নায়করাজের চিরসবুজ ছবি ‘ময়নামতি’

নায়করাজের চিরসবুজ ছবি ‘ময়নামতি’

এদেশের চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ২১ আগস্ট ছিল তাঁর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর চিরসবুজ চলচ্চিত্র ‘ময়নামতি’র ওপর আলো ফেলা হলো এখানে।

১৯৬৯ সালের ১৬ মে মুক্তি পেয়েছিল কাজী জহির পরিচালিত ‘ময়নামতি’। একটি হৃদয়স্পর্শী চলচ্চিত্র। সময় কী বিস্ময়কর! হামাগুড়ি দিতে দিতে ক্রমশ সে পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে দিয়েছে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উল্লেখযোগ্য এ চলচ্চিত্রকর্মটিকে।

‘ময়নামতি’ একটি দ্বিভাষিক চলচ্চিত্র। বাংলা ও উর্দুভাষায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি একই সঙ্গে এদেশ এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন লাহোরের এক অবাঙালি ভদ্রলোক।

ছবিতে ময়না ও মতি’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যথাক্রমে কবরী ও রাজ্জাক। আর একটি কথা, রাজ্জাক ও কবরী এ ছবির আগেও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ‘ময়নামতি’র অভূতপূর্ব ব্যবসায়িক সফলতা তাদের ছুটিকে একটি শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।

রাজ্জাক কীভাবে মতি চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হলেন, এ বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। ছবিটির পরিচালক কাজী জহির কথা বলার জন্য খুঁজছিলেন রাজ্জাককে। বিষয়টি একদিন রাজ্জাককে জানালেন জহির রায়হান।

রাজ্জাক বললেন, তিনি তো উর্দু ছবি করেন। আমি উর্দু ছবিতে কাজ করব না।

জহির বললেন, এভাবে বলবেন না। তিনি অনেক ব্যবসাসফল ছবির পরিচালক। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আপনি কথা বলুন।

জহিরের কথা রাজ্জাক ফেলতে পারলেন না। গেলেন কাজী জহিরের কাছে। রাজ্জাককে দেখে কাজী জহির বললেন, আমি একটি ছবি বানাব। নাম ময়নামতি।

রাজ্জাক বললেন, ছবির গল্পটি বলুন।

এ কথা শুনে কাজী জহির উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, আমি কাজী জহির গল্প শোনাব তোমাকে? বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন। কয়েকদিন পর কাজী জহির ডেকে পাঠালেন রাজ্জাককে। রাজ্জাক যাওয়ার পর তাকে গল্পও শোনালেন। রাজ্জাক বললেন, চমৎকার! খুবই ভালো গল্প। কাজী জহির বললেন, এ ছবির প্রযোজক লাহোরের। তারা তোমাকে দশ হাজার টাকা দেবেন। রাজ্জাক বললেন, আমি তো পঁচিশ হাজার টাকার নিচে এ ছবি করব না।

রাজ্জাকের কথা শুনে কাজী জহির খুবই অবাক হলেন। বললেন, কেউ আমার কাছে এত টাকা চায় নি। রাজ্জাক বললেন, চাইতাম না। যদি আপনি প্রযোজক হতেন। প্রযোজক যেহেতু লাহোরের সেহেতু কম টাকা নিতে যাব কেন? বিষয়টির কোনো ফয়সালা হলো না। রাজ্জাক তাই চলে এলেন।

কিছুদিন পর এক অবাঙালি ভদ্রলোক এলেন রাজ্জাকের কাছে। জানালেন ‘ময়নামতি’ ছবিটি তিনিই প্রযোজনা করছেন। তারপর জানতে চাইলেন, কিতনা রুপিয়া চাহিয়ে?

রাজ্জাক বললেন, পঁচিশ হাজার। সাইনিং মানি দিতে হবে পাঁচ হাজার।

অবাঙালি ভদ্রলোক সেই টাকা দিয়েই চলে গেলেন।

‘ময়নামতি’ ছবির শুটিং করতে গেলেন রাজ্জাক। এক মাসের মতো শুটিং হলো। দেখলেন, কী ভীষণ খুঁতখুঁতে পরিচালক কাজী জহির! কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না তিনি। কোনো দৃশ্য ভালো না হলে বলেন ভালো করতে। ভালো হলে বলেন আরও ভালো করতে। তাতেও তিনি খুশি হন না। আর ছবিতে যা দরকার সেটিই চাই তার। নইলে শুটিং বন্ধ। যেমন এই ছবির জন্য দরকার ছিল আখের। এখন ঢাকায় তেমন পাওয়া যেত না আখ। তাই আখের জন্য প্রোডাকশ’স ম্যানেজার সাভারে লোক পাঠিয়েছিলেন। আখ এল। শুটিং হলো। অথচ আখ ফ্রেমে একবার এসেছে। খাড়া করে রাখা ছিল আখ।

