সৈয়দ শামসুল হক: সব্যসাচী এক স্রষ্টা

সৈয়দ শামসুল হক: সব্যসাচী এক স্রষ্টা

সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্যের পরিপূর্ণ রূপকার। অনুবাদক হিসেবেও ছিলেন সফল। রেডিও, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে নানা ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেছে। মঞ্চে কয়েকটি সাড়া জাগানো কাব্য নাটকের স্রষ্টা তিনি। চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও অভিনয়শিল্পী হিসেবেও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আজ ২৭ ডিসেম্বর তাঁর ৮৬তম জন্মবার্ষিকী।

“বালকটির জন্ম হয়েছিল ধরলা নদীর পারে খড়ের একটা বাড়িতে। বর্ষায় উন্মত্ত নদী সেই বাড়িটি গ্রাস করে নেবার পরে তারা উঠে আসে বাজারের কাছে এই বাড়িটিতে। বাহির বাড়িতে টিনের লম্বা একটা ঘর, প্রায় আশি হাত লম্বা, সেখানে বাঁশের চাটাই বেড়াই দিয়ে কয়েকটি ছোট ঘর করা হয়েছে, এইসব ঘরে বালকটির বাবার হোমিওপ্যাথি কলেজের ক্লাস বসে, মাঝখানে দুমুখ খোলা একটা ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতরে যাবার পথ। গেলেই উঠান। উঠানের পশ্চিমে টিনের আটচালা বড় ঘর, তাদের শোবার ঘর, উত্তরে একটি টিনের দোচালা ঘর, তার বাবার প্রায় নিরক্ষর ছোটভাই ইদ্রিস তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন, পুবে খড়ো চালের রান্নাঘর, আর এদিকে বাহির বাড়ির লম্বা ওই টিনের ঘরের পাশে আর একটি টিনের দোচালা ঘর, ওখানে বাড়ির জায়গীর যুবকেরা থাকে, আর ওখানেই ডাঁই করা থাকে বালকটির বাবার কবিরাজি ঔষুধ তৈরির মটকি কড়াই গাছগাছড়ার পাহাড়। এই দুটি টিনের ঘর এতটাই লাগোয়া যে ওদের চাল একসঙ্গে জুড়ে ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো হয়েছে। জিগার একটা গাছ ছিল ওই ভি অক্ষরের বরাবর, গাছটি বেয়ে বালক রোজ টিনের চালে উঠে যায়। ভি অক্ষরের কোলে একটি চালে পিঠ ঠেকিয়ে পাশের চালে পা রেখে সে বই পড়ে।” (হে বৃদ্ধ সময়/ সৈয়দ শামসুল হক)

এভাবেই আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে সৈয়দ শামসুল হক পৈতৃক বাসস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। এটি কুড়িগ্রামের মীর জুমলার সড়ক ধরে বাজারের কাছাকাছি শহরের প্রধান মসজিদমুখী গলিতে অবস্থিত।

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার শেষরাতে কুড়িগ্রামের যে বাড়িতে সৈয়দ হক পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলেন, সেটি ছিল টিনের এক ভাড়াবাড়ি। ধরলা নদীর পাড়ে অবস্থিত সেই বাড়িটি যখন নদীগর্ভে তলিয়ে যায়, তখন সৈয়দ হকের বয়স আড়াই বছর। তাঁর বাবা হোমিও ডাক্তার সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন। মা হালিমা খাতুন। তাঁদের প্রথম সন্তান সৈয়দ শামসুল হক।

সৈযদ হকের মা হালিমা খাতুন ছিলেন মানিকগঞ্জের রৌহা গ্রামের আবুল হোসেন খানের ঔরসে তাঁর প্রথমা স্ত্রী এক হিন্দু কন্যার দ্বিতীয় কন্যা। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল সাত। তিনি স্বামীর ঘর করতে আসেন তেরো বছর বয়সে। আর যখন প্রথম সন্তানের (সৈয়দ শামসুল হক) মা হন, তখন তাঁর বয়স ষোল। অবশ্য এর আগে প্রথম গর্ভধারণ হয়েছিল হালিমার, কিন্তু পূর্ণ পরিণতি পাওয়ার আগেই সেই ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যায়। তবে মেয়ে বলেই তাকে শনাক্ত করা গিয়েছিল।...সৈয়দ হকের পরে আরও সন্তানের জননী হন তিনি। পাঁচ ছেলে এবং তিন মেয়ে। সৈয়দ আমজাদ হোসাইন, সৈয়দ আজিজুল হক, সৈয়দ হামিদুল হোসাইন, সৈয়দ রসুল হক, হেলাল এবং শামসুন নাহার টিনা, হোসনে আরা জাহান রোজী ও সফিনাজ হোসাইন রুকু। হেলাল অবশ্য  ছয় মাস বয়সেই মারা যান। 

