ঊননব্বইতে হাসনাত আবদুল হাই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা

ঊননব্বইতে হাসনাত আবদুল হাই  সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা

প্রবীণ কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই সম্প্রতি সাতাশিতে পা দিয়েছেন। ছয় দশক ধরে তিনি লিখছেন। তাঁর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বৈচিত্র্য। গতানুগতিকতা ও পৌনঃপুনিকতা পরিহার করে নতুনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাঁর গল্প-উপন্যাসে মূর্ত হয়ে ওঠে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়-আশয়, মানুষের যাপিত জীবন, প্রেম ইত্যাদি। তিনি জীবনীধারার উপন্যাস লেখায় আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ভ্রমণকাহিনিতে রেখেছেন নিজস্বতার ছাপ। উন্নয়ন অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট, নন্দনতত্ত্ব এবং রাজনীতি নিয়েও তিনি লিখেছেন সমান উদ্দীপনায়।

হাসনাত আবদুল হাই-এর জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৭ মে, কলকাতায়। বাবা আবুল ফতেহ। মা আয়েশা সিদ্দিকা। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামে।

হাসনাত আবদুল হাইয়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে—উপন্যাস : সুপ্রভাত ভালোবাসা (১৯৭৭); আমার আততায়ী (১৯৮০). তিমি (১৯৮১), মহাপুরুষ (১৯৮৬) সুলতান (১৯৯১), মোরেলগঞ্জ সংবাদ (১৯৯৫), একজন আরজ আলী (১৯৯৫), নভেরা (১৯৯৫), বাইরে একজন (১৯৯৫), হাসান ইদানিং (১৯৯৫), সোয়ালো (১৯৯৬), ইন্টারভিউ (১৯৯৭), সিকস্তি (১৯৯৭), লড়াকু পটুয়া (২০১০), পানেছার বানুর নকশীকাঁথা (২০১০) হেমিংওয়ের সঙ্গে (২০২০) গল্প: যখন বসন্ত (১৯৭৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮) শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৩), মরচে পড়া স্টেনগান (২০০৮), বৈশাখে ভার্জিনিয়া উলফ (২০১৪)।

কবিতা : কিয়েতো হাইকু; পুলিশ এলে বলব আইডি নেই। ভ্রমণকাহিনী : ট্রাভেলগ (১৯৯২), ট্রাভেলগ/২ (১৯৯৩), সাফারি (১৯৯৪), সানাডু; আন্দালুসিয়া; কলকাতা রানাঘাট (২০১৯)। উন্নয়ন বিষয়ক : Local Level Planning, Below the Line: Rural Poverty in Bangladesh, Dateline Gram Bangla, Integrated Rural Development, পল্লী উন্নয়ন।

মননশীল প্রবন্ধ : সবার জন্য নন্দনতত্ত্ব, জাপানের সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব, শিল্পকলার নান্দনিকতা। স্মৃতিকথা : ‘Aide Memoire—Boyhood in British India and Pakistan 1943 - 1956’, ‘All Those Yesterday—Youth in Pakistan. Amerika and Europe 1996-1965’, ‘From the Horse’s Mouth—A life in Bureaucracy 1965-2000’.

হাসনাত আবদুল হাইয়ের আরও একটি বড় মাপের লেখা হচ্ছে, ‘হ্যাম-বেথ’ (২০২২)। এই নাটকটি তিনি শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ ও ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে রচনা করেছেন। হাসনাত আবদুল হাইয়ের বিশ্বাস, এটি তাঁর সেরা লেখা।

হাসনাত আবদুল হাই, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভ্রমণকাহিনি লেখক। তাঁর প্রতিটি ট্রাভেলগ স্থানের নিখুঁত বর্ণনায় এবং মানুষের অন্তরঙ্গ চরিত্র চিত্রনে হয়ে ওঠে অন্যবদ্য। বিশেষত ‘কলকাতা রানাঘাট’ ভ্রমণগ্রন্থটি। তিনদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বই সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের রচনা। ভ্রমণকাহিনির প্রচলিত ফর্মের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে পঠন-পাঠনের নতুন মাত্রা। বলা যায়, বইটি আমাদের ভ্রমণসাহিত্যে একটি মাইলফলক।

