‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৩ সালে। প্রয়াত সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন সি বি জামান। এই ছবিটি একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো এই যে, কিশোর অপরাধ নিয়ে এ দেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত নির্মিত একমাত্র কাহিনিচিত্র এটি।
ছবিটির একটি বিরাট অংশের শুটিং হয়েছিল টঙ্গির তৎকালীন কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট এবং কৈশোরের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সঙ্গে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটের তুলনামূলক বিচারে আজও ছবিটিকে কারও কারও কাছে সমসাময়িক বলে মনে হতে পারে। ছবিটি ১৯৮৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মানদণ্ডে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছিল। সৈয়দ শামসুল হক শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। উল্লেখ্য, ছবিটি সেই সময়ে ভারতের ‘গোয়া চলচ্চিত্র উৎসব’, ‘দিল্লি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ এবং রাশিয়ার ‘তাসখান্দ চলচ্চিত্র উৎসব’-এ প্রদর্শন করা হয়।...এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উল্লেখযোগ্য এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের গল্প এখানে তুলে ধরা হলো ‘পুরস্কার’ ছবির পরিচালক সি বি জামান।
আসামের গৌরিপুরে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি সিলেটের হবিগঞ্জে বড় হয়েছেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরের চিত্রপুরীতে পরিচালক এস এ বোখারীর সহকারী হিসেবে যুক্ত হন। কাজ করেন ‘গুনাহগার’, ‘পাগড়ি সামাল জাতকা’ এবং ‘দিলাম দে সওদে’ ছবিতে। ১৯৬৮ সালে জামান সম্পৃক্ত হন প্রয়াত খান আতাউর রহমানের ইউনিটে। তারই প্রযোজনায় ‘ঝড়ের পাখি’র মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮১ সালে তাকে একটি ছবি পরিচালনার অফার দেন সংগীত পরিচালক-প্রযোজক সত্য সাহা। তখন তিনি খান আতাউর রহমানের ইউনিট থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র পরিচালনা করতে থাকেন। এই পর্যায়ে তার প্রথম ছবি ছিল ‘উজান ভাটি’। প্রযোজক, বলাই বাহুল্য, সত্য সহা। ‘উজান ভাটি’ ছবিটি ব্যবসাসফল হয়। তখন সত্য সাহার মাথায় একটি আইডিয়া আসে। তিনি ভাবেন কিশোর অপরাধীদের নিয়ে ছবি করবেন আর ছবিটি পরিচালনা করবেন সি বি জামান। কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনার ভার পড়ে সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাঁধে। আর ছবিটির সিংহভাগ যেহেতু ক্যামেরায় ধারণ করা হবে টঙ্গিস্থ কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে সেহেতু সেখানে বহুবার যান সৈয়দ হক, সত্য সাহা এবং সি বি জামান। মাসের পর মাস, দিনের পর দিন সেখানে কাটান এই তিন জন। কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন কীভাবে কিশোর অপরাধীরা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, পড়াশোনা করছে, নানা হাতের কাজ শিখছে—যেন এখান থেকে বেরিয়ে সম্মানজনকভাবে জীবন কাটাতে পারে। এভাবে কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠান থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করার পর ‘পুরস্কার’-এর গল্পটি তৈরি করেন সৈয়দ শামসুল হক। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি পরিচালক সি বি জামান এবং প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক সত্য সাহার নানা পরামর্শও গ্রহণ করেন। ফলে বড়পর্দায় মূর্ত হয়ে ওঠে এই গল্পটি— বাপ-মা হারা কিশোর ছেলে রতন। নিঃসন্তান মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে। মামি রতনকে দেখতে পারেন না। খেতে দেন না। বকাঝকা করেন। ঘটনাচক্রে পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে যে, রতন সিদ্ধান্ত নেয় সে মামার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তখন সেই বাড়িতে সদ্য উপস্থিত হয়েছেন মামির বড়ভাই গোফরান এবং তার কিশোর ছেলে লাল মিয়া। সেদিন রাতে চাবি চুরি করে আলমারি থেকে নিজের মায়ের গলার হার এবং কানের দুল নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে রতন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন গোফরান। তিনিই রতনকে প্রথমে থানা এবং পরে কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। বিচারক রতনকে দুই বছরের সাজা দেয়। সেখানে কিশোর অপরাধীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে রতনের। শুধু বাদশা নামে এক কিশোরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাদশা বেশ দুষ্টু প্রকৃতির। সিনেমার টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করা, অন্যের পকেট কাটাসহ নানা অপকর্মে সে সিদ্ধহস্ত। সে মিথ্যা কথা বলে রতনকে শাস্তি ভোগ করায়।...রওশন নামে এক শিক্ষয়িত্রী অবশ্য বেশ স্নেহ করেন রতনকে। তার প্রত্যাশা রতন এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি হাতের কাজ শিখবে, ব্যায়াম করবে, খেলাধুলা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। রওশন ম্যাডামকে আবার দেখতে পারেন না ডেপুটি সুপার। তাকে নানাভাবে হেনস্থা করে এবং ভূতের ভয় দেখিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করে রতন। ডেপুটি সুপারের জায়গায় আসেন আরেকজন— মাসুদ আহমেদ। তিনি রতনের কারসাজিতে বৈদ্যুতিক অভিঘাতে আহত হন। তিনি অবশ্য রতনকে কোনো শাস্তি দেন না। রতন তার ভুল বুঝতে পারে এবং মাসুদ আহমেদের অনুগত হয়ে পড়ে। মাসুদের উদ্যোগে আয়োজিত দৌড় প্রতিযোগিতায় রতনের কাছে হেরে যায় বাদশা। এতে রতনের প্রতি আরও বিরূপ হয়ে ওঠে সে। ওর কারসাজিতেই সিরাজউদ্দৌলার নাট্যাভিনয় পণ্ড হয়ে যায়। কেননা রতন সিরাজ আর সে গোলাম হোসেন— এই বাদশার পছন্দ হয় নি। মাসুদ আহমেদের নির্দেশে সবাই বাদশাকে বয়কট করে। কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না।...ছেলেদের নিয়ে পিকনিকে যান মাসুদ আহমেদ। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে বাদশা এবং তাকে ধরে নিয়ে থানায় দিয়ে আসে রতন। ওয়ার্কশপের দুটি মোটর সাইকেল ঠিক করার দায়িত্ব পড়ে বাদশা ও রতরেন ওপর। সেখানে একটি সাইকেলের একটি প্রয়োজনীয় বস্তু সরিয়ে ফেলে বাদশা। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই সাইকেলটি ট্রায়াল দেওয়ার দায়িত্ব পায় বাদশা। কিছুদূর চলার পর সাইকেলটি ব্রেক ফেল করে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয় রতন। তার একটি পা কাটা যায়। সরকারের সহযোগিতায় রতনকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেন মাসুদ আহমেদ এবং সুপার। বিমান বন্দরে রতনকে বিদায় দেওয়ার সময় নিজের অপরাধ স্বীকার করে বাদশা। সব শুনেও বাদশাকে ক্ষমা করে দেয় রতন। বলে, ‘পা হারিয়েছি। বন্ধু পেয়েছি। আমার পা গেছে, তুই তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস। তুই এখন ভালো হয়ে গেছিস। এই আমার পুরস্কার।’