শিক্ষিত এবং গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক। যে নাকি প্রেমে পড়ে গরিব ঘরের মেয়ে ময়নার। মতির বাবা শ্রেণি সচেতন। তার কাছে অর্থই গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র মানুষদের তাই তিনি মানুষ বলে গণ্য করেন না। কিন্তু মতি অন্য ধরনের ছেলে। সে বেশ মিশুক। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই তাকে ভালোবাসে। ময়নাকে যে মতি ভালোবাসে, সে ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। যেদিন ময়না অন্যের ঘরনি হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেদিন মতি প্রচণ্ড আঘাত পায়। পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে। ময়নাকে বহনকারী পালকির পেছন পেছন সে দুঃখভরা হৃদয়ে ছুটে চলে। একপর্যায়ে উঁচু স্থান থেকে গড়িয়ে পড়ে। ...মতির চরিত্রে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন রাজ্জাক। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, শুটিংয়ের সময় অত্যন্ত সিরিয়াস পরিচালক কাজী জহির রাজ্জাককে ধাক্কা মেরে বসেন। ফলে টিলা থেকে রাজ্জাক প্রায় দু শ’ গজ নিচে পড়ে যান। মচকে যায় তার ডানহাতের তিনটি আঙুল। আবার জমিদারের লোকেরা মতিকে মারছেÑএই দৃশ্যেও কাজী জহির পুরোনো ঢাকার সত্যিকারের লাঠিয়ালদের ব্যবহার করায় দৃশ্যটিকে তারা বেশিমাত্রায় বাস্তবসম্মত করে ফেলেছিল। অবস্থা গুরুতর দেখে পরিচালক কাজী জহির সেট থেকে পালিয়ে যান। সেদিন রাতে রাজ্জাকের ভীষণ জ্বর হয়েছিল। তবে সৌভাগ্যক্রমে তেমন কিছু হয় নি। এমনি নানা অম্ল-মধুর ঘটনা ঘটে ‘ময়নামতি’ ছবিটি নির্মাণের সময়।

ছবিটির গল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছে—গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান মতি। শহরে থেকে পড়াশোনা করে। ছুটিতে গ্রামে আসে সে। তখন চঞ্চল-উচ্ছ্বল ময়নার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের শুরুতে মতিকে নিয়ে ময়না বেশ মজা করে। মতি স্যুটকেস ও ক্যামেরা নিয়ে বাঁশের সাঁকো দিয়ে জলাভূমি পার হতে গিয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ দেখে ময়না খিলখিল করে হেসে ওঠে। ধীরে ধীরে মতির সঙ্গে ময়নার হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ময়নাকে ভালোবাসে গ্রামের আরেক যুবক মনা। কিন্তু ময়না তাকে পাত্তা দেয় না। ...ময়না ও মতির প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মতির বাবা। তিনি কিছুতেই এ সম্পর্ক মেনে নিতে চান না। একপর্যায়ে ময়নার বিয়ে হয় গ্রামের জমিদারের সঙ্গে। ময়না স্বামীর ঘরে চলে যায়। মতি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। এদিকে ময়নাকে যে যুবকটি ভালোবাসত, মনা, সে লটারিতে লাখ টাকা পেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। শেষ পর্যায়ে মনাই ময়নার অত্যাচারী স্বামীকে খুন করে। বিচারে তার ফাঁসি হয়। জেলে মনার সঙ্গে দেখা করতে যায় ময়না ও মতি।

‘ময়নামতি’তে আগেকার দিনের সময়ের চিত্র পাওয়া যায়। তখন ছিল জমিদারি আমল। অত্যাচারী জমিদারের শাসন যে কী ভয়াবহ হতে পারে সেটি এই ছবিতে ফুটে উঠেছে। ...জমিদারের (ইনাম আহমেদ) লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ময়নার ওপর। সে নায়েবের সহায়তায় ছলেবলে কৌশলে ময়নাকে ঘরের বউ বানায়। ময়নার বাবাকে একেবারে নিঃস্ব করে দেয়।