সাম্প্রতিক সময়ে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে, ‘শাহবাগে ব্যালেরিনা’। এখানে আমরা লক্ষ করি, মফস্বলের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে পরী ইউটিউবে দেখে নিজে নিজে যে নাচ শিখে ফেলল তা কেউ দেখে নি কোনো মঞ্চে, বাংলাদেশে। নিকটাত্মীয়া পিএইচডি গবেষণা-ছাত্রী শান্তা গ্রামের বাড়িতে পরীর সেই নাচ দেখে অবাক। তার মনে হলো একটা উচ্ছল-প্রাণ বিহঙ্গ যেন বন্ধন মুক্ত হয়ে দুই ডানা মেলে আকাশে উড়ে যেতে উদ্যত। মুক্তির প্রতীক সেই নাচ অধিকারের দাবিতে অন্দোলনকারী মেয়েদের এক সভায় দেখাতে সে পরীকে নিয়ে গেল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ চত্বরে। বাকিটা ইতিহাস। রাজপথে, উন্মুক্ত আকাশের নিচে, শখ করে শেখা একটি নাচ বদলে দিল পরী নামের মেয়েটির জীবন। সেই সঙ্গে মেয়েদের প্রাণের দাবির আন্দোলনে বয়ে গেল সংকল্পের ঝড়ো হাওয়া। ‘আমরা করব জয়’ আন্তর্জাতিক গানটি অনুরণিত হলো লক্ষ প্রাণে, নাচের ছন্দে ছন্দে। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে ‘পাতালপুরাণ’ এবছর অন্যদিন ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে হাসনাত আবদুল হাইয়ের আরও দুুুটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে, ‘নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিস’। আরেকটি হচ্ছে, ‘হাজার বছরের নির্বাচিত বাংলা কবিতা Selected Bengali Poems of a Thousand YearsÕ

‘নদীপথে, সঙ্গে ইউলিসিস’ বইটি লেখার একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। গত শতকের ষাট দশকে হাসনাত আবদুল হাই উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশ থেকে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘ইউলিসিস’। এটি বিশ্বসাহিত্যের এক বিস্ময়কর কীর্তি। কেউ কেউ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। যাহোক, বইটি হাসনাত আবদুল হাই সঙ্গে আনতে পারেন নি। ডাকবিভাগ বাজেয়াপ্ত করেছিল। এ ঘটনার অনেক বছর পর তিনি বইটি কিনেন নিউমার্কেটের একটি দোকান থেকে। ১৯৯৩ সালে সদরঘাট থেকে রকেট জাহাজ গাজীতে চড়ে তিনি গিয়েছিলেন খুলনায়, সরকারি দায়িত্ব পালন করার জন্য। সেই সময় তিনি প্রথমবার পড়ে শেষ করেন ‘ইউলিসিস’। অতঃপর ঢাকা ফেরার পর তিনি দৈনিক ভোরের কাগজে ‘ট্রাভেলগ’ নামে একটি ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। চারটি কিস্তি লিখেছিলেন। যেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছিল ঢাকা থেকে খুলনায় নৌভ্রমণ, উপন্যাসটি পড়ার অভিজ্ঞতা। বলাই বাহুল্য, লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল।... ২০২২ সাল ছিল ইউলিসিস প্রকাশের শতবর্ষ। তখন হাসনাত আবদুল হাইয়ের মনে পড়ল, সেই পাণ্ডুলিপি সেই ভ্রমণের কথা। সিদ্ধান্ত নিলেন লেখাটি সম্পূর্ণ করার। খুঁজে বের করলেন সেই পাণ্ডুলিপি আর সেটি টাইপ করে ফেললেন মোবাইল ফোনেই। এর মাঝে তিনি দ্বিতীয়বার পড়লেন ‘ইউলিসিস’, ড. গিফোর্ডের অ্যানোটেশন বইয়ের সাহায্য নিয়ে। ফলে এই লেখার সঙ্গে যুক্ত করলেন ইউলিসিসের অধ্যায়ভিত্তিক সারসংক্ষেপ এবং বইটি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন।

