শম্পা কী চায়? (তৃতীয় পর্ব)

শম্পা কী চায়? (তৃতীয় পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

আজ আকাশে ফকফকা পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোয় ছাদে বসে রোকসানা গাইছে,

‘ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা, এই মাধবী রাত
আসে নি তো বুঝি আর জীবনে আমার…’

রোকসানার পাশে মিলি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। চাঁদের তরলিত মোমে ওদের মুখে রুপালি আভা। এমন দৃশ্যকেই কি চাঁদের হাট বলে?

আহা একদিন এই গান শুনেই রোকসানার প্রেমে পড়েছিলাম। আমি কাছে যেতেই রোকসানা গান থামিয়ে বলল, দ্যাখো, আজ কেমন আকাশ ভেঙে জ্যোৎস্না নেমেছে। মিলি বলল সে নাকি বহুদিন আমার গান শোনে না। তাই দুজন মিলে আসর জমালাম। তুমি বসো, আমি চট করে চা নিয়ে আসছি।

রোকসানার মুখে কি একটা অভিমানের ছায়া পড়ল? আবছা আলোয় ঠিক বোঝা গেল না। ও চা আনতে নিচে চলে গেল। মিলি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি অ্যান্ড আই ডিড নট লাইক ইট।

কী খেয়াল করেছিস?

তুমি কিন্তু মাকে আর আগের মতো সময় দাও না। অফিস থেকে এসেই কম্পিউটারের মনিটরে আঠার মতো লেগে থাকো। সো আই হ্যাড টু ডু ইওর জব।

তোকে ধন্যবাদ।

মিলি হারমনিয়ামে হালকা করে ইমনকল্যাণ রাগে গান ধরল,

‘কোথা গেছে তব উদাস হৃদয়, কোথা পড়ে আছে ধরণি।

মায়ার তরণি বাহিয়া যেন গো মায়াপুরী পানে ধাও…’

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আসলেই তো আমি নিজের ঘরসংসার ছেড়ে কোন মায়াপুরীর ফাঁদে পড়লাম! এই দুঃস্বপ্ন কি কাল শেষ হবে?

রোকসানা চা নিয়ে এসে আবার গান আরম্ভ করল। আমি, রোকসানা, মিলি, মোমজ্যোৎস্না আর মন উদাস করা গান, সঙ্গে ফ্লাস্কের গরম চা, এভাবে চলল আরও ঘণ্টাখানেক। কত দিন পর এ বাড়িতে এত নির্মল আনন্দ হলো। রাতে বিছানায় রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম, এক মুহূর্তের জন্যও ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না।

পরদিন সকাল ন’টায় ক্লাস। পৌনে ন’টায় ক্লাসে ঢুকেই সতর্কভাবে সামনে তাকালাম। নাহ, শম্পাকে দেখা যাচ্ছে না। ও যে ধরনের মেয়ে, হয়তো পেছনের কোনো বেঞ্চে ঘাপটি মেরে বসে আছে। হঠাৎ কোনো একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করবে।

রোকসানার আড়ালে শ্রাবণীকে নিয়ে জড়ানোর পর থেকে আমি খুব অপরাধবোধে ভুগছি। ক্লাসে এসে বোধহয় তার প্রভাব পড়ল। স্টুডেন্টদের দিকে তাকিয়ে বললাম, সাহিত্যে প্রেম নিয়ে আজ আমরা আরেকটু আলাপ চালাব। প্রেমিকা প্রেমিককে তার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে বলছে, এ রকম বিষয়ে কোনো কবিতা পড়েছ তোমরা?

কানে ঝুমকো দুল পরা একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, ও রকম বোকা জিএফ এখনকার দিনে পাবেন না স্যার।

অন্যরা হো হো করে হেসে দিল। ওদের মনের আড় ভাঙছে, ওরা ওপেন হচ্ছে, এটাই ভালো। বললাম, তোমরা নিশ্চয় সিলভিয়া প্লাথের নাম শুনেছ?

অনেকেই মাথা নাড়াল। আমি বললাম, এই সিলভিয়া প্লাথের বান্ধবী ছিলেন আরেক বিখ্যাত কবি অ্যান সেক্সটন। ওনার একটা কবিতার নাম For My Lover, Returning To His Wife. দ্যাখো তোমাদের জিএফ কী বলছে ম্যারিড বিএফকে,

She has always been there, my darling.

She is, in fact, exquisite.

Fireworks in the dull middle of February

and as real as a cast-iron pot.

She is the sum of yourself and your dream.

Climb her like a monument, step after step.

She is solid.

As for me, I am a watercolor.

I wash off.

‘প্রিয়, ফিরে যাও

তোমার অপরূপা স্ত্রীর কাছে,

ও তো চিরকাল তোমার হাত ধরে আছে,

তোমার একঘেয়ে অঘ্রাণে

ও যে আলোর আতশবাজি, তোমার

দুঃসময়ে লোহার কড়াইয়ের

মতো শক্ত অবিচল...।

ও তোমার প্রিয়তমা,

তুমি আর তোমার স্বপ্নের সাঁকো,

ওর শক্ত সিঁড়ি বেয়ে মহিমার শিখরে

তোমার আরোহণ।

আর আমি?

আমি তো জলরং,

আমি জলেতে হারাই।...’

