সত্যিকারের নায়ক

সত্যিকারের নায়ক

প্রয়াত চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের ৭১তম জন্মবার্ষিকী ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর। এই উপলক্ষে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন।

চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল। ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, ঢাকাতে। তার বড়ভাই প্রথিতযশা সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ ও বোন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। দুজনই জাফর ইকবালের মতো মেঘের ওপর বাসা বেঁধেছেন।

অপার সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন জাফর ইকবাল। রাজ্জাকের ইমেজকে ভাঙার ক্ষমতা তার ছিল কিন্তু সেই ক্ষমতার তিনি সদ্ব্যবহার করেন নি।

খান আতাউর রহমান প্রযোজিত ‘আপন পর’(১৯৭০) ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে তার অভিষেক। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ অবলম্বনে, যদিও তার স্বীকৃতি ছিল না। দুই ভাইয়ের এই কাহিনিতে বড়ভাই সেজেছিলেন খান আতা স্বয়ং। বলাই বাহুল্য, ছোটভাইয়ের চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন জাফর ইকবাল। তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন কবরী। প্রথম ছবিতে আহামরি কোনো অভিনয় করেন নি জাফর ইকবাল। তবে তার মধ্যে যে প্রোজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা দর্শক-সমালোচকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভালোভাবেই।

মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তের নায়ক ছিলেন জাফর ইকবাল। নাগরিক ইমেজেই তিনি ছিলেন বেশি মানানসই। এ ধরনের চরিত্রেই তার স্টাইলিস্ট ভাবমূর্তিটি মূর্ত হয়ে উঠত ভালোভাবে। যদিও গ্রামীণ চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন এবং কয়েকটি ছবি জনপ্রিয়ও হয়েছিল।

জাফর ইকবাল অভিনীত স্মরণীয় চরিত্র বেশি নয়। ‘মাস্তান’-এর যন্ত্রণাকাতর যুবক, ‘সূর্যগ্রহণ’-এর আবেগতাড়িত প্রেমিক, ‘নয়নের আলো’-র গায়েনÑচরিত্র ত্রয়ী প্রবীণ দর্শকদের স্মৃতিতে এখনো প্রোজ্জ্বল। জাফর ইকবাল অভিনীত উল্লেখযোগ্য অন্য ছবিগুলো হচ্ছে: ফকির মজনু শাহ, অংশীদার, যোগাযোগ, গৃহলক্ষ্মী, অবুঝ হৃদয়, বেদ্বীন, আশীর্বাদ...।

শুরুতে জাফর ইকবাল অভিনয় করেছিলেন কবরী ও শাবানার বিপরীতে। কিন্তু তাদের সঙ্গে তিনি মানানসই ছিলেন না। পরে তিনি ববিতার সঙ্গে জুটি গড়েন। এই জুটি প্রথম দিকে আলোচিতও হয় কিন্তু পরে নানা কারণে ভেঙে যায়। শেষ জীবনে ববিতার ছোট বোন চম্পার সঙ্গেও জাফরের রোমান্টিক জুটি গড়ে উঠেছিল। জাফরের অন্য নাযিকারা হলেন অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনা, রানী, দোয়েল...।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নাগরিক ইমেজে জাফর ইকবাল ছিলেন বেশি মানানসই। তবে অতি নাগরিকতা ও কৃত্রিম আচরণের কারণে এক সময়ে দর্শকরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। আসলে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রসর। তাই এদেশের সামাজিক বাস্তবতায় তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেই। অবশ্য পরে তিনি প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন এবং সফল হন। কিন্তু মৃত্যু এসে তাকে বড়ো অসময়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

জাফর ইকবালের ইতিবাচক দিক ছিল: উচ্চতা, ফিগার, চেহারা, ফ্যাশন সচেতনতা, স্মার্টনেস। তার দেহের গড়ন এমন ছিল যে শেষ জীবনেও বয়সের কোনো ছাপ ছিল না। এ জন্য জাফর যে-কোনো বয়সের নায়িকার সঙ্গে মানিয়ে যেতেন। তার নেতিবাচক দিক ছিল: কেরিয়ারের ব্যাপারে অমনোযোগিতা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার চেয়ে আবেগ দ্বারা চালিত হওয়া।

কেরিয়ারের চেয়ে ববিতার প্রতি তার গভীর ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দেওয়ায় এক সময় জাফর ইকবাল দলছুট হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েন (যদিও পতিত অবস্থা থেকে উত্থানের চেষ্টা করেন এবং সাফলের দিকে অগ্রসরও হচ্ছিলেন)। পরে অবশ্য মডেল কন্যা সোনিয়াকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ‘সুখ’ নামক অধরা পাখি কিছুতেই তার হাতের মুঠোয় ধরা দেয় নি।

কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও জাফর ইকবালের সুপরিচিতি রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই তার কেরিয়ারের শুরু। গিটার বাজিয়ে, গান গেয়ে মানুষের হৃদয় জয় করাই ছিল তার স্বপ্ন। ১৯৬৬ সালে ‘রোলিং স্টোন’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন। অর্থের বিনিময়ে শাহবাগের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে সংগীত পরিবেশন করতেন। পরে তিনি প্লেব্যাকের দিতে ঝুঁকে পড়েন। চলচ্চিত্রের নেপথ্যে তিনি প্রথম কণ্ঠ দেন ‘বদনাম’ ছবিতে, বড়ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে। গানটি ছিল ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও/ আমি তো এখন নই কারও’। গানটির সঙ্গে ছবিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন রাজ্জাক। তার জনপ্রিয় আরও কয়েকটি গান হলো, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘বিদেশ থেকে দেশে এলে সাত গাঁয়ের সোনার ছেলে’, ‘তুমি আমার জীবন...’।

জাফর ইকবালের শেষ জীবন ছিল খুবই করুণ। পারিবারিক অশান্তিতে জর্জরিত তিনি শান্তির জন্য মদকে আশ্রয় করেছিলেন। ধূমপানের নেশাও ছিল। ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এক সময় হার্ট ও কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। তাই ১৯৯২ সালে ৮ জানুয়ারি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে তার।

জাফর ইকবালের অন্তিম সময়ে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম তার পাশে ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নায়কের মতোই মৃত্যু হয়েছে জাফরের। চক্ষু বোজার আগে তিনি চাষীর কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধূমপান করেছিলেন। তার মধ্যে কোনো মৃত্যুভীতি ছিল না।  

Leave a Reply

Your identity will not be published.