রওশন ম্যাডাম, মাসুদ আহমেদ এবং বাদশা হাত নেড়ে বিদায় জানায়। রতনকে নিয়ে বিমানটি আকাশে উড়ে যায়।
ছবিটির প্রধান চরিত্রসমূহে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ (মাসুদ আহমেদ), জয়শ্রী কবির (রওশন ম্যাডাম), মাস্টার শাকিল (বাদশা), মাস্টার সুমন (রতন) প্রমুখ। এ ছাড়া আরও অভিনয় করেছেন ইনাম আহমেদ, শওকত আকবর, এটিএম শামসুজ্জামান, আনিস, সাইফুদ্দিন, বাবর, সুষমা সরকারসহ আরও কয়েকজন। উল্লেখ্য, কিশোর অপরাধীদের চরিত্রে মাস্টার শাকিল ও মাস্টার সুমন ছাড়াও সত্যিকারের কিশোর অপরাধীরা অভিনয় করেছিল।
মাসুদ আহমেদ ও রওশন ম্যাডাম—এই দুটি চরিত্রে অবশ্য পরিচালকের ফার্স্ট চয়েজ ছিলেন যথাক্রমে রাজ্জাক ও ববিতা। কিন্তু তাদের সিডিউল পাওয়া যায় নি বলে বুলবুল ও জয়শ্রীকে সিলেক্ট করা হয়। ‘পুরস্কার’-এর অধিকাংশ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে গাজীপুরস্থ তৎকালীন কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে। কিছু আউটডোর শুটিং হয়েছে বাইরে—ন্যাশনাল পার্কের আশপাশে এবং ঢাকার কয়েকটি জায়গায়।
ছবিটির শুটিংয়ের সময় নানা ঘটনা ঘটেছে। যেমন একদিন এক কিশোর অপরাধী পরিচালক সি বি জামানের সহকারী শিল্পী চক্রবর্তীর সঙ্গে গল্প করছিল—সে কী জন্য ওই কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে এসেছে। কেননা সে একজনের পকেট কাটতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। কিশোরটির কথা শুনে শিল্পী চক্রবর্তী তখন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তুমি তাহলে আমার মানিব্যাগটা হাতিয়ে দেখাও তো।’ এরপর কাজে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন শিল্পী চক্রবর্তী। আধঘণ্টা পরে হঠাৎ সেই কিশোরটি চক্রবর্তীর দিকে চেয়ে বলে উঠেছিল, ‘আঙ্কেল, দেখুন তো আপনার ব্যাগটা পকেটে আছে কি না।’
পিকনিকের দৃশ্য ধারণ করতে ন্যাশনাল পার্কের অদূরে গিয়েছিল ইউনিট। সঙ্গে গিয়েছিল চল্লিশ-পঞ্চাশজন কিশোর অপরাধী। তাদের শুরুতে যেতে দিতে চান নি কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানের সুপার। তার আশঙ্কা ছিল, দু’একজন এই সুযোগে পালিয়ে যাবে। পরিচালক সি বি জামান তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, এমনটি হবে না। সত্যিই তাই হয়েছিল। শুটিংয়ের সময় পালানোর যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেইসব কিশোর অপরাধী সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নি।
মোটর সাইকেল ট্রায়াল দেওয়ার দৃশ্যে অভিনয় করেছিল মাস্টার শাকিল (বাদশা) এবং মাস্টার সুমন (রতন)। দৃশ্যের চাহিদা অনুযায়ী এক পর্যায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাকিলকে বাঁচায় সুমন। কেননা শাকিলের মোটর সাইকেলের ব্রেক ফেল করেছিল। এই দৃশ্য গ্রহণের সময় কোনো ডামি ব্যবহার করা হয় নি।
শাকিল ও সুমন দুজনই যথাযথভাবে বড়পর্দায় নিজেদের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে বাদশার ভূমিকায় শাকিল অনবদ্য। বিশেষত মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার পর যখন তার অভিনীত চরিত্রটি আত্মগ্লানিতে ভোগে—সেইসব দৃশ্যে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন শাকিল। এই কাজের স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
