শম্পা কী চায়? (দ্বিতীয় পর্ব)

শম্পা কী চায়? (দ্বিতীয় পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

শ্রাবণীকে দেখে ভয়ে আমার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠল।

নিজের ক্যাম্পাসের ভেতর কোনোভাবেই স্ক্যান্ডালে জড়ানো যাবে না। ওর হাতে বইটা ফেরত দিয়ে না চেনার ভান করে বললাম, আপনাকে তো চিনতে পারছি না! কে আপনি? কী বলছেন এসব?

শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, উপস্, এসব নাটকের জন্য তুমি বড্ড আনাড়ি, সোনামণি। কাল তো সরোদ বাজানো শেষে শিশুর মতো মনের ঝাঁপি খুলে বসেছিলে।

কোন নাটক? সরোদ কে বাজালো? দেখুন, আপনার কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

কালা সারা সন্ধ্যা আমাকে সরোদ বানিয়ে ঝংকার তুলে শেষ করে দিলে, আমার এখনো গা ব্যথা করছে। আর তুমি এখন আমাকে আপনি আপনি করছো? দাঁড়াও ছবি দেখাচ্ছি।

শ্রাবণী মোবাইল খুলে কী না কী ছবি দেখাতে যাবে কে জানে, এমন সময় দেখলাম করিডর দিয়ে আমার দুজন কলিগ এদিকে এগিয়ে আসছে। আমি নার্ভাস হয়ে তাড়াহুড়া করে বললাম, আচ্ছা আচ্ছা আপনি আমার রুমে চলে আসুন। ছবিটবি ওখানে দেখা যাবে।

আমার কলিগ প্রফেসর সুরাইয়া বেগম আর ডক্টর নার্গিস আরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থামলেন। সুরাইয়া বেগম মহা আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী খবর জাহিদ ভাই, ফার্স্ট লেকচার হয়ে গেল বুঝি?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, ওই একটাই ছিল, আজ আর লেকচার নেই।

ডক্টর নার্গিস শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী মেয়ে, ফার্স্ট ইয়ার? তোমাদের প্রফেসর সাহেব কেমন ক্লাস নিলেন?

শ্রাবণী হেসে বলল, স্যারের কথা আর কী বলব ম্যাম, উনি তো বহুমুখী প্রতিভা, ভালো সরোদও বাজাতে পারেন।

ডক্টর নার্গিস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সরোদ বাজাতে পারেন? এতদিন একসঙ্গে কাজ করি, শুনি নি তো কখনো! নেক্সট ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রামে কিন্তু আপনাকে সরোদ বাজাতেই হবে।

কলিগ দুজন চলে যেতেই আমি কটমট করে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললাম, এসব উল্টোপাল্টা সরোদটরোদের কথা বললেন কেন?

আমাকে বাজানোর সময় খেয়াল ছিল না, ছবি দেখাব?

আচ্ছা আচ্ছা থামুন প্লিজ। আমাকে ফলো করুন।

শ্রাবণী বিড়বিড় করে বলল, আবার অফিসে একা পেয়ে কাল সন্ধ্যার মতো কোরো না।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কী বললেন?

শ্রাবণী ফিক করে হেসে বলল, কই কী বললাম? চলো তোমার রুমে চলো, আনাড়ি অভিনেতা।

অফিসরুমে ঢুকে আমি শ্রাবণীকে একটা চেয়ার টেনে বসতে বললাম। শ্রাবণী আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে দেয়ালে ছবি দেখতে দেখতে বলল, এটা কি তোমার বউ? বাহ ভীষণ কিউট তো! ঘরে এ রকম মেয়ে রেখে বাইরে ওসব করার কী দরকার?

