আহমদ ছফা চলতি স্রোতবিরোধী এক লেখক

আহমদ ছফা  চলতি স্রোতবিরোধী এক লেখক

প্রথাবিরোধী লেখক আহমদ ছফা প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিক অনুবাদকও মহাকবি গ্যেটেরফাউস্ট অনুবাদ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ তাঁর লেখায় আমাদের সমাজ জীবনের চিত্র, নানা অসঙ্গতি মূর্ত হয়ে উঠেছে এখানে তুলে ধরা হলো বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা সাহিত্যিক আহমদ ছফা-এর জীবন š§ভূমিকে

আলোকচিত্রশিল্পী বিশ্বজি সরকার আমি যখন গিয়ে চন্দনাইশ স্টেশনে নামলাম তখন বৃষ্টি পড়ছে আকাশ ভরা মেঘ মানে মাঝখানে যে বৃষ্টি থামতে পারে তার কোনো লক্ষণ নেই তারপরেও আমাদের বসে থাকার উপায় নেই আমাদের যেতে হবে আরও বহুদূর চন্দনাইশ থানার গাছবাড়িয়া গ্রাম কতদূরে তা আমরা জানি না

তারপরও উত্তর গাছবাড়িয়া, দক্ষিণ গাছবাড়িয়া আলাদা অঞ্চল রয়েছে আমরা উত্তর-দক্ষিণ জানি না জানি খ্যাতিমান সাহিত্যিক আহমদ ছফার বাড়ি গাছবাড়িয়া গ্রামে আমরা সেখানে যাব

বৃষ্টির ভেতরেই স্টেশনে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আমরা দোকানদারকে আহমদ ছফার বাড়ি যাবার কথা জানালাম তিনি একটা রিকশাকে তার আঞ্চলিক ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন মূল জায়গাটা আমাদের নিয়ে রিকশা পিচঢালা সড়ক থেকে ইটের রাস্তা, সব শেষে মাটির রাস্তায় পড়ল বৃষ্টি ঝরছে এর মধ্যে আমরা চলছি আহমদ ছফার বাড়ির উদ্দেশে মাঠের ভেতর দিয়ে তৈরি সড়ক বোঝ যায় বয়স বেশি না রিকশাও এখানে বেশিদিন চলে না শহর থেকেও এই দূর গাঁয়ে জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সনের ৩০ জুন খুবই সংগ্রামী মেধাবী লেখক ছিলেন আহমদ ছফা ছিলেন প্রচণ্ড একরোখাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন বাংলা ভাষার পণ্ডিত আহমদ শরীফের সঙ্গে অবনিবনা হবার কারণে তিনি বাংলা বিভাগ ছেড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান

চট্টগ্রামের গহিন গ্রাম চন্দনাইশ থানার গাছবাড়িয়াতে জন্মগ্রহণ করে আহমদ ছফা এসেছিলেন ঢাকায়, সাহিত্যচর্চা পড়াশুনা করতে বেশভূষা থেকে আচার ব্যবহারে আহমদ ছফাকে সবাই চিনত এক ধরনের পাগলামি জুড়ে ছিল তাঁর ভেতর বাহির লেখকদের যে পাগলামি থাকে তারটা ছিল সবচে আলাদা আহমদ ছফার তরুণ বয়সে তাঁর ঘোরাঘুরির এলাকা ছিল চাঁনখার পুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবধি

জটাজুট আহমদ ছফা ঘুরে বেড়াতেন তার কাঁধে থাকত একটা টিয়া এই স্বভাবজাত পোশাকে তিনি অঞ্চলময় ঘুরে বেড়াতেন আহমদ ছফার বড় গুণ ছিল তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না নিজের ইচ্ছেমতো চলতেন তার সঙ্গে এসে জুটল নতুন ছন্নছাড়া বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতান এস. এম. সুলতানকে দেখে সবাই বিস্ময়ভরে তাঁর বেশভূষার দিকে তাকিয়ে থাকত এস. এম. সুলতানের ছবিকে তখন এদেশের শিল্পীরা তখন মোটেও গুরুত্ব দিতেন না বিভিন্ন অপব্যাখ্যা দিতেন সুলতানের ছবির ক্ষেত্রে কিন্তু সুলতান কখনো খেই হারাতেন না তার কারণ ছিল আহমদ ছফা ঢাকায় সুলতানকে প্রতিষ্ঠা করতে ছফার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য আহমদ ছফা ঢাকায় একটা সংস্কৃতি দাঁড় করেছিলেন, যার নাম প্রতিবাদী সংস্কৃতি যে-কোনো অঘটনের বিরুদ্ধে তিনি পথে নামতেন