ছবির আরও দুটি প্রধান চরিত্র হলো মাসুদ আহমেদ ও রওশন ম্যাডাম। এই দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবির। বুলবুল চরিত্রানুগ অভিনয় করেছেন। কিন্তু জয়শ্রী কবিরের অভিনয় একপর্যায়ে ছিল বেশ ত্রুটিপূর্ণ। সঠিক অভিব্যক্তি ছিল না, ডাবিংয়ের সময় জড়ানো কণ্ঠে সংলাপ বলেছেন। বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে দর্শকদের চোখে। এ প্রসঙ্গে একজন স্বনামধন্য মানুষের কথা বলা যায়। তিনি খান আতাউর রহমান। অভিনেতা, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, প্রযোজক এবং পরিচালক। ১৯৮৩ সালে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডস্থ তৎকালীন ফিল্ম আর্কাইভে অনুষ্ঠিত ‘পুরস্কার’-এর প্রিমিয়ার শো’র শেষে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে পরিচালক সি বি জামানের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তুমি জয়শ্রীকে চড় মারো নি কেন? তোমার ছবির ব্ল্যাক স্পট হিসেবে বিবেচিত হবে ওর অভিনয়।’ আসলে জয়শ্রীর মতো তারকা অভিনেত্রীকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি, তার কাছ থেকে নিজের মনের মতো অভিনয় আদায় করতে পারেন নি পরিচালক সি বি জামান। যেমন গোফরান রূপী এটিএম শামসুজ্জামান ওভার অ্যাকটিং করেছেন। তাকেও সঠিক ট্রাকে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন সি বি জামান। এটিএমকে তাঁর ম্যানারিজম থেকে মুক্ত করতে পারেন নি। তবে সাইফুদ্দিনের অভিনয়ে সন্তুষ্ট সি বি জামান। সাইফুদ্দিন অভিনয় করেছেন বাদশার বাবার ভূমিকায়। তার চরিত্রে কৌতুকের লেশমাত্র ছিল না। তারপরও সাইফুদ্দিনের অভিনয় গুণে দর্শক হেসেছে, উপভোগ করেছে। উল্লেখ্য, এ ছবিতে অপেশাদার অভিনেতার সংখ্যাই বেশি—যারা ছিল কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠানের কিশোর অপরাধী। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের কিশোর আদালতের বিচারকও এ ছবিতে অভিনয় করেছেন, নিজের ভূমিকায়।
পুরস্কার ছবিতে রয়েছে কয়েকটি গান। গানগুলো হলোÑ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান/ সত্যসুন্দর বিজয় নিশান’, ‘হারজিৎ চিরদিন থাকবে/তবুও এগিয়ে যেতে হবে’, ‘আজ কোনো কাজ নেই, আজ আমাদের ছুটি’। সবগুলো গান লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং সুরকার সত্য সাহা। প্রতিটি গান যথার্থ সিচুয়েশনে প্রয়োগ করা হয়েছে। আরোপিত মনে হয় নি। কণ্ঠ দিয়েছেন আবিদা সুলতানা ও অন্যরা।
ছবিটি নির্মাণে মোট ১৬ লাখ টাকা লেগেছিল। কিন্তু ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। হলগুলো থেকে সাকুল্যে ২ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। শিশু একাডেমি ছবিটির একটি ষোল মিলিমিটার প্রিন্ট নিয়েছিল, তারা দিয়েছিল কিছু টাকা; কিছু টাকা পাওয়া গিয়েছিল জাপানের এনএইচকে টিভি থেকে এবং তাসখান্দ চলচ্চিত্র উৎসবের কর্তৃপক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা প্রযোজক সত্য সাহা পেয়েছিলেন। অথচ ছবিটির প্রচার-প্রচারণা কিন্তু মন্দ হয় নি। ঢাকার স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ক্লাস রুটিন বিতরণ করা হয়েছিল—সেখানে উল্লেখ করা ছিল ‘পুরস্কার’-এর মুক্তির কথা। টিশার্টও বিতরণ করা হয়েছিল। পোস্টার-ব্যানারের মাধ্যমেও যথেষ্ট প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, শিশুতোষ চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার কারণে সত্য সাহা লোকসান মেনে নিয়েছিলেন। তাছাড়া কাকরাইলের রাজিয়া প্রেক্ষাগৃহের মালিককে টাকা দিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ছবিটি চালিয়েছিলেন। কিন্তু দর্শক আকৃষ্ট করা যায় নি।