আমার এবার মাথা গরম হয়ে গেল, দেখুন আপনাকে বসতে বলেছি বসুন। আবঝাব বকরবকর করবেন না।

শ্রাবণী হাতজোড় করার ভঙ্গি করে বলল, আচ্ছা সোনামণি আচ্ছা, কাম ডাউন, এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নাই। রেগে গেলে তো হেরে গেলে। তবে হ্যাঁ, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। কাল যে সোহাগ করেছ তাতে একটু আধটু শাসন করতেই পারো।

মেয়েটা আমাকে নিয়ে সাইকলজিকাল গেম খেলছে। আমি কোনো বলদ না। আমি দেশের অন্যতম সেরা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ফুল প্রফেসর। আমি ওর কারেন্ট জালে ধরা দিচ্ছি না। গলা নরম করে বললাম, দেখুন, নিশ্চয় আপনার কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার মতো চেহারার কারও সঙ্গে নিশ্চয় আপনি আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আচ্ছা এক কাজ করুন, কাল কী হয়েছে পুরো ঘটনা আমাকে খুলে বলুন তো।

হুম, তুমি চান্দু আমাকে এখন চিন্তায় ফেলে দিলা।

দেখুন আমি ইংরেজি বিভাগের সম্মানিত প্রফেসর। আমাকে হুট করে চান্দুফান্দু বলবেন না, এটলিস্ট শো সাম রেসপেক্ট। তার ওপর সেই কখন থেকে তুমি তুমি করছেন, ব্যাপারটা খুবই অপমানজনক। আপনার চান্দু যেই হোক না কেন সেটা আমি না। নিজেই তো দেখলেন আমি এখানে ইংরেজি গল্প-কবিতা পড়াই, শিল্পসাহিত্য নিয়ে মগ্ন থাকি। আই প্রমিজ, আমি আপনাকে এই প্রথম দেখলাম।

বুঝছি গো বুঝছি। তোমার হয়তো মদের ঘোরে কালকের ঘটনা স্মরণে নাই।

উফ্, কোন ঘটনা?

ওকে, আমি মনে করায় দিচ্ছি। তার আগে একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করি। মুখে না চেনার ভং ধরলেও তুমি হয়তো এখন মনে মনে ভাবছ আমি শ্রাবণী। শ্রাবণী জাস্ট একটা প্রফেশনাল নেইম, আমার আসল নাম শম্পা।

আবারও বলছি, শ্রাবণী হোন আর শম্পা হোন, আমি জানি না আপনি কোথা থেকে এসেছেন, আমার কাছে কী চাচ্ছেন। আপনাকে আরেকবার সুযোগ দিচ্ছি সব কিছু খোলাসা করেন।

কাল রেডিসন হোটেলে একটা গ্যাদারিং ছিল না তোমাদের, বিকেলবেলা? কি, মনে পড়ে?

শ্রাবণী নাকি শম্পার এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কাল বিকেলে আমি রেডিসন হোটেলে ছিলাম, অনেকেই হয়তো আমাকে দেখেছে। কিন্তু শ্রাবণী কোনো প্রমাণ না দেখানো পর্যন্ত আমি কোনোভাবেই সেটা স্বীকার করব না। আগে বুঝতে হবে ওর ধান্ধাটা কী। অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, কাল রাত ন’টা অব্দি আমি অফিসে কাজ করেছি, নতুন ক্লাস আরম্ভ হয়েছে, ওইজন্য অনেক এডমিন ওয়ার্ক ছিল। তুমি কী আবোলতাবোল বলছ, আমার কোনো ধারণাই নেই।

শম্পা কোনো জবাব দিল না। চেয়ার থেকে উঠে আবার দেয়ালে ঝোলানো আমার আর রোকসানার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, ইস, আপুকে কত সুন্দর লাগছে গো! ওনাকে চিনি না অথচ ওনাকে বলার জন্য কত কথা জমে গেছে, আমার পাখির মতো ছোট মনটা খালি ছটফট ছটফট করছে। আপুর ফোন নম্বরটা দিবা একটু? প্লিজ।

কেন, আমার ওয়াইফের নম্বর আমি আপনাকে দেব কেন, ফাজলামো নাকি?