তার মৃত্যুর আগে এক সময় একটি পত্রিকা তাঁর এবং সদ্য প্রয়াত হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে বাজারে বহু কথা ছেড়ে দেয় দুজনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিতণ্ডা চলতেই থাকে আহমদ ছফা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হুমায়ুন আজাদের ওপর কিন্তু সরকার যেদিন হুমায়ুন আজাদেরনারী গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করেন তখন সর্বপ্রথম রাস্তায় নামেন আহমদ ছফা তিনিনারী বেশ কয়েকটি গ্রন্থ হাতে নিয়ে রাস্তায় তা বিক্রি করতে নামেন এবং পরিষ্কার কণ্ঠে প্রকাশ করেন যে, এই রাষ্ট্র আমি মানি না সরকার বই নিষিদ্ধ করবেএটা হয় না সব বই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করব, রাষ্ট্র পারলে ঠেকাক আহমদ ছফার ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে

এবারে আমরা আরেকটি কাহিনির কথা বলতে পারি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পণ্ডিত আহমদ শরীফকে দিয়ে এক ভাস্করস্বাধীনতার সংগ্রাম ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করিয়েছিলেন আহমদ শরীফের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পরে ওই ভাস্কর্যের সঙ্গে আরেকটি মুণ্ড যুক্ত করে, চারদিকে কিছু প্রোট্রেট দিয়ে হিজিবিজি করে দিয়ে ৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে একই ভাস্কর্য জগন্নাথ হলের পেছনে একটু সরিয়ে বিপুল টাকার বিনিময়ে সেটি উদ্বোধন করান

আহমদ ছফা এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং একটি কাগজেভাস্কর্যের রূপান্তর নামে একটি লেখা লেখেন, যা ছিল ওই সময়ের সেরা প্রতিবাদ আহমদ ছফার এমন প্রতিবাদের আরেকটি ছিল বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে তাও সবার জানা আহমদ ছফা মৃত্যুর বেশ আগেই বের করেছিলেন তাঁর বংশ পরিক্রমা তাতে আমরা দেখি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানায় শ্রীমল্ল নামের জনৈক ব্যক্তির পরবর্তী প্রজন্মের এক প্রতিনিধি তিনি গ্রাম থেকে উঠে আসা এই পণ্ডিত ঢাকায় বসেও তাঁর স্বভাবসুলভ কার্যে কোনো পরিবর্তন আনেন নি গ্রামের লোকজন তাঁর কাছে এলে তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে আলাপ করে যেতেন ব্যাপারে তাঁর কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ ছিল না তাঁর বাসা সবার জন্যে ছিল š§ুক্ত যে জন্যে তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন সবচে প্রিয় ছফা ভাই নিজ গ্রামে আহমদ ছফা খুব যেতেন বিশেষত ১৯৮৮ সালের বন্যায় ওই অঞ্চলে অজস্র পরিবার ভিটেমাটি শূন্য হয়ে গেলে তিনি তাদের থাকার বন্দোবস্ত করেন জন্যে তিনি জার্মানির একটি সংস্থাকে বলে প্রায় ৪০০ বাড়িঘর নির্মাণ করে দেন এলাকাবাসী একথা খুব ভালোভাবে মনে রেখেছেন

আহমদ ছফা একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নামপুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ বৃক্ষ বিহঙ্গের সঙ্গে তার কত প্রেম ছিল তা বোধ করি তার সাহচর্যে যারা এসেছে তাদের সবারই জানা সম্ভব তাঁর বন্ধু ছিল অনেকগুলো শালিক, কাকসহ বহু পাখ-পাখালি এসব পাখ-পাখালিকে তিনি নাম ধরে ডাক দিলেই সবাই চলে আসত এদের নাম ছিল বাবু

আহমদ ছফা একই সঙ্গে সঙ্গীতচর্চা করতেন বাঁশি বাজাতেন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস মাঝে-মধ্যে অস্বাভাবিক হয়ে যেত তার মধ্যেও তিনি বাঁশি বাজাতেন আবার গান গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে কখনো নিজের লেখা গান কখনো অন্যের লেখা কিন্তু সব গানের সুর ছিল এক রকম ব্যাপারে কারও কোনো কথাকে তিনি পাত্তা দিতেন না পাত্তা দেবার মানুষ তিনি ছিলেন না নিজের ইচ্ছেমতো গান গাইতেন তবে বেশিরভাগ সময় থাকতেন অর্থকষ্টে কারণ তার খরচ ছিল প্রচুর বাসা ভাড়া, বাসায় একাধিক লোকজন, আত্মীয়স্বজন আজিজ মার্কেটের উত্থানপর্বের অফিস এরপর বিভিন্নজনকে সাহায্য করতেনকোনো কিছু না দেখেই তাঁর অভাব বা কষ্টের কথা কাউকে তিনি কোনোদিন বলেন নি কেন বলেন নি তা তিনিই জানেন একাধিকবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ডাক্তার সিগারেট খেতে নিষেধ করতেন কিন্তু তিনি একের পর এক সিগারেট জ্বালিয়ে যেতেন মনে হতো ইচ্ছে করেই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন তিনি নিঃশ্বাস ছাড়তে পারতেন না তবুও সিগারেটের পেছনে সুখটান দিয়ে চলতেন অবিরাম

এইভাবে একদিন তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং আর কোনোদিন উঠলেন না সেসবই আমাদের জানা তাঁর মতো ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্র কোনো সম্মান দেয় নি তাও আমাদের জানা আহমদ ছফাকে যে দোষে দুষ্ট করা হতো তা হলোতিনি বাঙালি মুসলমানহলেই বা দোষটা কী ?