অন্যদিকে ‘হাজার বছরের নির্বাচিত বাংলা কবিতা Selected Bengali Poems of a Thousand YearsÕ হচ্ছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের সম্পাদনা ও অনুবাদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এটি বাংলা ভাষার গত হাজার বছরের আদি, মধ্য ও আধুনিক পর্বের কবিতার একটি নির্বাচিত সংকলন। প্রায় সাড়ে আট শত পৃষ্ঠার একটি দ্বিভাষিক গ্রন্থ। এই বইয়ে ঠাঁই পাওয়া কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন স্বয়ং হাসনাত আবদুল হাই। শুধু কবিতার অনুবাদ নয়, বইয়ের মূল ভূমিকা ও প্রত্যেকটি পর্বের স্বতন্ত্র প্রবেশিকাসমূহ থেকে শুরু করে কবিতার টীকা, ভাষ্য ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি সবকিছুরই বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, বাংলা কবিতার এরকম একটি পরিপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বশীল সংকলন এর আগে বাংলাদেশ কেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কি না সন্দেহ।

বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে হাসনাত আবদুল হাই পেয়েছেন বহু পুরস্কার। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮) এবং একুশে পদক (১৯৯৫) উল্লেখযোগ্য। কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২০’ লাভ করেন হাসনাত আবদুল হাই। এছাড়াও পেয়েছেন : জগদীশচন্দ্র বসু পুরস্কার (১৯৯৪), মওলানা আকরম খাঁ পুরস্কার (১৯৯৫), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৫), এস এম সুলতান পুরস্কার (১৯৯৫), শিল্পাচার্য জঃয়নুল পুরস্কার (১৯৯৬) ইত্যাদি।

দীর্ঘ সাহিত্যজীবন তাঁর। অন্যান্য শাখায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য মেনেও বলা যায়, কথাসাহিত্যে হাসনাত আবদুল হাইয়ের কলম স্বচ্ছন্দ, প্রজ্ঞা উদ্ভাসিত। ‘একা এবং একসঙ্গে’ দিয়ে যে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল, ‘সুপ্রভাত ভালোবাসা’, ‘তিমি’, ‘যুবরাজ’, ‘সুলতান’, ‘মোরেলগঞ্জ সংবাদ’, ‘একজন আরজ আলী’, ‘নভেরা’, ‘হাসান ইদানীং’, ‘সিকস্তি’, ‘লড়াকু পটুয়া’র মধ্য দিয়ে আজও সে-যাত্রা অব্যাহত আছে। দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজেই।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক শ্রমজীবী শিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। শব্দের সুতো দিয়ে মানবজীবনের বিচিত্র জাল বুনে যাচ্ছেন। মানুষের আসক্তি আর বাসনা, ক্রোধ আর মূঢ়তা, ভ্রান্তি আর বুদ্ধিনাশ, প্রাপ্তির উল্লাস আর হারানোর আর্তনাদের চিত্র অপূর্ব দক্ষতায় তাঁর কথাসাহিত্যে এঁকে যাচ্ছেন তিনি। তীক্ষè পর্যবেক্ষণ, গভীর নিষ্ঠা এবং সত্য উচ্চারণের অভিজ্ঞান হলো তাঁর সৃষ্ট কর্মগুলো। বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব একটি গদ্যভাষা নির্মাণ করেছেন। তাঁর কথাসাহিত্যে গ্রামজীবন এবং শহরজীবন সকল বৈচিত্র্য নিয়ে উপস্থিত রয়েছে। হাসনাত আবদুল হাই তাঁর সৃজনদক্ষতাকে বিশেষ কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেন নি। মানবজীবনের বহুরৈখিক এবং বৈচিত্রিক দিকের উন্মোচনে তিনি এখনো মগ্ন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে তিনি এমনই মগ্ন থাকুন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

হাসনাত আবদুল হাই, প্রিয় কথাসাহিত্যিক, আপনাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অন্যদিন পরিবারের অভিবাদন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.