এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ট্যাক্সি ড্রিমস’ ডকুমেন্টারির এক চরিত্র ইন্ডিয়ান ড্রাইভার মিস্টার শর্মাকে দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হলাম। ভদ্রলোক ইন্ডিয়াতে ইনকাম ট্যাক্সের উকিল ছিলেন। নিউইয়র্কে এসে হয়েছেন ট্যাক্সি ড্রাইভার। এটা এমন কোনো আজব ঘটনা নয়। এই জীবনে কত ডাক্তার, উকিল, আর্মি অফিসারকে এই শহরে ট্যাক্সি চালাতে দেখেছি। একবার তো এক জাতীয় পার্টির এমপিকে পেয়েছিলাম, পেটের দায়ে ট্যাক্সি চালাতে নেমেছেন। আসলে দেশ থেকে আনা ডিগ্রির এখানে কোনো মূল্য নেই। আপনার দেশি ডিগ্রি এখানে কলাপাতা। কলাপাতারও দাম আছে। কারণ তা বাইরের দেশ থেকে আসে, আনতে খরচ অনেক। আপনার ডিগ্রিটাও বাইরের দেশ থেকে আসে, তবে তা মূল্যহীন; যদি না এখানে পরীক্ষা দিয়ে নতুন ডিগ্রি না নেন!
শর্মা বাবুর গল্পে ফিরে আসি। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। থাকেন জ্যাকসন হাইটসে। ট্যাক্সি চালিয়ে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। সেই ডকুমেন্টারিতে তাঁর বলা একটি কথা আমার মনে ধরেছিল। কথাটি অনেকটা এরকম, “জীবনে যে-কোনো কর্মক্ষেত্রেই সফল হওয়া যায়, যদি আপনি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়েও জীবনে সফল হওয়া যায়।” এটা এমন কোনো বাণী নয়। যুগে যুগে এমন কথা অনেকেই বলে গেছেন। তবে বলাই বাহুল্য, ভদ্রলোক ট্যাক্সি চালিয়েও সফল মানুষ আর জীবনে কে না সফল হতে চায়? হোক না সেটা ট্যাক্সি চালিয়ে বা অন্যকিছু করে? টিভিতে ডকুমেন্টারি দেখার পরের সপ্তাহে আমি ‘নিউইয়র্ক সিটি ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশন’ অফিসে যাই। সেখান থেকে লাইসেন্সের এ্যাপ্লিক্যাশনখানা নিয়ে আসি। নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালাতে যে লাইসেন্সটির প্রয়োজন সেটাকে ‘হ্যাক লাইসেন্স’ বলে। লাইসেন্সেরে এপ্লিকেশন প্রক্রিয়া মোটামুটি সহজ। ড্রাগ টেস্ট করাতে হবে, ট্যাক্সিড্রাইভিঙের ওপর কোর্স নিতে হবে। কোর্স দুই ধরনের। যাদের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তাঘাটের উপর মোটামুটি ধারণা আছে, তাদের চব্বিশ ঘণ্টার ক্লাস করলেই চলে। যারা একেবারেই আনকোরা তাদের বেলায় দুই সপ্তাহের ক্লাস। যদিও আমার এ শহরের রাস্তাঘাটের ওপর বলতে গেলে কোনো ধারণাই নেই আর যেটুকু আছে সেটা অনেকটা জলের উপর ওড়াওড়ি জল স্পর্শ নয় টাইপ। আমি তখন সাবওয়ে চড়ে কাজে যেতাম। অতএব রাস্তাঘাট চেনার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া ম্যানহাটানে সাবওয়ে ট্রেনগুলো মাটির তলায় চলাচল করে। রাস্তাঘাট দেখার সুযোগ কম। আমি চব্বিশ ঘণ্টার কোর্সটি নিলাম। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক। খরচ তিন শ’ ডলার। দুই সপ্তাহের কোর্সের খরচ প্রায় পাঁচ শ’ ডলার।
যে স্কুলটিতে ভর্তি হলাম সেটার নাম ‘মাস্টারক্যাবি ট্যাক্সি একাডেমি’। ক্লাস তিন দিন। প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে, সপ্তাহ শেষে এক শ’ মার্কের পরীক্ষা, পাশ মার্ক সত্তর। বিষয় মোট চারটি। নিউইয়র্ক শহরের উপর জেনারেল নলেজ, ম্যাপ রিডিং (বেশ কঠিন), রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন (মোটামুটি কঠিন) এবং ইংরেজি ভাষার ওপর কতখানি দখল আছে সেটার ওপর পরীক্ষা (এটা সহজ। আমি ভালো ইংরেজি জানি)। যারা ক্লাস নেন তাঁদের সবাইই রিটায়ার্ড ট্যাক্সিড্রাইভার। একেকজন বিশ, ত্রিশ বছর ট্যাক্সি চালিয়েছেন। পুরো নিউইয়র্ক শহর তাদের নখদর্পণে। ইন্সট্রাক্টরদের প্রায় সবাইই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। ক্লাস নেওয়ার সময় মজার মজাটা সব রসিকতা করেন। ট্যাক্সিড্রাইভার হিসেবে তাদের জীবন কেমন কেটেছে- এ নিয়ে নানান গল্প বলেন। ক্লাসগুলো কখনো একঘেয়ে মনে হয় নি!