ইস, আপুকে ঘরে রেখে এত কিছু করলা আমার সঙ্গে, সরোদ বাজালা, তাই ভাবলাম আপুর সঙ্গে একটু পরিচিত হই। বোঝার চেষ্টা করি সমস্যাটা কোথায়। আচ্ছা ফোন নম্বর দরকার নেই, তুমি আপাতত আমাকে দশ হাজার টাকা দাও।

কী!

আহা, দশ লাখ তো চাইছি না, এমন করো কেন? বাই দা ওয়ে, একটা কথা মনে করে ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

কী কথা?

আজ জানলাম তোমার নাম প্রফেসর জাহিদ আহমেদ। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। আর গতকাল তোমার বন্ধু বলল, তুমি শিল্পপতি খায়রুল আলম। হা হা হা। কী ভাবছিলা, শিল্পপতি বললে টাকার লোভে বেশি আদর করব?

বুঝলাম, যতক্ষণ এই মেয়ে কাছে থাকবে ততই প্যাঁচ বাড়তে থাকবে। এখন আপদ দূর হলেই বাঁচি। মরিয়া হয়ে বললাম, ঠিক আছে, কাল লেকচারের পর আমার রুমে এসে দশ হাজার টাকা নিয়ে যাবেন। ভাববেন না আপনার আবোলতাবোল অভিযোগের জন্য দিচ্ছি। আমি ধরে নিচ্ছি কোনো আর্থিক সমস্যার কারণে আপনি এমন করছেন, অথবা আপনার কোনো মানসিক সমস্যা আছে।

আমি শম্পাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে দিলাম, শম্পা বলল, বাই বাই সোনামণি লাড্ডুগুড্ডু, কাল দশ হাজার টাকা রেডি রেখো। আর হ্যাঁ, অভিনয় শিখতে চাইলে কোনো নাট্যদলে যোগ দাও, হি হি হি, কখন থেকে রামগরুড়ের মতো আপনি আপনি করছে।

শম্পা চলে যেতেই আমি বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের মতো গোত্তা খেয়ে চেয়ারের ওপর পড়লাম। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডও না, ওয়ান ইভনিং স্ট্যান্ড বা ও রকম কিছু, এখন ঠিক মনে করতেও পারছি না। সেটা যে এমন বুমেরাং হয়ে ঘোঁট পাকাবে কে জানত?

কাল দুপুরে রেডিসন হোটেলে এক্স-ক্যাডেটদের একটা গেট টুগেদার ছিল। এসব প্রোগ্রাম গড়াতে গড়াতে মাঝ রাত অবধি চলে যায়। আমার স্ত্রী রোকসানা সেটা জানে। রোকসানা শুধু বলেছিল, কাল ভোরে কিন্তু তোমার লেকচার, দেখো বেশি রাত কোরো না।

রেডিসনে লাঞ্চ সেরে বিকেলের দিকে দু’ বোতল ভদকা নিয়ে আমরা আড্ডায় বসেছিলাম। কয়েগ পেগ পেটে পড়তেই একটা হালকা ভাব এসেছিল। মনে হচ্ছিল আমি একটা অ্যাকুরিয়ামের ভেতর, আমার চারপাশের ঝাপসা দৃশ্যগুলো হালকা ঢেউয়ে দুলছে।

হঠাৎ সাত ঘাটের জল খাওয়া ধুরন্ধর বন্ধু মারুফ কোত্থেকে এই মেয়েটাকে নিয়ে আমার সামনে বসল। আমি কিছু বলার আগেই পরিচয় করিয়ে দিল, এ হচ্ছে মিস শ্রাবণী আহমেদ, একটা অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সিতে আছে।

কথাটা বলেই মনে হলো মারুফ চোখ টিপ দিল, কেন টিপ দিল বুঝলাম না। আমি সামান্য মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানালাম। তারপর মারুফ শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, আর ইনি হচ্ছেন শিল্পপতি খায়রুল আলম।

