মাসরুর আরেফিনের কথাসাহিত্য: একটি ব্যবচ্ছেদ

মাসরুর আরেফিনের কথাসাহিত্য: একটি ব্যবচ্ছেদ

মাসরুর আরেফিন— সাম্প্রতিক সময়ের অত্যন্ত দীপ্তি ছড়ানো কথাসাহিত্যিক, কবি ও অনুবাদক।

গত শতকের নব্বই দশকে ছাত্রাবস্থায় তাঁর লেখালেখির সূচনা। মৌলিক লেখার পাশাপাশি সেই সময়ে অনুবাদও করেছেন প্রচুর। তখন বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হয়।

২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ঈশ্বরদী, মেয়র এবং মিউলের গল্প’। দীর্ঘ কবিতার এই সংকলনে নিরীক্ষার ছাপ রয়েছে। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ (২০২০) এবং ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে’ (২০২১)। তাঁর কবিতা ভিন্ন ধরনের। ভাষা ও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র।

এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে মাসরুর আরেফিনের তিনটি উপন্যাস। এগুলো হলো, আগস্ট আবছায়া (২০১৯), আলথুসার (২০২০), আন্ডারগ্রাউন্ড (২০২১)। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস হলো ‘আগস্ট আবছায়া’। উত্তম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে এক অবসেসড পুরুষকে কেন্দ্র করে, যিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ান। তিনি অবসেসড নানা বিষয় নিয়ে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডটি মানতে পারেন নি। প্রতি বছর আগস্ট মাস এলেই তিনি দিশেহারা হয়ে যান। একবার ১৫ আগস্টের দিনে তার মধ্যে ঘটে পরাবাস্তববাদী রূপান্তর। তিনি তখন সময় ও বাস্তবতার সব শৃঙ্খল ভেঙে চলে যান ১৯৭৫ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ আগস্টে। নিজের চোখে দেখেন এবং বিবরণ দেন কীভাবে ফারুক-রশিদ-ডালিম-মোশতাক গং ১৫ আগস্টের পটভূমি তৈরি করছে। কতটা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে। তিনি দেখেন প্রত্যেকটি মৃত্যুর ঘটনা।...উপন্যাসটি মানবজীবন থেকে প্রলম্বিত হয়ে সৃষ্টির রহস্য, এর আদি-অন্তের দিকে ছড়িয়ে গেছে, জন্ম আর বেঁচে থাকার অর্থবহ এবং অর্থহীন প্রবহমানতাকে স্পর্শ করেছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে উপন্যাসটির অংশবিশেষ ‘অন্যদিন ঈদসংখ্যা’য় মুদ্রিত হয়। বিষয়টি লেখক তাঁর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন।

অনুবাদেও মাসরুর আরেফিন সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এর প্রমাণ হলো তাঁর দুটি গ্রন্থ ফ্রানৎস কাফকা গল্প সমগ্র (২০১৩), ইলিয়াড (২০১৫)।

মাসরুর আরেফিনের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর অধিকাংশ লেখায়ই ক্ষমতা ও রাজনীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। এই দুটি বিষয়ের বিচিত্র রূপ এবং বহুমাত্রিকতা নানাভাবে চিত্রায়িত করেছেন তিনি। মানবজীবনের কসমিক অবিভাজ্যতাও মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যে। প্রকৃতি তাঁর সাহিত্যে একটি চরিত্র। নানাভাবে এর প্রকাশ ঘটেছে। সময় মাসরুর আরেফিনের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপাদান। নানাভাবে তিনি খেলেছেন সময়কে নিয়ে। ভেঙেছেনও।

৯ অক্টোবর ছিল মাসরুর আরেফিনের ৫২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশ বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একটি ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ‘তাঁর কথাসাহিত্য, তাঁর চিন্তার ভুবর’ শিরোনামের এই আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন স্বনামধন্য লেখক হাসনাত আবদুল হাই। বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে মাসরুর আরেফিনের লেখা কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। পরে মাসরুরের কথাসাহিত্যের ওপর আলো ফেলেন নানাজন। তাদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ নুরুল হুদা, মঈনুল আহসান সাবের, মশিউল আলম, রাজু আলাউদ্দিন, আখতার কামাল, ড. ফখরুল আলম, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী এবং খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।

প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মাসরুর আরেফিন জানান, জনকল্যাণমুখী সাহিত্য তিনি রচনা করেন না। অন্যকথায়, তাঁর সাহিত্যে মানবতার জয়গান নেই। বাস্তবতার বাস্তবকেই তিনি সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি মনে করেন, বাস্তব জীবনে নৈতিক সুবিচার বলে কিছু নেই। তিনি আসলে হাঁটছেন নিজের পথে। ‘লিরিক্যালি গদ্য’ও তিনি লিখতে চান না। চান না লক্ষ লক্ষ পাঠকও। অল্প সংখ্যক পাঠকও যদি তাঁর লেখা পড়ে, বুঝতে পারে, তাহলেই তিনি খুশি।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন লেখক-সাংবাদিক মাহবুব আজীজ।

Leave a Reply

Your identity will not be published.