দু’ একজন সমালোচক অবশ্য সেই সময়ে ছবিটির প্রশংসা করেছিলেন। যেমন নিউ নেশন পত্রিকায় শিহাব সরকার লিখেছিলেন, ‘ছবিটি দেখে মনে হলো, পরিচালক চলচ্চিত্রের ভাষা জানেন।’... ছবিটি দেখে নটরডেম কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মন্তব্য করেছিলেন, ‘ছবিটি যদিও কিশোরদের জন্য বানানো হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হয় এদেশের অভিভাবকদেরও দেখা উচিত’। স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতা রাশেদ খান মেনন অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, ‘সরকারের উচিত ছবিটিকে প্রমোদ কর মুক্ত করা’—যদিও তা কার্যকর করা হয় নি। তবে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলে প্রযোজক ও পরিচালকের হতাশা কিছুটা কেটেছিল। তাই তো অনুপ্রাণিত হয়ে প্রযোজক সত্য সাহা আরেকটি ভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র ‘রাম রহিম জন’ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন।
চিত্রনাট্য থেকে
দৃশ্য-১১
৯ নম্বর দৃশ্যের অনুক্রম।
বাদশা মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে এখন একটা নাট ভালো করে টাইট দিতে দিতে বলে, বাচ্চুকে।
বাদশা: রতনের জেল তো দুই বছরের। আমার দুই দিনও লাগব না। এমুন টাইট দিমু না হালারে, তখন চিনব বাদশারে। আমারে ঘুষি দিয়া খুন বাইর করা? হেঃ, আমার নাম বাদশা। গুলিস্তানের মোড়ে গিয়া কোনো সম খুঁছ করিস—সিনেমার টিকিট বেলাক, পকেট মাইর, আমার উপর দিয়া আইজতক কেউ যাইতে পারে নাই। আরে, দুইবার তো এই জেল থিকাই ভাগলাম।
সেই ছেলেটা বিড়ি নিয়ে ফিরে আসে। বাদশা বিড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক দেখে ধরায়।
বাচ্চু: তুমি কলাম, ওস্তাদ, বিনা খামাখা এইখানে পইড়া আছ। চলো না, এইবার দুইজনে ভাগি।
বাদশা: আরে না, অহন না। এইখানে খাওনদাওন ভালা, কয়টা দিন স্বাইস্থ্যটারে বানাইয়া লই।
বাচ্চু: আর রতনরেও একটু হাতের সুখ কইরা বানাও দেহি বাদশা ভাই।
দৃশ্য-১২
দোতলার করিডরে সিঁড়ি বরাবর ক্যামেরা। আমরা দেখতে পাই ফ্রেমের বেস লাইন থেকে উঠে এলেন ডেপুটি সুপার, বেত হাতে সহকারী মাহমুদ সাহেব, আর পেছনেই রতন ও ওয়ার্ডার। ওয়ার্ডারের হাতে খাকি জামা ও হাফপ্যান্ট।
লম্বা করিডর। সার সার রুম। দরজা খোলা সব রুমের। ভেতরে বিছানাগুলো পাতা, একের পর এক, একেক রুমে তিনজন করে। কিন্তু এখন এর কোনো রুমেই কেউ নেই।
হাঁটতে হাঁটতে একটা রুমের সমুখে দাঁড়িয়ে বেত হাতে সহকারী মাহমুদ ডেপুটি সুপারকে বলেন।
মাহমুদ: এই রুমে সিট খালি আছে, স্যার।
ডেপুটি: এখানেই তাহলে দিয়ে দিন।
ডেপুটির ইশারা পেয়ে ওয়ার্ডার রতনকে ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। বলতে বলতে,
ওয়ার্ডার: চলো ভিতরে। এই জামা-প্যান্ট। পইরা লও। এইখানে খাকি পরতে হয়।
ওয়ার্ডার ও রতন ভেতরে চলে যায়।
ডেপুটি সুপার মাহমুদকে জিগ্যেস করেন,
ডেপুটি: এ রুমে আর কে যেন থাকে, মাহমুদ সাহেব?