মারুফের কথা শুনে আমি অবাক হলাম, শিল্পপতি খায়রুল আলম। কে? ও কার কথা বলছে? কিন্তু আমি তখন একটা ঝাপসা জগতে, কেমন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছি। শ্রাবণীকে আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে মারুফ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, জাস্ট এনজয় ম্যান।

আমি এবার শ্রাবণীর দিকে তাকালাম। মনে হলো বিশ-একুশ বছরের রূপসী একটা মেয়ে। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই শ্রাবণী আমার হাত ধরে এমনভাবে গল্প আরম্ভ করল যেন না জানি কত দিনের চেনা। দূরে একটা লোকাল মিউজিক ব্যান্ড গান গাইছে, ‘মন কী যে চায় বলো, যারে দেখি লাগে ভালো’। ছন্দের তালে তালে শ্রাবণী বারবার আমার গায়ে ঢলে পড়ছে। অ্যালকোহলের জন্য কি-না কে জানে, আমার বেশ ভালোই লাগছিল ওর এই ঢলঢলানি আর উষ্ণ স্পর্শ। একটু পর একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। শ্রাবণী আমাকে হাত ধরে সোফা থেকে টেনে ওঠাল। তারপর শক্ত করে হাত চেপে লিফটের কাছে নিয়ে গেল, আমিও সেই ধোঁয়াশাময় মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওকে সঙ্গ দিলাম। লিফটের ভেতরে ঢুকে শ্রাবণী পাঁচ তলার বোতাম চাপল। কতটা ওর ইচ্ছায় আর কতটা আমার ইচ্ছায় বলতে পারব না, কিন্তু একটু পর আমি ওর সঙ্গে পাঁচ শ’ সতেরো নম্বর রুমে ঢুকলাম।

আমার ইদানীং রোকসানার প্রতি আকর্ষণ একটু ফিকে হয়েছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেও অর্থহীন অর্বাচীন মনে হয়। একেই নাকি মিড লাইফ ক্রাইসিস বলে। কোনো একটা গ্র্যাটিফিকেশনের মাধ্যমে নিজেকে আবার শরীরে আর সৌন্দর্যে মূল্যবান মনে করবার জন্য মনটা হয়তো উতলা হয়ে আছে। এই অবস্থায় শ্রাবণীর মতো একটা সুন্দরী মেয়ে আমাকে হোটেল রুমে আনার পর কী ঘটল মনে নেই কিন্তু শ্রাবণীর ভাষ্য অনুযায়ী ওকে নিয়ে আমি নরক গুলজার করেছি।

রাত দশটার দিকে শ্রাবণী রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নাকি রাত ন’টা? ঠিক স্মরণে আসছে না। আমিও ঘণ্টাখানেক পর একটা ঘোর নিয়ে ঘরে ফিরলাম। রোকসানা জানত আজ আমি পানটান করে আসব, হালকা মাতাল থাকব। আজকের রাতটা সে আমার জন্য ছাড় দিয়েই রেখেছিল। তাই বলে আরেকটা মেয়ের জন্য ছাড় দেয় নি। আমি ওই রাতে আর রোকসানার চোখে চোখ তুলে তাকাতে চাই নি। মাতাল মাতাল ভাব করে কোনোরকমে বিছানায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

গতকালের সেই শ্রাবণী নাকি শম্পা একটু আগে আমার অফিসরুমে এসে দশ হাজার টাকা চেয়ে গেল। শম্পা জেনে গেল আমি কী কাজ করি, কোথায় করি। কিন্তু কীভাবে? আমার মন বলছে মাত্র দশ হাজার টাকায় শম্পা আমাকে ছাড়বে না। ও জাস্ট জল মাপছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার মোবাইলে আননোন নম্বর থেকে ফোন এল। আমি ফোন ধরতেই শম্পা বলল, স্যরি, তুমি এত উত্তেজিত ছিলে যে একটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলতে ভুলেই গেছি।

আমি তটস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা?

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.