেবে। ছোটবেলায় পাঠ্যবাইয়ে তাঁর কবিতা আমরা পড়েছি। পড়েছি রূপকথা, জীবনীসহ বেশ কয়েকটি শিশুতোষ গ্রন্থও। সত্যি কথা বলতে কী, শিশুতোষ গ্রন্থই তিনি বেশি লিখেছেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী উমেদ আলী মিয়া। তিনি পাবনা শহরের জজ আদালতে এক নিম্নপদে চাকরি করতেন। মা নেকজান নেসা। বন্দে আলী মিয়া ছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান। তাঁদের স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে ছেলে। তাই পিতা উমেদ আলী ছেলেকে ভর্তি করে দেন বাড়ির কাছের মজুমদার একাডেমিতে। কিন্তু এখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বন্দে আলী মিয়া ভর্তি হন কলকাতার বৌবাজারস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে। সেখান থেকে ১৯২৭ সালে পাশ করার পরে আইএ পড়ার একান্ত ইচ্ছায় ভর্তি হন করটিয়ার সাদত কলেজে, পরে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে। কিন্তু কলেজের ছকে বাঁধা জীবন ভালো না লাগায় প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সেখানেই ইতি ঘটে বন্দে আলী মিয়ার।
বন্দে আলী মিয়ার বাড়ির একটি অংশে নতুন দালান উঠছে। দোতলা এই অট্টালিকার কাজ এখনো শেষ হয় নি (পরে বন্দে আলী মিয়ার বড় ছেলের সূত্রে জানতে পারি যে, এটি তার মেয়ের অংশ)। দালানটিকে পাশ কাটানোর পরেই দেখি, একটি পুকুর। পুকুরের একটি দিকে টিনের চালের একটি বাড়ি। আমাদের সঙ্গী কিশোরটি অবলীলায় সেই বাড়িতে ঢুকে যায়। শুনতে পাই কিশোরটি আমাদের সম্পর্কে বলছে। এরপরেই এক পুরুষকণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে কী যেন বলে।...ছেলেটি বাড়িটি থেকে বের হয়ে আসে। আমাদেরকে বলে তাকে অনুসরণ করতে।
কিশোরটির পিছু পিছু বন্দে আলী মিয়ার বাড়ির আরেকটি অংশে আমরা হাজির হই। পথের ধারে টিনের চালের একটি ঘর। এই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে কিশোরটি। দরজা খুলে যায়। ত্রিশোর্ধ্ব এক যুবক কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকায়। আমরা নিজেদের পরিচয় দেই, আগমনের হেতু সম্পর্কে খুলে বলি। যুবকটি আমাদের ঘরের ভেতরে আহ্বান জানায়, কিন্তু তার চোখ-মুখের বিরক্তিভাব আমাদের নজর এড়ায় না। কিছুক্ষণ পরে যুবকটির কথায়ই তার মনের ভাব ঝরে পড়ে। তার বক্তব্য হচ্ছে, বহুবার বহু পত্রিকার রিপোর্টার-আলোকচিত্রী তাদের বাড়িতে এসেছেন, ছবি তুলেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—কিন্তু সেই ছবি আর সাক্ষাৎকার আর কোনো পত্রিকায়ই প্রকাশিত হয় নি। আমরা তাকে আশ্বস্ত করি এই বলে যে, আমাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে না। শুনে তিনি অন্দরমহলে আমাদের আগমনবার্তা পাঠান। আমরা তার সঙ্গে আলাপে মেতে উঠি। এক পর্যায়ে জানতে পারি যে, তিনি ব্যবসায়ী।
মনে পড়ে, আমরা যার সঙ্গে কথা বলছি তার দাদা বন্দে আলী মিয়া সুদীর্ঘকাল (১৯৩০-৫০) চাকরি করেছেন কলকাতা করপোরশেনের স্কুলে। আর এই চাকরিটি তিনি পেয়েছিলেন গবেষক-লেখক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাড়িঅলা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়ের সূত্রে। ক্ষিতীশ ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহের অধিকর্তা। কলকাতায় থাকাকালীন শুধু করপোরেশনের চাকরিই নয়, বই-পত্রিকার ছবি এঁকেও অর্থের সমাগম হচ্ছিল বন্দে আলী মিয়ার।
দেশবিভাগের পরে ১৯৫২ সালে বন্দে আলী মিয়া স্বদেশে চলে আসেন। পরে তিনি বাংলাদেশ বেতারের রাজশাহী কেন্দ্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেন এবং গল্প দাদুর আসর পরিচালনা করতেন।
কথোপকথনের আওয়াজ কানে যেতেই সংবিত ফিরে পাই। লক্ষ করি বয়স্ক এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে কথা বলছেন বিশ্বজিতের সঙ্গে। আমার সঙ্গে তাকে পরিচয় করে দিল বিশ্বজিৎ। জানতে পারলাম, ভদ্রলোক কবি বন্দে আলী মিয়ার বড় ছেলে রকিবুল ইসলাম। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কবি কোন ঘরে থাকতেন? তিনি বলেন, পাশেই, পুরোনো আমলের একটি ঘরে। এই বলে তিনি ঘর থেকে বের হন। আমরা তাকে অনুসরণ করি। আবার পথ ঘুরে বাড়ির আরেকটি অংশ প্রবেশ করা। লক্ষ করি, জীর্ণশীর্ণ একটি দালান। পাশে বাঁধানো একটি কুয়া। আরেক পাশে আরেকটি ঘর। তৎসঙ্গে একটি ভাঙা সদর দরজা। সেই দরজার ওপরে সিমেন্টের প্রলেপে লেখা টুটু মিয়া। কে এই টুটু মিয়া? আমার স্বগতোক্তি শুনে সহাস্যে রকিবুল ইসলাম জানান দেন যে, টুটু মিয়া তারই ডাক নাম। বন্দে আলী মিয়াই এই নামটি দিয়েছিলেন। কেননা বড় ছেলে বলে তিনি ছিলেন পিতার বড় আদরের।
