ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিক্স-এর বিচারে সর্বকালের সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকার সাত নম্বরে আছে ‘চারুলতা’। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় ছবিটি।
‘নষ্টনীড়’ রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের গল্প, যখন রোমান্টিকতার মোহন জগৎ ছেড়ে তিনি ক্রমশ বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা রেখেছেন। ভূপতি, চারুলতা ও অমল— তিনটি প্রধান চরিত্র নষ্টনীড়ের। বাংলা একটি সাপ্তাহিক সম্পাদনা করে ভূপতি, সব সময় কাজে মগ্ন। তার স্ত্রী চারুলতার সবকিছু একঘেয়েমি লাগে ও সময় যেন তার কাটতেই চায় না। তারপর যখন অমল, ভূপতির দূরসম্পর্কের এক ভাই, এল ভূপতি-চারুর সংসারে, ধীরে ধীরে চারু ও অমলের মধ্যে নতুন একটা সম্পর্ক দাঁড়াল, যার পরিপ্রেক্ষিতে ভূপতি-চারুর দাম্পত্যজীবনে ভাঙন দেখা দেয়।
কলকাতা নগরীর পটভূমিতে এক অভিজাত পরিবারের আধুনিক নারীর হৃদয়বেদনার গল্প এটি। অবশ্য এ গল্পে হৃদয়াবেগের চেয়ে মনোবিকলন, গতির চেয়ে বিকৃতি, গীতময়তার চেয়ে বিশ্লেষণ সমধিক।
‘চারুলতা’ বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের চিরসবুজ চলচ্চিত্র। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এটিকে তাঁর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্ররূপের ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন এই চলচ্চিত্র। কেননা স্বতন্ত্র মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের নিজস্ব চরিত্র বিদ্যমান থাকায় গ্রহণ, বর্জন ও সংযোজনের মাধ্যমে এবং চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্পনার আশ্রয়ে ‘চারুলতা’ ছবিতে মূল সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধার সুর আছে এবং মূল গল্পের থিম অক্ষুণ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য, ‘...আজকের মতো ঘর ভেঙে গেছে, বিশ্বাস ভেঙে গেছে, ছেলেমানুষী কল্পনার জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবের জগতে নেমে এসেছে দুজনেই। এটাই বড় কথা। এটাই নষ্টনীড়ের থিম। আমার মতে চারুলতার এ-থিম অটুট রয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথের মূল গল্পে যে প্রশান্তি চলচ্চিত্রে তা নেই; বরং অস্থিরতা এর আবেগধর্ম, ঊনবিংশ শতাব্দীর উচ্চমধ্যবিত্ত নীতি ও বিবেকবোধ সতর্কতার সঙ্গে প্রতিফলিত। গল্পে ভূপতি যেন চারু-অমলের তুলনায় অনেকটাই ম্লান, কিন্তু চলচ্চিত্রে তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্ব সত্যজিতের।
আঙ্গিকগত দিক থেকেও চলচ্চিত্রটি তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে প্রথম দৃশ্যটি, যেখানে ক্যামেরা মুভমেন্ট ও প্যানের সাহায্যে চারুর একাকিত্ব, নির্জনতা ও ঔৎসুক্য দেখানো হয়েছে, যা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ ক্যামেরা মুভমেন্ট, এতে চারুলতার মনের ভাব ও ভাবনাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে। অথবা সেই দৃশ্যটি, যেখানে বাগানের সবুজ ঘাসের শয্যায় শুয়ে অমল লিখছে এবং চারু দোলনায় দোল খাচ্ছে— এ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের অসাধারণ কাজ। কেননা এখানে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন শট নেয়া হয়েছে। কখনো অমলের দৃষ্টিকোণ থেকে চারুলতাকে, কখনো চারুলতার দৃষ্টিকোণ থেকে অমলকে এবং কখনো আবার পরিচালকের দৃষ্টিকোণ থেকে ওদের দুজনকে দেখানো হয়েছে। কাছের ভূপতিকে অপেরা-গ্লাস দিয়ে দেখার ব্যঞ্জনাময় শট সত্যজিতের চলচ্চিত্র-ভাষাজ্ঞানের নিঃসংশয় প্রমাণ। আরও কয়েকটি শটের কথা বলা যায়। যেমন—ভূপতির সামনে বসে অমল তার লেখা পাঠ করছে, ভূপতি অমলের বিয়ের কথা তুলল, মশারির আরেকদিকে বসে চারুলতা সব শুনল; ভূপতি যখন কপর্দকহীন তখন নিষ্ক্রিয় ছাপাখানা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাসের মূল্য সম্পর্কে যখন মন্তব্য করছে ভূপতি, তখন পেছনের দিকে চারুলতা নিজেকে গোপন করছে।...চলচ্চিত্রের এইসব শট অসাধারণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এইসবের মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্রকার ঘটনাকে অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। গল্পের শেষাংশ থেকে চলচ্চিত্রের শেষাংশ ভিন্ন এবং এই ভিন্নতার মধ্যেই চলচ্চিত্রের স্বাতন্ত্র্য, মাধ্যমগত ভিন্নতা মূর্ত হয়ে উঠেছে। অবসন্ন চিত্ত, ব্যথিত হৃদয় ভূপতি বাড়ি ফেরে, চারু দরজা খুলে ভূপতিকে গ্রহণ করতে চায়। সে ভূপতির দিকে হাত বাড়ায়, ভূপতিও হাত বাড়িয়ে দেয় সেই হাতের দিকে। কিন্তু হাত মিলিত হওয়ার আগেই শটটি ফ্রিজ হয়ে যায়। চারু ও ভূপতির আত্মিক ব্যবধানটুকু মূর্ত হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, বাংলা চলচ্চিত্রের এটিই প্রথম ফ্রিজ শট। আর হ্যাঁ, তিনটি প্রধান ভূমিকায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায় (ভূপতি), সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (অমল) এবং মাধবী মুখোপাধ্যায় (চারুলতা) চলচ্চিত্রোপযোগী সুন্দর অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রোপযোগী সুন্দর অভিনয় করেছেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.