নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (নবম পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (নবম পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন নবম পর্ব।]

প্রথম টিকেট

এ দেশের আইনকানুন অনেক কঠিন এবং বেশীরভাগ নাগরিকই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গাড়ি চালানোর সময় কেউ যদি আইন না মেনে চলে, রেড লাইটে না থামে কিংবা গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালায়, সঠিক লেন থেকে টার্ন না করে তাহলে তাঁর কপালে অনেক ভোগান্তি আছে। প্রথমত পুলিশ তাঁর হাতে একটি মুভিং ভায়লেশনের টিকেট ধরিয়ে দেবে সেই সাথে জরিমানা তো আছেই। এটা তো আর বাংলাদেশ না যে ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতে আপনি কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে পার পেয়ে যাবেন কিংবা মামা, চাচার পরিচয় দিয়ে পার পেয়ে যাবেন!

বাংলাদেশের একটা ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এক দুপুরবেলা আমি আর আবার বাবা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। গন্তব্য বাবার ক্লিনিক। আমার বাবা পেশায় চিকিৎসক। যাই হোক, সিলেট শহরের কুমার পাড়া পয়েন্টে আসার পর পুলিশের এক সার্জেন্ট বাঁশি বাজিয়ে আমাকে থামতে বলল। আমি গাড়ি থামালাম। কালো সানগ্লাস পরা সার্জেন্ট আমার জানালার কাছে এসে ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস, ব্লু বুক ইত্যাদি চাইল। ফিটনেস, ব্লু বুক ইত্যাদি গাড়িতে থাকলেও আমার কোনো লাইসেন্স ছিল না। থাকার কথাও নয়। আমার লাইসেন্সই নাই।

সার্জেন্টকে বললাম, ভাই আমার লাইসেন্স নাই।

তাঁর চোখ চকচক করে উঠল। সে নিশ্চয়ই তখন মনে মনে বলছে ‘পাওয়া গেছে’, ‘পাওয়া গেছে’। ঠিক তখনই আমার বাবা সার্জেন্টকে বললেন, সার্জেন্ট সাহেব আপনি সারোয়ারকে চিনেন? সারোয়ার নামটি কুইনাইন ওষুধের মতন কাজ করল। সার্জেন্ট সাহেব চোখের সানগ্লাসখানি খুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, জি স্যার উনাকে চিনব না মানে? উনি আমার স্যার। বাবা বললেন, সারোয়ার আমার ভাগ্নির জামাই। সার্জেন্ট সাহেব গাড়ির ফিটনেস, ব্লু বুক ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, স্যার এটা আগে বলবেন তো! খামাখা আপনার সময় নষ্ট করলাম! এই হলো আমাদের বাংলাদেশ। মামার জোর যেখানে জয় তোমার সেখানে! 

দীর্ঘ সতেরো বছর নিউইয়র্ক শহরে ক্যাব চালিয়ে আমি হেন টিকেট নেই যেটা টিকেট খাই নি। ইম্প্রপার টার্ন, স্পিডিং টিকেট, রেড লাইট, ফেইলিওর টু ইয়েল্ড টু পেডেস্ট্রিয়ান, আনসেফ লেইন চেঞ্জ আরও কতো কি! এর সবই আমি খেয়েছি এনমকি গাড়ির ব্রেকলাইট জ্বলছে না, টায়ার একটা পালিশ হয়ে গেছে এসব তুচ্ছ কারণেও বোনাস টিকেট খেয়েছি। প্রথম প্রথম টিকেট খেলে মন খারাপ হতো, পরে এসব গা সওয়া হয়ে গেছে।

প্রথম টিকেট খেয়েছিলাম নিউইয়র্কের বিখ্যাত ফরটি সেকেন্ড স্ট্রিটে। সেদিন ছিল রোববার। মেমোরিয়াল ডে উইকেন্ড চলছে যদিও মেমোরিয়াল ডে সোমবার। সারা শহরের রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। তিন দিনের ছুটিতে নিউইয়র্কের লোকজন কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গেছে, কেউবা পরিবার-পরিজনের সাথে ছুটি কাটাচ্ছে আর বের বের হয়েছি ক্যাব নিয়ে। লিজের ক্যাব। না চালালেও পয়সা দিতে হবে। কোথায় কোনো যাত্রী চোখে পড়ছে না। হঠাৎ দুই পরিবারকে দেখলাম হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে তাঁদের ওঠাতে হলে আমাকে ইলিগ্যাল একটা টার্ন করতে হবে অর্থাৎ আইন অমান্য করতে হবে। আইনের কাঁথা পুড়ি এই ভেবে আমি আশপাশে চোখ বুলিয়ে টার্ন করলাম এবং মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের হাঁতে ধরা খেলাম। পুলিশ হারামজাদা এক কোনায় লুকিয়ে ছিল কারণ লোকজন এখানে প্রায়ই এই ইলিগ্যাল টার্নটি নেয়।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.