হ্যাঁ, বন্দে আলী মিয়ার বড় ছেলে রকিবুল ইসলাম এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি প্রথম সন্তান নন, এমনকি প্রথম স্ত্রীর সন্তানও নন। তিনি বন্দে আলী মিয়ার তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান।...বন্দে আলী প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১৩৩৩ সালের অগ্রহায়ণে, পিতা-মাতার ইচ্ছানুসারে পাবনা শহরের জেলাপাড়ার মেয়ে রাবেয়া খাতুনকে। বন্দে আলী-রাবেয়ার একমাত্র সন্তান—রোকেয়া বেগম। তিনি বর্তমানে রাজশাহী সরকারি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটে বাংলার অধ্যাপিকারূপে কর্মরত রয়েছেন।...কলকাতায় থাকাকালীন বন্দে আলী মিয়া তাঁর কর্মস্থলের এক শিক্ষিকা মিস হেনাকে বিয়ে করেন (তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। মতান্তরে তিনি ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান ছিলেন)। তার গর্ভে বন্দে আলী মিয়ার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।...বন্দে আলী মিয়ার তৃতীয় স্ত্রী শামসুন্নাহার। তিনি বগুড়ার বৃন্দাবন পাড়ার (নবাব বাড়ির লাগোয়া) মেয়ে। বন্দে আলী-শামসুন্নাহারের আট সন্তান: রকিবুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, আফরোজা বেগম, মোহিদুল ইসলাম, ফরিদুল ইসলাম, আফরোজা বেগম, দিলরুবা বেগম এবং রমিজুল ইসলাম। এই আটজনের মধ্যে সবাই নিজেদের ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শুধু রমিজুল ইসলাম মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পাবনার বাড়িতে বসবাস করছেন।...বন্দে আলী মিয়ার চতুর্থ স্ত্রী পরীবানু। তার গর্ভে বন্দে আলী মিয়ার দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু শান্তাহারের মেয়ে পরীবানুর সঙ্গে বন্দে আলী মিয়ার দাম্পত্যসম্পর্ক বেশি দিন টিকে নি। এক পর্যায়ে সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়।
রকিবুল ইসলাম পুরোনো আমলের দালানে প্রবেশ করেন। তালাবদ্ধ ঘরের দরজা উন্মুক্ত করেন। আমরা প্রবেশ করি। লক্ষ করি, পুরোনো একটি খাট, আলনা, দুটি আলমিরা ঘরের এখানে-সেখানে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রকিবুল ইসলাম জানালেন যে, তার মা শামসুন্নাহার বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। তারপর থেকেই এই ঘরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বই বোঝাই আলমিরার দিকে এগিয়ে যাই। লক্ষ করি, রবীন্দ্র রচনাবলী, নজরুল রচনাসম্ভারসহ বহু মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ। মাসিক শিশুসাথী পত্রিকার বাঁধানো কয়েকটি ভলিউমও রয়েছে। আলমিরার নিচে পড়ে রয়েছে দুটি ট্রাঙ্ক। রকিবুল ইসলাম জানালেন যে, ট্রাঙ্ক দুটিতে বন্দে আলী মিয়ার অপ্রকাশিত বহু রচনাবলি রয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী বেতার ভবনে পুরোনো ফাইলে ও নথিপত্রেও তার বাবার বহু অপ্রকাশিত গল্প ও কবিতা জমা আছে।
বন্দে আলী মিয়ার প্রকাশিত রচনাসম্ভার বিপুল। বিষয়ের দিক থেকে তা বিচিত্রও। তিনি ১০টি কাব্য, দুটি গীতি-কবিতা গ্রন্থ, তেরটি উপন্যাস, তিনটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, তিনটি প্রহসন, ‘জীবনের দিনগুলি’ নামে স্মৃতিচারণ, ‘জীবন-শিল্পী নজরুল’ নামে জীবনী-গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তৎসঙ্গে রয়েছে কয়েকটি বেতার কথিকা ও শিশুতোষ নাটক, শতাধিক কিশোরপাঠ্য চরিত্রকথা ও রূপকথা জাতীয় রচনা। একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, বন্দে আলী মিয়ার ১৩৪টি প্রকাশিত গ্রন্থ তাঁর ‘ধরিত্রী’ কাব্যগ্রন্থের শেষে যে গ্রন্থতালিকা সংযোজন করেছেন—যেখানে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৩৬টি দেখানো হয়েছে।
পুরোনো দালানটির পাশেই কবি বন্দে আলী কিন্ডারগার্টেন। এটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। লক্ষ করি স্কুল-ভ্যানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই ফিরে যাচ্ছে। তারা আলোর পথের যাত্রী। উপযুক্ত শিক্ষা এক সময় তাদেরকে আলোকিত মানুষ করে তুলবে।...বন্দে আলী মিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয় নি। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অন্তরের টানে তিনি জীবনে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