মাহমুদ: কেন, বাবুল। সেই যে স্যার, বড়লোকের ছেলে। বাপ ড্রিংক করত, দেখাদেখি বাপের বোতল থেকে নিজেও—এয়ারপোর্টে এক ফরেনার সাহেবের ব্রিফকেস চুরি করে ধরা পড়েছিল।
ডেপুটি: ও, বাবুল। অথচ চেহারা দেখে বুঝবার উপায়টি নেই। বাপরে বাপ। এই বিচ্ছু ক্রিমিনালদের হাত থেকে আল্লা কবে যে আমাকে রেহাই দেবে। কী পাপ করেছিলাম—
বলতে বলতে দেখা যায় ওয়ার্ডার আগেই বেরিয়ে এসেছে, এরা এখন রুমের ভেতরে ঢোকে।
দৃশ্য-১৩
রুমের ভেতর। রতনকে দেখা যায় খাকি জামা-প্যান্ট হাতে নিয়ে খালি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানার ওপর চাদর, মশারি রাখা।
ডেপুটি ও মাহমুদ ভেতরে আসেন। ডেপুটি আগের শটের জের ধরে বলতে বলতে আসেন।
ডেপুটি: এই, এই আরেকজন। এটার তো আবার মেরে মাথা ফাটাবার ধাত।
সঙ্গে সঙ্গে বেত নাচিয়ে মাহমুদ বলে রতনকে,
মাহমুদ: এটা কিন্তু তোমার মামাবাড়ি নয়, বুঝলে? এটা জেলখানা। দেখে মনে হয় না, না? পাঁচিল নিচু- লোহার মোটা মোটা গরাদ নেই—বন্দুক হাতে পুলিশ পাহারা নেই—
শেষ কথাগুলো রতনের ওপর ওভারল্যাপ হয়। রতনের অভিব্যক্তি যেন স্থির কঠোর।
ডেপুটি সুপার লক্ষ করে আঁতকে উঠে বলেন,
ডেপুটি: কী-একটা ফন্দি আঁটছে যেন। মনে হচ্ছে না, মাহমুদ সাহেব? এই, এখানে কোনোরকম বদ মতলব করলে—
মাহমুদ: দু’ঘা।
ডেপুটি: শয়তানি করলে।
মাহমুদ: দু’ঘা।
ডেপুটি: মারামারি করলে।
মাহমুদ: দু’ঘা।
ডেপুটি: পালাবার চেষ্টা করলে।
মাহমুদ: দু’ঘা। এখুনি লাগিয়ে দিই, স্যার? ভূমিকাটা হয়ে থাক। দিই? স্যার? বলে বেত তোলে রতনের দিকে।
রতন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। সপাং করে তার পিঠে বেত পড়ে। একবার সে হাত তুলে বেতটা কেড়ে নিতে গিয়েও থমকে যায়।
নিঃশব্দ হাসে মাহমুদ। ডেপুটির দিকে তাকিয়ে বলে,
মাহমুদ: টের পাচ্ছে, স্যার।
তারপর রতনের দিকে ফিরে মাহমুদ হিংস্র গলায় বলে,
মাহমুদ: খবরদার। যাও, প্যান্ট-শার্ট পরে নাও।
বলে বেতের খোঁচায় জামা-প্যান্ট দেখিয়ে ডেপুটির সঙ্গে বেরিয়ে যায়। রতনের ওপর শট। দরজা বন্ধ হবার শব্দ হয়। এবং রতনের মুখের ওপর থেকে আলো কমে যায়। রতন কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে জামাকাপড় মুঠো করে ধরে, মোচড়াতে থাকে নিজের অজান্তে কাপড়গুলো। তারপর হঠাৎ জামাটা চোখের সমুখে মেলে ধরে। দ্যাখে। অন্যদিকে তাকায়। দরজা বন্ধ। আরেক দিকে তাকায়। লোহার গ্রিল। ওপরে তাকায়। ঘুলঘুলিতে বোর্ড মেরে আটকানো। রতন আবার জামাটা দ্যাখে। তারপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে।
রতন: না, আমি এখানে থাকব না।
Leave a Reply
Your identity will not be published.