সৈয়দ হকের পৈতৃক আদি বাসস্থান অবশ্য সিরাজগঞ্জের তামাই গ্রামে। তাঁরা পীর পরিবার। সৈয়দ হকের বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পারিবারিক পেশায় যুক্ত না হয়ে আরবি-ফারসির ধারেকাছে না গিয়ে ইংরেজি শিক্ষা করেন। তাই তাঁর পিতা সৈয়দ রইসউদ্দিন পরিবার থেকে তাঁকে বহিষ্কার করেন। সিদ্দিক কলকাতায় যান। সেখানে মানিকগঞ্জের এক পুস্তক বাঁধাইকারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তার এবং অন্যদের আর্থিক সাহায্যে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু অর্থাভাবে বেশিদিন সেখানে পড়তে পারেন নি। তিন বছর পরে তিনি এম খানের কলেজ থেকে হোমিও-স্নাতক হয়ে বের হন। ঘটনাচক্রে রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার ভোগডাঙা গ্রামে আসেন—সেখানকার জমিদার কাজী এমদাদুল হকের দাতব্য চিকিৎসালয়ের হোমিও চিকিৎসক হিসেবে। কিন্তু এক মাস পর কাজী সাহেবের সঙ্গে বাকবিত-ার দরুন ভোগডাঙা থেকে চলে আসেন কুড়িগ্রামে, এখনকার পুরোনো শহরে একটি ডিসপেনসারি খোলেন। এর পরে ভাড়াবাড়িতে স্ত্রীসহ বসবাস, সন্তানের জনক হওয়া, নদীর গর্ভে সেই বাড়ি তলিয়ে যাবার পরে উঠে আসেন বাজারের কাছে বর্তমান বাড়িতে।

শিল্পস্রষ্টা সৈয়দ হক সম্পর্কে এবার জানি।  তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার সেরা নিরীক্ষাপ্রবণ লেখক। উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন কবিতার ভাষা (অন্তর্গত); যতি চিহ্নিত দীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদে লিখেছেন আরেকটি উপন্যাস (দ্বিতীয় দিনের কাহিনী); লন্ডনের পটভূমিতে লেখা তিনটি উপন্যাসে চরিত্রসমূহের ইংরেজি সংলাপকে চিহ্নিত করেছেল বাংলা সাধু ভাষায় (বালিকার চন্দ্রযান, তুমি সেই তরবারী, অন্য এক আলিঙ্গন); এদেশের উপন্যাসে প্রথমবারের মতো যৌনতার নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন (খেলারাম খেলে যা)। ছোটগল্পে জাদুবাস্তবতার প্রয়াগ ঘটান তিনিই (রক্তগোলাপ); গল্পে কালেক্টিভ ভয়েস ‘আমরা’-এর ব্যবহার প্রথম করেছেন তিনিই। কবিতায় লিরিকের পরিবর্তে লিখেছেন আখ্যানমূলক কাব্য: প্রয়োগ করেছেন আঞ্চলিক ভাষা। গড়ে নিয়েছেন নিজস্ব উপনিবেশ—রংপুরের পটভূমিকায় কাল্পনিক শহর—জলেশ্বরী। সৈয়দ হকের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘তাস’ (১৯৫৪)। এটি একটি গল্পগ্রন্থ।

সৈয়দ হকের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বিচিত্র বিষয়ে নানান রচনা—কবিতা, কথাকাব্য, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ রচনা, চলচ্চিত্রের কাহিনি-গান, আত্মজৈবনিক রচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইতাদি। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে কলাম লিখেছেন। তিনি যেমন অনেক বিদেশি কবিতা ও উপন্যাস অনুবাদ করে বাংলা ভাষার পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তেমনি তাঁরও অনেক সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তিনি নিজেও তাঁর গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে সৈয়দ হকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক।