পড়া শেষে বললাম, আরেকজনের হাজব্যান্ডের সঙ্গে প্রেম করে মেয়েটা অপরাধবোধে ভুগছে। মনের ভেতর গভীর অনুরাগ এবং বেদনা নিয়ে সে প্রেমিককে বুঝিয়ে বলছে লোকটি যেন তার স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়।

আগের ঝুমকো দুলের মেয়েটা বলল, এ রকম ভালো মানুষ এখন আর পাবেন না স্যার। ফেসবুকে যে-কোনো গার্লস গ্রুপে ঢুকলেই বুঝবেন।

সবাই আবার হেসে দিল। আমার কথা তখনো শেষ হয় নি, বললাম, আরেকটি মেয়ের কবিতা বলি। ওর নাম জেইসি ডিন, একেবারেই তোমাদের বয়সী অ্যাসপায়ারিং পোয়েট, শোনো,

But I am not the one you want by your side.

Just like waves kissing the shore;

I'm only here for a while.

‘তুমি যাকে পাশে চাও

সে আমি নই,

জলের কল্লোলের মতো

তোমার বেলাভূমি

চুমু দিয়ে

আমি মুহূর্তে মিলাই।’

আমি আবৃত্তি থামিয়ে সামনে তাকালাম। এই ছেলেমেয়েগুলো অবিবাহিত। এখনো মন অসংবেদী হয়ে যায় নি। স্ত্রীর বেদনা গভীরভাবে এদের মন ছুঁয়েছে। কেউ কথা বলছে না।

ক্লাস শেষে অ্যাডমিনের কিছু কাজ সেরে অফিসে ঢুকতে গিয়ে দেখি, বাইরে শম্পা দাঁড়িয়ে আছে। কলাপাতা রঙের শাড়িতে ওকে পরির মতো লাগছে। কে বলবে এই মেয়ে ভেতরে ভেতরে ধুনধুনা চালাক?

আমার পেছন পেছন শম্পা রুমে ঢুকে কিছু বোঝার আগেই চুক করে আমার গালে একটা চুমু বসিয়ে দিল। আমি ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মতো ছিটকে দূরে সরে গেলাম। এই চুমুর জন্য আবার কী ভোগান্তি আনে কে জানে! শম্পা আমুদে ভঙ্গিতে বলল, তুমি যে আজ টাকা দিবা, এজন্য এই খুচরা রিওয়ার্ড।

আমি ত্রস্ত হয়ে বললাম, প্লিজ আর কখনো এসব করবেন না।

সে দেখা যাবে।

আমি ড্রয়ার থেকে থেকে দশ হাজার টাকার খাম বের করে শম্পার হাতে দিলাম। শম্পা খাম নিয়ে বলল, প্রফেসর সাহেব, আজ কিন্তু আমি তোমার ক্লাসের একদম পেছনে ঘাপটি মেরে ছিলাম। ওহ, আজ যা একখান দিলা না চান্দু!

আমি সতর্ক কণ্ঠে বললাম, কী দিলাম?

ওই যে প্রেমিকা আর বউ নিয়া অ্যান সেক্সটনর কবিতা পড়লা। আমার কী মনে হচ্ছিল বলি?

আপনার কী মনে হচ্ছিল আমি শুনতে চাই না।

শম্পা আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে হাত জোড় করে বলতাছি যাও চান্দু আপুর কাছে ফিরে যাও, আপুই তো তোমার দেখভাল করবে। এ যেন তোমার আমার গোপন কাহিনি।

আপনার আমার কোনো গোপন কাহিনি নাই।

শম্পা টাকা গুণে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, তুমি শেষে আরেকটা বেলাভূমি আর ঢেউয়ের কবিতা পড়লা না?

হুম, Just like waves kissing the shore; I'm only here for a while.

আমি তো শুনে অবাক।

কেন?

ঢেউ আর বেলাভূমি নিয়ে তো ওই অ্যান সেক্সটনেরই একটা ভালো কবিতা ছিল। ওইটা পড়লেই তোমার আমার সেই পাগলা সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। বলি?

আমি শুনতে চাচ্ছি না।

তবুও বলি, ইন্টিমেট কবিতা। তোমার কবিতা শুনতে শুনতে গুগল ঘেঁটে পেলাম, এই যে শোনো চান্দু,

When man

enters woman,

like the surf biting the shore,

again and again...

অনুবাদ করে দিবা, পি-লি-জ।

না, আপনার টাকা আপনি পেয়েছেন, এখন চলে যান দয়া করে। আমার মাথাব্যথা করছে।

যেতে বলছো বটে কিন্তু আমি জানি ডিপ ইন ইওর হার্ট ইউ ওয়ান্ট মি। যাকগে প্রফেসর, মাসের প্রথম দিন হলেই আমার জন্য ভালো হয়।

মাসের প্রথম দিন কী হলে ভালো হয়?

বাহ, এই যে হাত খরচ দিলা, এটা প্রত্যেক মাসে দিবা না? অন্তত যতদিন আমি ভার্সিটিতে আছি?

কী বলছেন? কেন আমি আপনাকে মাসে মাসে টাকা দেব?

তা ছাড়া মেয়েদের কিন্তু দু’ তিন সেট জামাকাপড়ে হয় না, মাসে মাসে অনেক জামাকাপড় কেনা লাগে।

আমি স্তব্ধ হয়ে শম্পার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম, কীভাবে এই জোঁকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়!

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.