তার লেখা কি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না সাহিত্যের ? যদি সাহিত্যের করে তাহলে বিতর্ক কেন ?

আহমদ ছফার লেখক সত্তাকে দাবিয়ে রাখার বহু প্রচেষ্টার মধ্যে একটি হচ্ছে তাঁকে বিভিন্ন কলঙ্ক দেওয়া তাঁর মৃত্যুর পরও সে কলঙ্ক আমরা মুছতে পারি নি মাঝখান দিয়ে আমাদের বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেছে

আহমদ ছফা মহাকবি গ্যেটেরফাউস্ট অনুবাদ করে দেশে খুবই খ্যাত হন অল্প সময়ের মধ্যেই কবিতা-উপন্যাস ছাড়াও তাঁর ছিল একাধিক প্রবন্ধের বই এক ছন্নছাড়া জীবনের অধিকারী আহমদ ছফা নিজের জন্যে কখনো কিছুই করেন নি তিনি সত্তরের দশকে তোলপাড় করা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিবের শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিতভাবে প্রতিবাদ করে এই গণকণ্ঠই

এই পত্রিকা বন্ধ হবার পরে আহমদ ছফার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি পিছু হটেন নি

জীবদ্দশায় তিনি বস্তির শিশুদের জন্যেসুলতান পাঠশালা নামে একটি স্কুল গড়ে তুলেছিলেন

বাঙালি মুসলমানের মন তার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বইয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালি মুসলমানের মন কী রকম সেটি বোঝাতে চেয়েছেন তার মতে, বাঙালি সমাজে মুঘল আমলে যারা শাসকবর্গ ছিল, তারা ছিল অবাঙালি, ফলে বাঙালি সমাজের সাধারণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত যোগাযোগ ছিল না তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চাকা যুগ যুগ ধরে একই রয়ে যায়, কোনোদিন ঘোরে নি সেটি আহমদ ছফা এখানে জোর দিয়ে বলেছেন, এরা সবাই ছিল নিম্নবর্গের হিন্দু, যারা অত্যাচারিত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে সমাজ অধিপতিদের হাতে, তারাই মুক্তির আশায় প্রথমে বৌদ্ধ পরে মুসলমান হয় এরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ

কাজেই হিন্দু আমলে যেমন এদের অবস্থা ছিল অতিশয় খারাপ, তেমনি মুসলমান আমলেও ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয় নি অথচ যখন মুসলমান শাসনের অবসান হয়, তখন ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠা পায় তখন হিন্দু সমাজ ইংরেজদের আনুকূল্য পেতে থাকে এবং রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণের পর্যায়টি শুধু মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের মধ্যে বিকশিত হলেও সাধারণভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীও এক অর্থে সচেতন থাকে পুরাণ, উপনিষদ, মহাভারত রামায়ণ প্রভৃতি সাহিত্যে ফলে হিন্দু সমাজ যেমন আধুনিক হতে থাকে, তেমনি ঐতিহ্য সচেতনও হতে থাকে

বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, যদ্যপি আমার গুরু এবং উপলক্ষের লেখাএইসব বইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সব জিনিস দান করে গেছেন তাঁর যে যুক্তিবাদ তাকে খণ্ডানো সহজ বিষয় নয় অগাধ পাণ্ডিত্য মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ তাতে আহমদ ছফা সহজেই তরুণদের ভেতরে সবচে বেশি আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন একারণে তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অপদস্ত করার ফন্দিও এঁটেছে এদেশের নামিদামি লোকজন

আহমদ ছফা একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফলে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে সংগ্রাম করতেই হতো সংগ্রামী লেখক আহমদ ছফা আমৃত্যু ছিলেন অকৃতদার তাঁর মৃত্যু এদেশের সাহিত্যের কত বড় ক্ষতি করেছে তা এখন সবাই বোঝেন এই বুঝে ওঠার আগেই ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকায় আহমদ ছফারাষ্ট্রসভা নামে একটি সংগঠন দাঁড়িয়েছে এছাড়া আর কোথাও কিছু হয় নি গাছবাড়িয়ায়ও তাঁর বাড়িটি ভেঙে বাড়ির সামনে ভবন তোলা হচ্ছে এসব খবর নিতে নিতে বৃষ্টিও একটু থামে আমরা গাছবাড়িয়াস্থ আহমদ ছফার বাস্তুভিটা ছেড়ে নতুন পথের উদ্দেশে রিকশায় উঠে পড়ি

[পাক্ষিক অন্যদিন, অক্টোবর, ২০০৪]

 

 

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.