ক্লাস শেষ হওয়ার পরের সাপ্তাহেই পরীক্ষা। প্রচুর পড়াশুনা করলাম। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটি কোথায়? এর উত্তর দিকে কোন রাস্তাটি আছে, দক্ষিণ দিকে কোন রাস্তা গেছে? মেয়রের অফিস কোথায়? ম্যানহাটান থেকে জেএফকে এয়ারপোর্টে কীভাবে যেতে হয়? নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে কীভাবে যেতে হয়? ৩৫০ ফিফ্থ এভিনিউ কোথায় অবস্থিত? সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর দিয়ে কটি ট্রান্সভার্স গিয়েছে? পার্ক ড্রাইভ কী? সেটা কখন ব্যবহার করা যাবে? এমন হাজারো প্রশ্ন। কাজ থেকে ফিরে প্রতিদিন বই নিয়ে বসি একনাগাড়ে। অনেকক্ষণ পড়ি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে বইপত্র সব ছুড়ে ফেলি। পড়া শেষ হওয়ার পর স্ত্রীর কাছে পরীক্ষা দিই।
যাইহোক, এক সপ্তাহ পর দুরু দুরু বক্ষে পরীক্ষার হলে গিয়ে বসলাম। কত বছর পর পরীক্ষার হলে বসেছি। শেষবার বসেছিলাম বিএসসি ফাইনালে। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই দিলাম। রেজাল্ট বের হলো এক সপ্তাহ পর। রেজাল্ট বের হওয়ার আগের রাতে টেনশনে একফোঁটা ঘুমাতে পারি নি। মেট্রিক, ইন্টার, বিএসসির মতন কঠিন সব পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার আগের রাতেও মনে হয় এমন টেনশন হয় নি। সারাক্ষণ মাথার ভেতর এক চিন্তা, যদি ফেল করি? দুপুরবেলা গেলাম মাস্টারক্যাবি ট্যাক্সি একাডেমিতে। একাডেমির মালিক ‘টেরি গেলবার’ বিশাল সাইজের এক কাগজ টেবিলে বিছিয়ে বসে আছেন। এক এক করে সবার নাম ডাকছেন। আমার পালা এল।
‘তানকিউল হাসান ইউ পাসড’ বলে হাতে একখানা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলেন আর বললেন, ‘গো মেইক সাম মানি’। তোমার হ্যাক লাইসেন্স আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মেইলে পাবে।’
লোকটার কথাগুলো আমার কানে মধুর শোনাল। পরীক্ষায় খুব সম্ভব আমি এক শতে সাতাত্তর পেয়েছিলাম। খুব ভালো মার্ক না এবং তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার টার্গেট ছিল পাশ করা। আমি পাশ করেছি সেটাই মুখ্য বিষয়। ক্লাসের সহপাঠী অনেকেই পরীক্ষায় ফেল করল। তার একমাত্র কারণ ইংরেজি ভাষার ওপর তাদের দখল অনেক কম। পরীক্ষায় পাশ করার পরের সপ্তাহ আমার কাটল প্রতীক্ষার প্রহর গুণে। প্রতিদিন মেলবক্সে সেই কাঙ্খিত চিঠিটি খুঁজি, যার ভেতর আছে আমার হ্যাক লাইসেন্স। প্রায় বারো দিনের মাথায় লাইসেন্স এল। লাইসেন্স হাতে পেয়ে মনে হলো হাতে চাঁদ পেয়েছি।
এখন আমাকে আটকায় কে?
(চলবে)
Leave a Reply
Your identity will not be published.