সৈয়দ হকের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হচ্ছে— শীতবিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (২০১২)।...প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ (১৯৬১)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ—বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা (১৯৭০), পরানের গহীন ভিতর (১৯৮১), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), বর্বরেরা আসছে (১৯৯৮)। কথাকাব্য—অন্তর্গত (১৯৯৯)। ...কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), নূরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২)।...প্রকাশিত প্রথশ উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৯)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস—খেলারাম খেলে যা (১৯৭৩), নীলদংশন (১৯৮১), দূরত্ব (১৯৮১), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১৯৮৯), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯৯), বাস্তবতার দাঁত ও করাত (১৯৯৯), বালিকার চন্দ্রযান (২০০৮)। তাঁর লেখা শেষ উপন্যাস ‘নদী কারও নয়’। সায়েন্স ফিকশন—মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), মহাশূন্যে পরান মাস্টার (১৯৮৮)।...শিশুতোষ রচনা—আনু বড় হয় (১৯৮৬), হডসনের বন্দুক (১৯৮৮), সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৬)। ...আত্মজৈবনিক রচনা—আমার স্কুল (২০০৪), প্রণীত জীবন (২০১০), তিন পয়সার জোছনা (২০১৪), হে বৃদ্ধ সময় ।...প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কলাম হৃৎকলামের টানে (১৯৯১), মার্জিনে মন্তব্য/ গল্পের কলকব্জা (১৯৯৫), হৃৎকলামের টানে ২য় খণ্ড (১৯৯৭), কথা সামান্যই (২০০৬)।...অনুবাদকর্ম—শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯), গোলাপের বনে দীর্ঘশ্বাস (২০০০), উইলিয়াম শেকসপীয়রের তিনটি নাটক (২০০৬)।

সৈয়দ হকের একটি নিজস্ব গদ্যশৈলী ছিল, যা একইসঙ্গে ব্যাকরণ শুদ্ধ এবং একটি অনবদ্য শিল্প। এই শৈলীর সূচনাপর্বে লেখা উল্লেখযোগ্য রচনা হলো, উপন্যাসিকা ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ (১৯৭৪)। ...শেক্সপীয়র বিশেষজ্ঞ, নাট্যকার-অভিনেতা প্রয়াত উৎপল দত্তের অভিমত ছিল, সৈয়দ হকের শেক্সপীয়রের অনুবাদের তুল্য অনুবাদ পৃথিবীতে শেক্সপীয়রের নাটক যে-কোনো ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে বিরল। ...তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’সহ কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কাহিনি-সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। কয়েকটি হৃদয়স্পর্শী গানও লিখেছেন। যেমন, ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা...।’

এবার সৈয়দ হকের পিতৃপুরুষদের কথা বলা যাক। তাঁর দাদা রইসউদ্দিন ছিলেন প্রাচীন এক পীরবংশের উত্তরাধিকারী ও গদিনশিন। তাঁদের বংশের আদি পুরুষ মুঘল সম্রাট আকবরের বৃত্তিভোগী এক ধর্মগুরু—হযরত শাহ সৈয়দ আলী মাহমুদ। তিনি অনুগত শিষ্য-পরিজনদের নিয়ে গোপনে দিল্লী ত্যাগ করেন, যখন সম্রাট আকবর দীন-এ-এলাহী নামে একটি নতুন ধর্মমত প্রচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আলী মাহমুদ দিল্লী থেকে যাত্রা করে ছাউনি ফেলেন প্রথমে শাহজাদপুরে। তারপর সিরাজগঞ্জের তামাই গ্রামে।...আলী মাহমুদের দুই ছেলে ভোমর এবং গোমর। গোমর ছিল সুরা ও নারীতে আসক্ত। তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হলে তিনি অজানার উদ্দেশে যাত্রা করেন। অতঃপর কয়েক পুরুষ পরে রহিম উদ্দিন নামে এক বংশধরের কথা জানা যায়, যিনি সৈয়দ বংশের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনেন। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে বড় রইসউদ্দিন হলেন সৈয়দ হকের দাদা।...রইসউদ্দিনের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ হায়দার হুসাইন, দ্বিতীয় ছেলে সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এবং তৃতীয় ছেলে সৈয়দ ইদ্রিস হুসাইন। আর রইস উদ্দিনের চার মেয়ে মেহেরুন্নেসা, বশিরুন্নেসা, শরিফুন্নেসা এবং নূরজাহান।  

সৈয়দ হকের রংপুরের বাড়ির অবস্থা এখন কেমন? সৈয়দ হক ছোটবেলায় যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরটি আলাদাভাবে রক্ষিত আছে। আর বাড়ির সামনে সৈয়দ হকের বাবার ডিসপেনসারি যেখানে ছিল, সেখানে তাঁর তৃতীয় ছেলে সৈয়দ আজিজুল হক দোতলা দালান নির্মাণ করেছেন।

উল্লেখ্য, সৈয়দ হায়দার হোসেন কুড়িগ্রাম থেকে বহু বছর আগে লালমনিরহাটে চলে যান এবং সেখানে তাঁর নির্মিত বাড়িতে তাঁর উত্তরাধিকারীরা বসবাস করছে। অন্যদিকে সৈয়দ ইদ্রিস হুসাইন অল্প বয়সে মারা গেছেন। আর সৈয়দ শামসুল হক এখন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে।

অনন্যসাধারণ এই শিল্পীসাধক তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন; ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবেন শিল্পের আঙিনায়। সেই সৌরবে আমরা বুঁদ হয়ে থাকব চিরকাল।  

Leave a Reply

Your identity will not be published.