এই ছবিতে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব পরিস্ফুটিত। ময়না গরিবের মেয়ে, অন্যদিকে মতি স্বচ্ছল ঘরের ছেলে। তাই মতি ময়নাকে বিয়ে করতে চাইলে মতির বাবা রাজি হয় না। তারই কারণে দুটি তরুণ প্রাণ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়।

টাকাই যে এই জগৎ সংসারে মানসম্মানের মানদণ্ড সেটিও এই ছবিতে লক্ষণীয়। যখন মনার (জলিল) কোনো টাকা-পয়সা ছিল না, তখন তার কোনো সম্মানও ছিল না। মতির বাবা তাকে হেয় দৃষ্টিতে দেখত। অথচ যখন মনা লটারিতে লক্ষ টাকা পেল, তখন তাকে মতির বাবা সমাদর করে বসার ঘরে নিয়ে বসায়, ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে। টাকার জন্যই মনার অনেক সাধ-আহ্লাদ পূরণ হয় নি। তাই তো অনেক টাকার মালিক হলেও মনা সেই টাকা খরচ করে না।

ছবিতে ভালোবাসার জন্য মনার আত্মত্যাগ দেখা যায়। ময়নার ভালোবাসা সে পায় নি। ময়না ভালোবাসে মতিকে। তাই এই দুজন মানুষের মিলনের জন্য, অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে ময়নাকে রক্ষা করার জন্য জমিদারকে খুন করে মনা। শেষপর্যন্ত বিচারে তার ফাঁসি হয়।

ছবিতে যেমন হৃদয়স্পর্শী একটি গল্প রয়েছে, করুণ রস রয়েছে, তেমনি দর্শকদের রিলিফ দেওয়ার জন্য রয়েছে হাস্যরস। এই ছবির একটি দৃশ্য চিরকাল বাঙালিকে হাসাবে। দৃশ্যটি হলো, পাখি (খান জয়নুল) ও মনা (জলিল) মিষ্টি খাওয়ার জন্য গ্রামের একটি মিষ্টির দোকানে যায়। দোকানি তখন ঘুমোচ্ছিল। তার বালক বয়সী ছেলে ক্যাশে বসে মিষ্টি বিক্রি করছিল। পাখি সেই ছেলেটিকে বলে তাদের দুজনকে মিষ্টি দেওয়ার জন্য। বালকটি পয়সা চায়। পাখি জানায় দোকানি তাদের চেনে, পয়সা লাগবে না। বালকটি তখন নাম জানতে চায়। পাখি জানায় তার নাম মাছি। বালকটি তাদের দুজনকে মিষ্টি খেতে দেয়। চারটি মিষ্টি খাওয়ার পর পাখিরা আরও মিষ্টি নেয়। বালকটি আধঘুমন্ত বাবাকে বলে, ‘বাবা, মিষ্টি খায়।’ বাবা বলে, ‘ক্যাডা’? বালক বলে, ‘মাছি’। বাবা বলেন, ‘বাতাস কর’। কিছুক্ষণ পরে পাখি ও মনা আরও মিষ্টি খেতে থাকে। বালকটি বাবার উদ্দেশে বলে, ‘বাবা, মিষ্টি খেয়ে ফেলল’। বাবা বলে, ‘আরও জোরে বাতাস কর।’ তারপর যখন দোকানের সমস্ত মিষ্টি সাবাড় করার উপক্রম করে পাখি তখন ছেলের কথায় দোকানি পুরোপুরি জেগে উঠে এবং পাখিদের তাড়া করে।        

এ ছবির গানগুলো শুধু শ্রুতিমধুরই ছিল না, সেগুলো যথাযথ সিচুয়েশনে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাই সেগুলোর আবেদন ছিল অনেক গভীর। তাই তো ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না’, ‘ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমায় আপন হাতে’ ইত্যাদি গানগুলো এখনো শ্রোতাদের আপ্লুত করে।

‘ময়নামতি’ মুক্তি পাওয়ার পর ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়ে। ফলে রাজ্জাক-কবরী জুটি প্রতিষ্ঠা পায়। উল্লেখ্য, ‘ময়নামতি’র আবেদন এখনো অক্ষুণ্ণ। দুই বছর আগে ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় চ্যানেল আইতে। আর ছবিটির গল্প অবলম্বনে ২০১৪ সালে জাকির হোসেন রাজু নির্মাণ করেছিলেন ‘অনেক সাধের ময়না’। এ ছবির প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহিয়া মাহি (ময়না), বাপ্পি চৌধুরী (মতি) এবং আনিসুর রহমান মিলন (মনা)।   

Leave a Reply

Your identity will not be published.