রফিকুল ইসলাম: ভাষা আন্দোলন ও নজরুল গবেষণায় অনন্য

রফিকুল ইসলাম: ভাষা আন্দোলন ও নজরুল গবেষণায় অনন্য

জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এখন শুয়ে আছেন আজিমপুর কবরস্থানের ঘাসের নিচে। গত ৩০ নভেম্বর তিনি না-ফেরার দেশে যাত্রা করেন।

শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং উপস্থাপক রফিকুল ইসলাম প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি, চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে।

রফিকুল ইসলামের বাবা মোঃ জুলফিকার আলী ছিলেন একজন রেলওয়ে ডাক্তার। তাই রফিকুলের শৈশব-কৈশোর ও তরুণবেলা কাটে দেশের নানা জায়গায়। শৈশব কাটে রাজবাড়ী জেলার নলিয়া গ্রামে, কৈশোর কাটে লালমনিরহাটে। ঢাকায় আসেন তিনি ১৯৪৩ সালে। শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয় সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, আরমানিটোলা সরকারি স্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কৈশোরে রফিকুল ইসলাম মুকুল ফৌজের সদস্য ছিলেন। আর এই প্রতিষ্ঠানটির প্রাণপুরুষ চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের প্রভাব তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি ছিল।

রফিকুল ইসলামের লেখালেখির সূত্রপাত হয় চল্লিশ দশকে, হাতে লেখা এক পত্রিকায়। পরে মুকুল ফৌজের মুখপত্র পাক্ষিক ‘মুকুল’, ঢাকা কলেজের ম্যাগাজিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বার্ষিকীতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তবে লেখক হিসেবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোর সামনে আসেন ‘মাহে নও’ ও ‘সমকাল’ পত্রিকার মাধ্যমে। ওই সময় প্রকাশিত তাঁর ‘নজরুল ও আধুনিক কবিতা’ প্রবন্ধটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

বেতার ও টেলিভিশনে রফিকুল ইসলাম ছিলেন বেশ সক্রিয়। দেশবিভাগের আগেই তিনি বেতারের ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিটিভির উদ্বোধনী দিন, ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, একটি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন তিনি। পরে পাকিস্তান আমলেই মনিরুল আলমের প্রযোজনায় ‘অমর সাহিত্য’ নামে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। এখানে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি টিভিতে ‘জলসা’, ‘সংগীত প্রহরে প্রহরে’, ‘বুলবুল’, ‘দোলনচাঁপা’সহ বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রফিকুল ইসলাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ওই আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। বায়ান্ন’র ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক নানা ঘটনার আলোকচিত্র তিনি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন, যা এ জাতির অমূল্য সম্পদ। বলা যায়, পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।

ছেলেবেলায় রফিকুল ইসলাম স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষকতার। তাঁর এই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের তিনি প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল গবেষণাকেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। পরে তিনি কাজ করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য তিনি। বাংলা একাডমি ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

তিনবার তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। প্রথমবার ১৯৭০ সালে অসুস্থতার কারণে, ১৯৭১-এর ২৫-২৭ মার্চ জহুরুল হক সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় আবাসের বাসিন্দা হিসেবে সশস্ত্র পাকিস্তানি হামলা থেকে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বন্দিশিবিরে আটক অবস্থায়।

শিল্পের কোন মাধ্যমকে ঈর্ষণীয় মনে হয়? এ প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছিলেন অন্যদিন-এর কাছে এভাবে— ‘ঈর্ষা করি সংগীত মাধ্যমকে। কণ্ঠ নেই, তাই গাইতে পারি নি। তবে ছাত্রজীবনে এস্রাজ, তারসানাই এবং দিলরুবা শিখেছি ওস্তাদ ফুলজুরি খান সাহেবের কাছে। পিয়ানো শিখেছি মার্কিন মহিলা এলাইন বিগেলুর কাছে।’

রফিকুল ইসলামের গ্রন্থসংখ্যা ২৪। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নজরুল জীবনী (১৯৭২), বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা (১৯৭৩), কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও কবিতা (১৯৮২), ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার (১৯৮২), কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্য (১৯৯১), কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টি (১৯৯৭), নজরুল প্রসঙ্গে (১৯৯৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর (২০০৩)।

সাহিত্য ও গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রফিকুল ইসলাম পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ নজরুল একাডেমি পুরস্কার, ঢাকা নজরুল ইনস্টিটিউট পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক।

ভাষা আন্দোলন ও নজরুল গবেষণায় রফিকুল ইসলামের যে অবদান, এর জন্য জাতি তাঁকে চিরদিন স্মরণ করবে।    

Leave a Reply

Your identity will not be published.