যখন বন্দে আলী মিয়া কৈশোরের অম্ল-মধুর দিনগুলি যাপন করছিলেন, নবম শ্রেণির ছাত্র, তখন গোপনে কবিতা লিখতেন আর কবিতার খাতা সযত্নে লুকিয়ে রাখতেন। সহপাঠী বন্ধু সুরেশচন্দ্র মৈত্রের মামা প্রফুল্ল কুমার সান্ন্যালের সূত্রে ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী গেজেট’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘ছিন্নপত্র’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। কবিতাটির প্রথম দুটি পঙ্ক্তি হচ্ছে— ‘চিঠি একখানি কুড়ায়ে পেয়েছি তোমার জানালা তলে/রঙিন আসরে কত লেখা তার সিক্ত ছিল অশ্রুজলে’। বন্দে আলী মিয়ার সাহিত্য-জীবনের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তার মামা আব্বাস আলী।
বন্দে আলী মিয়ার প্রথম প্রকাশিত বই ‘চোর জামাই’। প্রকাশক কলকাতার আশুতোশ লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী আশুতোশ ধর। এটি ছিল একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। এর কয়েক বছরের মধ্যে (১৯৩২) তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ রবীন্দ্রনাথের অভিমতকে শিরোভূষণ করে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছে। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হও নি তাতে করে কবিতাগুলি আরও সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলাভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’
বন্দে আলী মিয়ার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—মধুমতীর চর, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, মসনদ, বৌদিদি রেস্টুরেন্ট, জীবনের দিনগুলি, জীবন-শিল্পী নজরুল ইত্যাদি।
বন্দে আলী মিয়ার সম্পর্কে প্রাবন্ধিক-গবেষক গোলাম সাকলায়েন-এর ভাষ্য, ‘সকালবেলার শিশির বিন্দুর মতো নিটোল মন নিয়েই কবি সারা জীবন সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তাঁর কাব্যে যুগ-যন্ত্রণা ও সমকালীন জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা ও দ্বন্দ্বের ছাপ যে ছিল না তা নয়। তবে সবই তিনি প্রকাশ করেছিলেন একটি বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে। সেই বৃত্তের বাইরে তিনি আসেন নি কোনো দিন। সারা জীবন তিনি লিখে গেছেন কিন্তু তাঁর সাহিত্য সাধনার মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল। এই সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি একটি স্বকীয় সাহিত্যধারা নির্মাণ করতে পারেন নি। তথাপি মনের সব অনুরাগ দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশকে কবি দেখেছিলেন আর তাকেই অনায়াস ভঙ্গিতে সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন।’
কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও বন্দে আলী মিয়া সম্পৃক্ত ছিলেন। পূর্ণচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘বিকাশ’। এমনিভাবে, ‘সোলতান’ ও দৈনিক ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। তাঁর পরোক্ষ সম্পাদনায় বের হয় ‘ময়ূরপঙ্খী’ পত্রিকাও। শেষ জীবনে তিনি রাজশাহী থেকে ‘প্রতীতি’ সম্পাদনা করেন।
বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫)।
কিন্ডারগার্টেনের পাশে বন্দে আলী মিয়া চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন। ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর কবরটি বাঁধানো, চারদিক ঘেরা। পাশেই লেখা আছে কবির ‘আমাদের গ্রাম’ নামক শিশুতোষ বিখ্যাত কবিতাটি ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর...।’ এ ছাড়া তাঁর লেখা শেখ কবিতা ‘শেষ প্রহর’ শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে যেখানে কবি লিখেছেন ‘এবার আমার শেষ হয়ে এলো প্রবাসের দিনগুলি/যাবার বেলায় বারে বায়ে হায় মন ওঠে তবু দুলি।/কেটেছে হেথায় কয়েকটি বছর/সুখে দুখে বেদনায়/স্মরণ ভরিয়ে রইল সে সব/ভুলিব না কভু তায়/আমার স্মরণে তোমাদের ছবি/জেগে রবে অনুক্ষণ/বিদায় এবার ফুরায়েছে মোর/প্রবাসের প্রয়োজন’।
আমাদেরও রাধানগরে তথা নারায়ণপুরে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার আমাদের ইটপাথরের রাজধানীতে ফেরার পালা।
Leave a Reply
Your identity will not be published.